ডিজিটাল যুগেও অ্যানালগ সিগন্যাল, বাড়ছে মুখোমুখি ট্রেন দুর্ঘটনা

মো. নাহিদ হাসান
মো. নাহিদ হাসান মো. নাহিদ হাসান , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:৫৮ পিএম, ০৬ মে ২০২৪
গাজীপুরে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন, ফাইল ছবি

গত একযুগে রেলের উন্নয়নে খরচ হয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। রেলে বিনিয়োগে অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেলেও সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে সামান্য। অনেক জায়গায় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই চালানো হচ্ছে ট্রেন। এতে ছোট ভুলে ঘটছে বড় দুর্ঘটনা।

ডিজিটাল যুগে এসব অ্যানালগ সিগন্যাল পদ্ধতিকে একেবারেই অকার্যকর বলছেন অনেকে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে যেসব ট্রেন দুর্ঘটনায়, অনুসন্ধানে দেখা গেছে সেগুলোতে দায় ছিল সিগন্যাল ব্যবস্থার।

দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যাল ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। সনাতন সিগন্যাল পদ্ধতি, পয়েন্টসম্যানের ভুল বা সিগন্যালম্যানের ভুলের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। বেশ কিছু জায়গায় ডিজিটাল সিগন্যাল পদ্ধতি চালু হলেও রেলের উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় সেসব এখন বন্ধ। বাধ্য হয়ে সনাতনী বা অ্যানালগ পদ্ধতিতে ট্রেন প্রবেশ বা ক্রসিং করানো হচ্ছে। এতে সামান্য ভুলেই বাড়ছে দুর্ঘটনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজিটাল সিগন্যাল পদ্ধতি সম্পূর্ণ চালু না হওয়া, রেলের কর্মচারীদের দক্ষ করে গড়ে না তোলা আর দায়িত্বহীনতাই এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

যদি সিগন্যালম্যানের হাতে সিগন্যাল বাতি না থাকে সেক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে ট্রেন থামানোর প্রয়োজন হলে রেল লাইনের মাঝে দাঁড়িয়ে দুই হাত উঁচু করে প্রদর্শন করবেন। আবার রাতে যদি জরুরি লাল সিগন্যাল বাতি না থাকে সেক্ষেত্রে কাপড়ে আগুন ধরিয়ে প্রদর্শন করতে হবে। এমন সব মান্ধাতার আমলের নিয়মেই এখনো চলছে ট্রেন।

গত শুক্রবার গাজীপুরের জয়দেবপুর স্টেশনের দক্ষিণ আউটার সিগন্যালে ছোট দেওড়ার কাজীবাড়ি এলাকায় মালবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় যাত্রীবাহী টাঙ্গাইল কমিউটারের ৩টি বগি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। লাইনচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৯টি বগি। দুর্ঘটনার সাড়ে ৩১ ঘণ্টা পর শেষ হয় উদ্ধারকাজ। এই ঘটনার পরদিনই শনিবার দুপুরে সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম রেলওয়ে স্টেশনে কলকাতা থেকে ঢাকাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটি স্টেশনের ৫ নম্বর লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। দায়িত্বে থাকা স্টেশন মাস্টার ও পয়েন্টসম্যানের ভুল সিগন্যালের কারণে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ধুমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনটি একই লাইনে প্রবেশ করে। তবে চালক একই লাইনে আরেকটি ট্রেন দেখতে পেয়ে দ্রুত থামিয়ে দেওয়ায় মুখোমুখি সংঘর্ষের হাত থেকে ট্রেন দুটি রক্ষা পায়।

গত বছরের ২৩ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আন্তঃনগর এগারোসিন্ধুর এক্সপ্রেস ও একটি মালবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২২ জন নিহত এবং বহু যাত্রী হতাহত হয়। তদন্তে সিগন্যাল অমান্য করে স্টেশনে প্রবেশ করা এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতাকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

দুই ট্রেনের এমন সব সংঘর্ষের ঘটনা দিনকে দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে বলছে, যেহেতু অ্যানালগ সিগন্যাল পদ্ধতির কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা বাড়ছে, বিষয়টি তারা তদারকি করবে।

