‘দাবদাহ আমাদের দীর্ঘদিনের পরিবেশ দূষণের ফল’

রায়হান আহমেদ
রায়হান আহমেদ রায়হান আহমেদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:০৩ পিএম, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

দেশজুড়ে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। ভ্যাপসা গরমে জেরবার জনজীবন। চলমান তাপপ্রবাহের কারণ, বৈশ্বিক প্রভাব, প্রতিরোধে করণীয় প্রভৃতি বিষয়ে কথা বলেছেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রায়হান আহমেদ।

জাগো নিউজ: তীব্র তাপপ্রবাহের রেকর্ড বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতির জন্য আঞ্চলিক প্রভাবের পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রভাব কতটুকু দায়ী?

ড. আহমদ কামরুজ্জামান: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন দাবদাহ হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের দাবদাহের কারণ বিশ্লেষণ করলে আমরা কিছু কারণ পাই। বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির অত্যধিক ব্যবহার, হিমালয়ের বরফ গলা, নদ-নদীর সংখ্যা কমা- এসবের প্রভাব কিন্তু বাংলাদেশেও পড়ছে।

বৈশ্বিক কারণের চেয়ে আমি মনে করি স্থানীয় কারণটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শহরে যে জিনিসগুলো তাপমাত্রা ঠান্ডা রাখে সে জায়গায়গুলো আমরা দিন দিন নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছি। এটি আমাদের দীর্ঘদিনের পরিবেশ দূষণের ফল। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, সবুজ নিধন, জলাধার নিধনের কারণে আমাদের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকছে না। ফলে প্রতিবছর তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড হচ্ছে।

জাগো নিউজ: শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহারের কারণে আশপাশের মানুষ দুই থেকে তিন ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা বহন করছে। চলমান তাবপ্রবাহে এর প্রভাব কতটুকু? এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি না?

ড. আহমদ কামরুজ্জামান: বর্তমানে রাজধানীতে ৫০ লাখ ইউনিটের বেশি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালের ডাটা অনুযায়ী ধানমন্ডিতে এক লাখ ইউনিটের বেশি এসি ব্যবহার হচ্ছে। এসি থেকে নিঃসৃত তাপ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে শহরের তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়াতে সহায়তা করে। প্রতিবছর পাঁচ থেকে ছয় লাখ ইউনিট নতুন এসি শহরে সংযুক্ত হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে পুরো রাজধানীতে। যাদের এসি কেনার সামর্থ্য নেই তারা কিন্তু এই তাপমাত্রা ভোগ করছে।

আমাদের শহরের আয়তন অনুযায়ী ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সবুজ থাকার দরকার, আর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জলধর। অথচ আমাদের সবুজ ও জলধর আছে মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ

এসি তাপমাত্রা অনুভূত হওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। আমি মনে করি এক্ষেত্রে যারা এসি ব্যবহার করবে তাদের নির্দিষ্ট সংখ্যক গাছ লাগাতে হবে। না হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ওপর শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে।

জাগো নিউজ: তীব্র তাপপ্রবাহ প্রতিরোধে সবাই গাছপালার প্রধান ভূমিকার কথা বলেন। সবুজায়নের পাশাপাশি তাপপ্রবাহ রোধে অন্য কোনো উপায় আছে কি না?

ড. আহমদ কামরুজ্জামান: শহরে সবুজায়ন ও জলাধার তৈরি ছাড়াও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের আরও একটি ফ্যাক্টর রয়েছে। সেটি হলো আমাদের বায়ুপ্রবাহ সঠিকভাবে হতে হবে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে একটি বিল্ডিংয়ের সঙ্গে আরেকটি বিল্ডিং জোড়া লাগিয়ে তৈরি হচ্ছে। ফলে শহরের বাতাস চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে, যা কোনো এলাকাকে উত্তপ্ত করে দেয়। এই ফ্যাক্টরগুলো বন্ধ করতে হবে।

