মজুরিতে মার খাচ্ছে শ্রমিক

মফিজুল সাদিক
মফিজুল সাদিক মফিজুল সাদিক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৫৮ এএম, ০১ মে ২০২৪
জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

মেহেরপুরের গাংনীর নওপাড়া গ্রামের মো. শামসুল হক। অটোভ্যান চালিয়ে দৈনিক আয় করেন ৫-৬শ টাকা। এই আয় দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। শামসুল বলেন, ‘যেভাবে জিনিসের দাম বাড়তি আয়-ইনকাম তো সেভাবে বাড়ে না।’

রাজবাড়ী সদরের কলোনিপাড়া এলাকার বাসিন্দা বাহারুল ইসলামের অবস্থাও প্রায় একই। মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকায় রিকশার গ্যারেজে থাকেন। বাড়িতে দুই মেয়ে ও স্ত্রী। দৈনিক ১৩০ টাকা রিকশার জমা, ১২০ টাকা দুই বেলার খাওয়ার খরচ ও পকেট খরচ বাদ দিলে বাড়িতে পাঠানোর মতো বেশি টাকা থাকে না। সীমিত আয় দিয়ে সংসারের ব্যয় মিটছে না জানিয়ে বাহারুল বলেন, ‘খুব কষ্টে জীবন যায়। যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে সেভাবে আয় বাড়ে না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে টানাটানির মধ্যে চলি।’

মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছেন শ্রমিকরা। বিগত দুই বছরে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে, তবে তা মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় কম। ২৬ মাস ধরেই মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে মজুরি কম।

মজুরিতে মার খাচ্ছে শ্রমিক

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে নিম্ন ও অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। কিন্তু মার্চে ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) বেড়েছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। অর্থাৎ, মূল্যসূচক বৃদ্ধির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ০১ শতাংশ কম।

বিবিএসের মজুরি হার সূচকে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ৪৪টি অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মজুরি বিবেচনা করা হয়, যারা দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পান। ভোক্তা মূল্যসূচক গত অর্থবছর ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ০২ শতাংশে পৌঁছায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বৃদ্ধির এ প্রবণতা অব্যাহত আছে। তবে যেভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সেভাবে বাড়ছে না মজুরি।

দুই বছর ধরে দেখা যাচ্ছে যে হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সেভাবে আয় বা মজুরি বাড়ছে না। বিবিএস প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, একজন শ্রমিক গড়ে মাসে ১৩ হাজার টাকা আয় করেন। ১৩ হাজার টাকা দিয়ে দুজনের পরিবার চলা মুশকিল।- ড. জাহিদ হোসেন

নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেন মো. শহিদুল। প্রায় দুই বছর পর গত রমজানে ৫০ টাকা মজুরি বেড়েছে তার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘৪শ টাকা মজুরিতে শ্রমিকের সহকারী হিসেবে কাজ করি। ব্যাপক খাটুনি হয়। এই টাকা দিয়ে সংসার চলে না। প্রায় দুই বছর পর ৫০ টাকা মজুরি বেড়েছে। জিনিসপত্রের যে দাম তাতে এই টাকা দিয়ে কিছুই হয় না।’

শ্রমিকরা আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে দাবি করে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুই বছর ধরে দেখা যাচ্ছে যে হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সেভাবে আয় বা মজুরি বাড়ছে না। বিবিএস প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, একজন শ্রমিক গড়ে মাসে ১৩ হাজার টাকা আয় করেন। ১৩ হাজার টাকা দিয়ে দুজনের পরিবার চলা মুশকিল।’

‘শ্রমিকদের কাজ আছে, বেকারত্বের হার কম। তবে এ কাজ দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল। যে কাজ করেন সে কাজে কিন্তু আয় খুবই কম। এছাড়া যে কর্মক্ষেত্রে কাজ করেন সেখানে অনুকূল পরিবেশও পাচ্ছেন না। শ্রমিকদের যে পরিবেশ দরকার সেই পরিবেশ নেই। নিরাপত্তারও অনেক ঘাটতি। ফলে একদিকে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের বৈষম্য অন্যদিকে কাজের সঠিক পরিবেশের অভাব- এই দুই সংকটে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ।’

দেশে শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ
বর্তমানে দেশে মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৮ হাজার এবং নারী ২ কোটি ৫৯ লাখ ৩ হাজার। গত পাঁচ বছরে ৯৯ লাখ ১০ হাজার শ্রমিক বেড়েছে। তবে ১৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সী শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠী ৪ কোটি ৬৯ লাখ। দেশে গত পাঁচ বছরে বেকারের সংখ্যা কমে ২৬ লাখ ৩০ হাজারে নেমেছে, যেটি ২০১৬ সালের হিসাবে ছিল ২৭ লাখ। এসব ব্যক্তি সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ পায় না। এর মধ্যে বেকার পুরুষ ১৬ লাখ ৯০ হাজার আর বেকার নারী ৯ লাখ ৪০ হাজার।

দেশে গড় বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৩ দশমিক ৫৬ এবং নারী ৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তাছাড়া, দেশে এখন ৭ কোটি ৭ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি রয়েছেন। এর মধ্যে কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি, ৩ কোটি ২২ লাখ।

মজুরিতে মার খাচ্ছে শ্রমিক

বিবিএস জরিপে উঠে এসেছে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৪২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামে ৫০ দশমিক ৮৯ ও শহরে ২২ দশমিক ৫৯ শতাংশ নারী শ্রমশক্তি।

শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, কৃষিখাতে ৩২ দশমিক ২, শিল্পে ১২ দশমিক ০৫ ও সেবা খাতে ২৬ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী কাজে নিয়োজিত।

শিশুশ্রমিক ৩৫ লাখ ৪০ হাজার
সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিশুর (৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী) সংখ্যা ৩ কোটি ৯ লাখ ৯৬ হাজার। এদের মধ্যে শিশুশ্রমে নিয়োজিত ৩৫ লাখ ৪০ হাজার। দেশে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১০ লাখ ৭০ হাজার। প্রতিবেদনে দেখা যায়, শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেশি।

গ্রামীণ এলাকায় ২৭ লাখ ৩০ হাজার শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করে। শহর এলাকায় এ সংখ্যা ৮ লাখ ১০ হাজার। ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় বেশি শিশুকে কাজ করতে দেখা যায়।

প্রতিবেদনে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের জনসংখ্যার পরিসংখ্যান বিষয়ক তথ্য রয়েছে। এই বয়সের মোট শিশু ৩ কোটি ৯ লাখ ৯৬ হাজার। এদের ৫৫ দশমিক ২ শতাংশের বয়স ৫ থেকে ১১ বছর। দেশে ২ কোটি ৭ লাখ ৬৩ হাজার খানায় ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শ্রমজীবী শিশু রয়েছে। এ বয়সীদের স্কুলে উপস্থিতির হার ৩৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।

এমওএস/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।