বর্জ্য সংগ্রহকারীদের বিপৎসংকুল জীবন
সকাল ১০টা। গুলশান-১ এর ২৪ নম্বর রোড। বড় প্লাস্টিকের ড্রামে করে বাসাবাড়ি থেকে গৃহস্থালির বর্জ্য সংগ্রহ করছেন শফিকুল ইসলাম। একেক বাড়ি যাচ্ছেন, আর ড্রাম কাঁধে নিয়ে বর্জ্য নিয়ে ভ্যানে রাখছেন। বর্জ্যের ওপর উড়ছে মাছি। বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। এর মধ্যেই হাতে গ্লাভস ও মুখে মাস্ক না পরে বর্জ্য ঘেঁটে প্লাস্টিকের বোতল, ব্যবহৃত কাগজ আলাদা করছেন তিনি।
রোগ-জীবাণু থেকে বাঁচার জন্য কোনো ধরনের প্রতিরোধক ছাড়া কেন বর্জ্য ঘাঁটাঘাঁটি করছেন জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তো সব সময়ই এভাবে ময়লা নেই। আমাদের কখনো নিরাপত্তাসামগ্রী দেওয়া হয়নি। খালি হাতে ময়লা থেকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী খুঁজতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই হাত কেটে যায়। তবে আমরা জানি এভাবে কাজ করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু প্রতিদিন তো গ্লাভস কেনার সামর্থ্য নেই।'
আমরা খুবই নোংরা পরিবেশে বর্জ্য সংগ্রহ করি। সবাই আমাদের ময়লাওয়ালা বলে ডাকে। এটি শুনতে খারাপ লাগে। সিটি করপোরেশন শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি তদারকি করলে বেঁচে যেতাম।
আজিমপুরের বটতলা ও আশপাশের এলাকার বাসাবাড়ি থেকে চার বছর ধরে বর্জ্য সংগ্রহ করেন কামাল হোসেন। এ কাজ শুরু করার পর তিনিও কোনোদিন মাস্ক ও গ্লাভস পরেননি বলে জানান। কামাল হোসেন বলেন, ‘প্রথম প্রথম ময়লা ধরতে ঘৃণা লাগতো। কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। যদিও এটা ক্ষতিকর জানি। অনেক সময় পেট ব্যথা হয়। কিন্তু কী করবো, জীবন-জীবিকার তাগিদে তো কাজ করা লাগে।’
এই দুটি চিত্র যথাক্রমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। এর মধ্যে ডিএনসিসিতে ওয়ার্ড ৫৪টি। আর ডিএসসিসিতে ৭৫টি। প্রতিটি ওয়ার্ডে গড়ে ১৫ জন কর্মী রয়েছেন, যারা বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত ও রেস্তোরাঁ থেকে নিয়মিত বর্জ্য সংগ্রহ করেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী নামেই তারা পরিচিত। দুই সিটির ১২৯টি ওয়ার্ডে মোট ১ হাজার ৯৩৫ জন কর্মী কাজ করেন। কিন্তু তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সিটি করপোরেশনের কোনো তদারকি নেই। আবার সিটি করপোরেশন অনুমোদিত যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করেন, তারা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখে না।
আরও পড়ুন
- কম কাজ-তীব্র গরমে নাজেহাল শ্রমহাটের শ্রমিকরা
- মে দিবসের সমাবেশেই সীমাবদ্ধ শ্রমিক লীগের কর্মসূচি
- দেশে ৪৩ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কাজ করছে ১০ লাখ শিশু
বর্জ্য সংগ্রহের কাজে যুক্ত শ্রমিকরা জানান, তাদের মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা করে বেতন দেওয়া হয়। এর বাইরে সারা মাস প্লাস্টিকের ব্যবহৃত বোতল বিক্রি করে আরও তিন-চার হাজার টাকা আয় হয়। এ টাকা দিয়েই তাদের সংসার চলে। এর মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা খরচ থাকে না। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সিটি করপোরেশনের তদারকি দাবি করেন তারা।
তবে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির দাবি, যেসব প্রতিষ্ঠানকে বর্জ্য সংগ্রহের কার্যাদেশ দেওয়া হয় তাতে অনেকগুলো শর্ত থাকে। সেখানে বাসাবাড়ি থেকে যারা সংগ্রহ করেন তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিও বলা হয়। তবে মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশন কতটা ভূমিকা রাখছে বা তদারকি করছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর দেয়নি কেউ।
ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে গুলশান-১, গুলশান-২, বনানী এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ১৯ নম্বর ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করেন ১৯ জন কর্মী। এর মধ্যে গুলশান-বনানী লেকের পাড় এলাকার বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করেন মোসাদ্দেক। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তার হাতে গ্লাভস ও মুখে মাস্ক পরতে দেখা যায়নি।
আলাপকালে মোসাদ্দেক বলেন, ‘বর্জ্য সংগ্রহের সময় অনেকেই বলে মাস্ক ও গ্লাভস পরতে। কিন্তু এগুলো কিনে দেবে কে। আর মাস্ক পরলে বর্জ্য সংগ্রহ করার সময় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তারপরও যদি সিটি করপোরেশন তা দিতো সবার উপকার হতো।’
এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তার ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু যারা তা সংগ্রহ করেন তারা সবাই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন। তারা কেউ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জামাদি ব্যবহার করেন না। বিষয়টি ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলামকে জানাবো। স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করারও আহ্বান জানাবো।’
ডিএনসিসির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের মণিপুরিপাড়ায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করতে দেখা যায়। সোমবার (৩০ এপ্রিল) মণিপুরিপাড়া ১ নম্বর ফটক এলাকা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে ভ্যানে করে ইন্দিরা রোডের এসটিএসে নিয়ে যাচ্ছিলেন ইরফান আলী। তিনি বলেন, ‘সবাই শ্রম অধিকার বা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে কথা বলে। আজ পর্যন্ত তো কাউকে সহযোগিতা করতে দেখলাম না। শ্রমিক দিবসেও আমাদের কাজ করতে হয়। বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য না আনলে বাড়িওয়ালারা গালাগালি করে।’
দক্ষিণ সিটির পুরানা পল্টন এলাকা থেকে ভ্যানে করে বর্জ্য সংগ্রহ করেন জামাল। পরে মুক্তাঙ্গনে এসটিএসে নিয়ে ময়লা ফেলেন। দেখা যায়, এসটিএসের ভেতর ময়লা ফেলে সেখান থেকে প্লাস্টিকের বোতল, লোহা ও কাচের তৈরি সামগ্রী, ইলেকট্রনিকসের বাতিল সামগ্রী, মোবাইল ফোনের চার্জার, পলিথিন আলাদা করে বস্তায় রাখছেন। তার মতো অন্য এলাকা থেকে যারা বর্জ্য আনছেন তাদেরও একই কাজ করতে দেখা গেছে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল বলেন, ‘আমরা খুবই নোংরা পরিবেশে বর্জ্য সংগ্রহ করি। সবাই আমাদের ময়লাওয়ালা বলে ডাকে। এটি শুনতে খারাপ লাগে। সিটি করপোরেশন শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি তদারকি করলে বেঁচে যেতাম।’
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাছিম আহমেদ। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, যারা বর্জ্য সংগ্রহ করেন, তারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। বর্জ্য সংগ্রহকারীদের নিয়ে আগে বছরের বিভিন্ন সময় কর্মশালার আয়োজন করা হতো।
এছাড়া ময়লা সংগ্রহকারী সংগঠনগুলোকে কর্মীদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা করতে বলা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। যদিও বর্জ্য সংগ্রহ করার সময় গ্লাভস, মাস্ক, হাঁটু পর্যন্ত জুতা ব্যবহার করা দরকার। অন্যথায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে যায়।
এমএমএ/এএসএ/জিকেএস