কার্বন ক্রেডিট বাজারে ভূমিকা রাখতে প্রয়োজন কার্যকর নীতি-বিনিয়োগ

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:৪০ পিএম, ১৬ মে ২০২৪

আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন ফিন্যান্সিং উদ্ভাবনী ফান্ডে পরিণত হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কার্বন খাতে বিনিয়োগ করলেও বাংলাদেশে এ খাতে বিনিয়োগ কম। কার্বন ফিন্যান্সিংকে এগিয়ে নিতে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা করা জরুরি। বাংলাদেশ কার্বন ফিন্যান্সিংয়ে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তফসিলি ব্যাংক ও বড় প্রতিষ্ঠানকে এই খাতে অর্থায়নে এগিয়ে আসতে হবে। নবায়ন যোগ্য জ্বালানিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কার্বনের বাজারে অবস্থান শক্তিশালী করতে নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন। নীতিমালায় কার্বন বাজারকে আকৃষ্ট করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) অডিটোরিয়ামে ‘এপ্লিকেশন অব কার্বন ফিন্যান্সিং: চ্যালেঞ্জ অ্যান্ড পলিসি অপশন ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ’র চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত এ এফ এম গওসোল আযম সরকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, কার্বন ক্রেডিট পরিবেশ বান্ধব প্রকল্প গ্রহণে ভূমিকা রাখবে। কার্বন ক্রেডিট বিক্রির লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অপর্যাপ্ত তহবিল, দক্ষ জনবলের অভাব এবং স্টেকহোল্ডারদের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। সঠিক কৌশল ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ শিগগিরই আন্তর্জাতিক কার্বন ক্রেডিট বাজারের বড় অংশীদার হয়ে উঠতে পারে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, কার্যকর নীতি ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কার্বন ক্রেডিট বাজারে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। দেশের সামগ্রিক কার্বন ফুট-প্রিন্ট কমানোর লক্ষ্য নিয়ে, সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি আজকের সেমিনারে ধারণার আদান-প্রদান আমাদের আরও বুঝতে সাহায্য করবে কীভাবে আমরা কার্বন অর্থায়ন সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে পারি এবং কীভাবে আমরা কার্বন ক্রেডিট তৈরির জন্য নতুন উত্স অন্তর্ভুক্ত করে সুবিধা নিতে পারি।

ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বর্তমান সরকার যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের উপযোগিতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়, যার অন্যতম উদাহরণ পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন।

সেমিনারে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইআইএসএস’র রিসার্স ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর। মূলপ্রবন্ধে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে চীন, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করেন। একইসাথে পুরো বিশ্বের কার্বনের বাজার সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেন।

তিনি বলেন, বতর্মানে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার কারণে বেশি কার্বন উৎপাদিত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই কার্বন খাতে বিনিয়োগ করলেও বাংলাদেশে এই খাতে বিনিয়োগ কম। যার কারণে কার্বন বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নগণ্য। কার্বনের বাজারে অবস্থান শক্তিশালী করতে নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালে বিদ্যুৎ খাতে ২৮ শতাংশ, পরিবহন খাত ১৫ শতাংশ, কৃষি খাত ১২ শতাংশ, জ্বালানির ব্যবহার খাতে ১২ শতাংশ, আবাসন খাতে ৭ শতাংশ এবং বর্জ্য খাতে ৫ শতাংশ কার্বন উৎপাদিত হয়েছে।

মাহফুজ কবীর বলেন, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন ফিন্যান্সিং উদ্ভাবনী ফান্ডে পরিণত হবে। উন্নয়ন দেশগুলির জন্য টেকসই শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

আলোচনায় ইউএনডিপির প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট আরিফ এম ফয়সাল বলেন, কার্বন ফিন্যান্সিংকে এগিয়ে নিতে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন কর জরুরি। নীতিমালায় কার্বন বাজারকে আকৃষ্ট করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ বিশ্বের অন্যান্য দেশ এই খাতে অনেক দূর এগিয়েছে।