আরও পড়ুন

গত শুক্রবার ঘটে যাওয়া গাজীপুরের রেল দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানতে রেলের সিওপিএস মো. শহীদুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি আঞ্চলিক কমিটি করা হয়েছে। আর রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলী (সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন) সৌমিক শাওন কবিরকে প্রধান করে আরেকটি পাঁচ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা গাজীপুরে থাকা রেলের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলছেন। রোববার দুপুরে ঢাকা বিভাগীয় রেলওয়ে প্রকৌশলীর কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির কাছে ঘটনার বর্ণনা দিতে আসা রেলের দুজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা হয়েছে জাগো নিউজের।

তারা জানান, গাজীপুরে দুর্ঘটনা ভুল সিগন্যালের কারণে ঘটেছে। আগে থেকে যে মালবাহী একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল, যাত্রীবাহী ট্রেনের চালক সেটি জানতেন না। কারণ তাকে লাইন ক্লিয়ারের স্লিপ দেওয়া হয়েছে। যখন ভুল স্লিপ দেওয়া হয়েছে, যেহেতু সেখানে ডিজিটাল সিগন্যাল বন্ধ সেহেতু লাইনম্যানের সিগন্যাল দেওয়ার কথা ছিল। সেটিও দেওয়া হয়নি। এজন্য এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

ডিজিটাল যুগেও অ্যানালগ সিগন্যাল, বাড়ছে মুখোমুখি ট্রেন দুর্ঘটনাঅল্পের জন্য রক্ষা পায় মৈত্রী ও ধূমকেতু এক্সপ্রেস

এ দুই কর্মচারী জানান, একটি পয়েন্ট থেকে আরেকটি পয়েন্টে যাওয়া পর্যন্ত ট্রেনের গতি থাকতে হবে ঘণ্টায় ১৬ কিলোমিটার। চালকের দোষ থাকতে পারে। হয়তো ট্রেনটি ১৬ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলছি। এর বেশি না। তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে দোষ কার।

দ্বিতীয় তদন্ত কমিটির সদস্য রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) জহিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে হিউম্যান ফেইলিওরের কারণে (মানুষের ভুল) দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। হয়তো রেল সিগন্যালারের দায়িত্বে গাফিলতি ছিল। তদন্ত কমিটি কাজ করছে। এ সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত শেষ হবে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।

আরও পড়ুন

রেলের কয়েকজন কর্মচারী জানান, যেসব স্থানে ডিজিটাল সিগন্যাল সিস্টেম নেই, সেসব স্থানে সিগন্যালম্যানরা হাত বাতি জ্বালিয়ে ট্রেনকে নির্দেশনা দেবেন। এটাই নিয়ম। যদি সিগন্যালম্যানের হাতে সিগন্যাল বাতি না থাকে সেক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে ট্রেন থামানোর প্রয়োজন হলে রেল লাইনের মাঝে দাঁড়িয়ে দুই হাত উঁচু করে প্রদর্শন করবেন। আবার রাতে যদি জরুরি লাল সিগন্যাল বাতি না থাকে সেক্ষেত্রে কাপড়ে আগুন ধরিয়ে প্রদর্শন করতে হবে। এক্ষেত্রে কাছে কোনো কাপড় পাওয়া না গেলে গায়ে থাকা কাপড় খুলে তাতে আগুন ধরিয়ে প্রদর্শন করতে হবে। এমন সব মান্ধাতার আমলের নিয়মেই এখনো চলছে ট্রেন।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে কথা হয় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনের পরিচালক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, মুখোমুখি সংঘর্ষ দুটি কারণে হতে পারে। চালক যদি সিগন্যাল অমান্য করেন অথবা স্টেশন মাস্টার যদি সিগন্যাল দিতে ভুল করেন। ক্রসিংয়ে যখন লাল বাতি সিগন্যাল থাকবে, তখন প্রবেশ করা যাবে না। লাল মানেই বিপজ্জনক। হলুদ সংকেত পেলে ধীরে ধীরে ট্রেন থামাতে হবে। সবুজ সংকেতে ট্রেন চলতে পারবে।