তিনি বলেন, স্পষ্ট একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে খাতকে এগিয়ে নিতে নতুন বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে হবে। শুধু তাই নয়, কার্বনকে বহি:বিশ্বের বিক্রির জন্য উদ্যোগও নিতে হবে। কার্বনের বাজার খুবই দ্রুত ওঠানামা করে থাকে। সেই কারণে ছোট বা মাঝারি বিনিয়োগকারীরা খুব বেশি আগ্রহী হয় না। তাই কার্বন ফিন্যান্সিংয়ে বড় বিনিয়োগ টানতে হবে।

ইউকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর মোর্শেদ বলেন, কার্বন ফিন্যান্সিংয়ে বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশের তফসিলি ব্যাংক ও বড় প্রতিষ্ঠানকে এই খাতে অর্থায়নে এগিয়ে আসতে হবে। আর নবায়ন যোগ্য জ্বালানিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। মূলত অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে বিশেষ ভূমিকা রাখার কথা বলা হয়েছে।

বিজিএমইএ’র পরিচালক শামস মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে টেক্সটাইল খাতে ২১৭টি গ্রিন কোম্পানি রয়েছে এবং গ্রিন প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে আরও ৫০০-এর বেশি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু গ্রিন প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও ইকোনমিক জোন থেকে যেভাবে সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল, প্রকৃতপক্ষে সেটি পাওয়া যায় না। সেই কারণে গ্রিন কারখানা নিয়ে আগ্রহ কিছুটা কমছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. নজরুল ইসলাম বলেন, কার্বন ফিন্যান্সিংয়ের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আগামীতে এই ধরনের ইস্যু সম্মিলিতভাবে আলোচনা করতে হবে।

সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন বিআইআইএসএস’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. আবু বকর সিদ্দিক খান। এছাড়া বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত সচিব আবু ইউসুফ, বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র এনভায়রনমেন্ট স্পেশালিষ্ট ইয়ান জো এলিসন ই। এতে কার্বন ফিন্যান্স বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন ড. আইনুন নিশাত এবং প্রফেসর ড. হেলাল আহমেদ।

কার্বন ক্রেডিট মূলত এক ধরনের অনুমোদন, যার মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ১ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা অন্য কোনো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অধিকার লাভ করে। কার্বন ক্রেডিটের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো কার্বনের ওপর মূল্য ধার্য করে এর নিঃসরণ কমাতে উৎসাহ দেওয়া, যা পরিণতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব প্রশমিত করবে।

কার্বন ক্রেডিট হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন বাড়ানোর পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কমানোর একটি পথ তৈরি করে দেয়। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমায় বা করে না, এমন সব প্রকল্পের মাধ্যমে কার্বন ক্রেডিট অর্জন করা যায়।

এ প্রকল্পগুলো অনেকভাবে নেওয়া হতে পারে— বায়ু, সৌর, জল ও ভূ-তাপীয় বিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উদ্যোগ, ভবন, কারখানা বা পরিবহন ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ায় এমন জ্বালানিসাশ্রয়ী প্রকল্প, নতুন বন তৈরি বা ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুদ্ধার করার জন্য বনায়ন ও পুনঃবনায়ন প্রকল্প, ভাগাড় থেকে নিঃসৃত মিথেন ধরে রাখার প্রকল্প প্রভৃতি।

এই প্রকল্পগুলো সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাস্তবায়ন করা হয় এবং জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসি) মতো স্বীকৃত তৃতীয়পক্ষের সংস্থা দ্বারা প্রত্যায়িত হয়। প্রত্যয়নের পর একটি প্রকল্প কার্বন ক্রেডিট অর্জন করতে থাকে। এ ক্রেডিট কার্বন বাজারে বিক্রি বা লেনদেন করা যায়, যা দেশ, ব্যবসা ও ব্যক্তিদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিয়ে থাকে।

এমএএস/এমএএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।