এছাড়া রেলের মুখোমুখি সংঘর্ষের বিষয়ে বেশ কয়েকজন ট্রেন চালকের সঙ্গে কথা হয়েছে জাগো নিউজের। তারা জানান, ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় চালকের ত্রুটি খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। এক্ষেত্রে চালকের দোষ থাকে না বললেই চলে। কারণ পয়েন্ট (চলাচলের অনুমতি) পাওয়ায় পরই কেবল চালক লাইন দিয়ে চলাচল করেন। ট্রেনযাত্রা শুরুর আগেই স্টেশন মাস্টার কর্তৃক এই অনুমতি দেওয়া হয়। কাজেই অনুমতি ব্যতীত চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। যারা পয়েন্ট তৈরি করেন বা যে স্টেশন মাস্টার পয়েন্ট দেন, তাদের ভুলের কারণেই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে।

ট্রেন চালকরা আরও জানান, একজন ট্রেনের চালক চলাচলের অনুমতি পাওয়ায় পরও সিগন্যাল দেখে সেই রাস্তায় ট্রেন প্রবেশ করান। এখন চালককে যদি ভুল পয়েন্ট দেওয়া হয় আবার সিগন্যালও না দেওয়া হয়, তাহলে দোষটা চালকের হতে পারে না।

এসব নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী জাগো নিউজকে বলেন, গাজীপুরের দুর্ঘটনাস্থলে কাজ চলছিল, ডিজিটাল সিগন্যাল সিস্টেম বন্ধ ছিল। আরও কিছু জায়গায় প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় সেগুলোও ম্যানুয়ালি চলছে। যারা সিগন্যাল দেওয়ার দায়িত্বে তাদের ভুলে এরকম হচ্ছে। আমরা সবাইকে সতর্ক করছি। যেন এরকম ভুল আর না হয়।

ডিজিটাল যুগেও অ্যানালগ সিগন্যাল, বাড়ছে মুখোমুখি ট্রেন দুর্ঘটনা

স্টেশন মাস্টারদের নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা দুর্বল ও ওয়াকিটকি কাজ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কিছুদিন আগে জানতে পেরেছি কিছু ওয়াকিটকি কাজ করছে না। যেগুলো কাজ করছে না সেগুলো চেঞ্জ করে নিতে বলা হয়েছে। আর ওয়াকিটকির পাশাপাশি মোবাইলও দেওয়া আছে। যেহেতু ভুল হচ্ছে, আমরা মনিটরিং বাড়াচ্ছি।

এসব দুর্ঘটনা প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, উন্নয়ন কার্যক্রম মাথায় রেখেই আমাদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। একটি লাইনে আরেকটি ট্রেন ঢুকে যায়। এতে বড় ধরনরে দুর্ঘটনা ঘটে। রেলে পয়েন্ট এন্ড ক্রসিং এক-তৃতীয়াংশ এখনো কম্পিউটার সিস্টেমে করা হয়নি। উন্নয়ন কার্যক্রম পরিকল্পিতভাবে করতে হবে। যেসব স্থানে ম্যানুয়ালি সিস্টেম করা, সেসব স্থান দ্রুত অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে৷

এই অধ্যাপক বলেন, রেলে বিনিয়োগে ঘাটতি নেই। তবে পয়েন্ট অ্যান্ড ক্রসিং সিস্টেমে বিনিয়োগের ঘাটতি রয়েছে। সেখানে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা অপেশাদার, অদক্ষ। এসব কর্মচারীকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে বেশি নজর দেই। রেলের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে আধুনিকায়ন করা জরুরি।

তিনি বলেন, উন্নয়ন কাজ শুরুর আগেই কর্তৃপক্ষের জানা ছিল যে এসব স্থানে ম্যানুয়ালি অপারেট করতে হবে। তাহলে কেন সেসব জনবলকে প্রশিক্ষিত করা হলো না! বিকল্প ব্যবস্থা তো রাখতে হবে। ট্রেনের লাইন ক্রসিংয়ের কাজটি যদি ম্যানুয়ালি করতে হয়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই অপারেটরদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করতে হবে।

এনএস/এমএইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।