যেমন বিল্ড এরিয়া ও পিচঢালা রাস্তা। এটাকে হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট বলে। ঢাকার এই রাস্তা দিনের বেলা উত্তপ্ত হতে থাকে, যা রাতের প্রথমভাগ পর্যন্ত তাপ ধারণ করে। তারপর রাতে রাস্তা থেকে তাপমাত্রা নির্গমন হয়, তখন এটা নগরের তাপ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শুধু হিট আইল্যান্ড নয়, বর্তমানে কাচের তৈরি বিল্ডিং বাড়ছে। এই কাচগুলো প্রচুর তাপমাত্রা শোষণ করে পরে তা বাতাসে ছড়াচ্ছে।

এছাড়া এসি থেকে শুরু করে গাড়ির ইঞ্জিন, গ্যাসের চুলা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি- এগুলো তাপমাত্রা উৎপাদন করছে। এখন শহরে প্রতিদিন আড়াই কোটি মানুষের খাবার রান্না করতে গিয়ে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা করে চুলা জ্বলছে। আমি মনে করি কোনো এলাকার বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করতে এই ফ্যাক্টরগুলোর প্রভাব অনেক বেশি। এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, পাশাপাশি গাছ লাগাতে হবে।

জাগো নিউজ: রাজধানীতে জনসংখ্যা অনুযায়ী কতটুকু সবুজ প্রয়োজন?

ড. আহমদ কামরুজ্জামান: আমাদের শহরের আয়তন অনুযায়ী ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সবুজ থাকার দরকার, আর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ জলধর। অথচ আমাদের সবুজ ও জলধর আছে মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ। আমাদের শহরের আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যার আদর্শ সংখ্যা হওয়ার কথা ছিল ৫০ থেকে ৬০ লাখ। সেখানে আমরা চারগুণ অর্থাৎ পৌনে দুই কোটি মানুষ বসবাস করছি। এজন্য আমরা নগরের ভিতরে শুধু তাপমাত্রা নয়, বিভিন্ন প্রকার দূষণ, যানজট ও অন্য সমস্যার মধ্যে আছি।

দাবদাহ প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে উপকারী ফ্যাক্টর হলো সবুজায়ন। কারণ গাছপালা অধিক পরিমাণে অক্সিজেন তৈরি করে এবং এটি কার্বন-ডাই অক্সাইড ও তাপ শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। হিট ওয়েভ কমাতে আসলে গাছের বিকল্প নেই

জাগো নিউজ: পার্ক-মাঠ সংস্কারের নামে বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। গাছপালা নিধন করে অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। সবুজ নিধন নগরীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য কতটা দায়ী?

ড. আহমদ কামরুজ্জামান: শহরের জলধরগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। পার্ক-মাঠ ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে। চলমান মাঠ ও পার্কগুলো যেভাবে দখল হচ্ছে এতে সবুজের পাশাপাশি ওপেন স্পেস কমে যাচ্ছে। সিটি করপোরেশন বা রাজউক বা ওয়াসার উচিত উন্নয়ন প্রকল্প বা নকশা করার আগে গাছের কথা বিবেচনা করা। গাছপালা প্রকল্পে রেখেই নকশা করা সম্ভব। পার্ক সংস্কারে একান্ত যদি প্রয়োজন হয় বৃক্ষকে অন্যত্র স্থাপন করতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই বৃক্ষ নিধন করা যাবে না। রাজধানীতে চলমান যে তাপপ্রবাহ হচ্ছে, এটি কিছুটা সহনশীল থাকতো যদি নগরীর চাহিদা অনুযায়ী সবুজ থাকতো। এখনো সড়ক উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের কথা বলে গাছ কাটা হচ্ছে।

জাগো নিউজ: অধিক সবুজায়ন দাবদাহ প্রতিরোধে কতটা সক্ষম?

ড. আহমদ কামরুজ্জামান: দাবদাহ প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে উপকারী ফ্যাক্টর হলো সবুজায়ন। কারণ গাছপালা অধিক পরিমাণে অক্সিজেন তৈরি করে এবং এটি কার্বন-ডাই অক্সাইড ও তাপ শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। এই অক্সিজেন এলাকাকে শীতল করে। হিট ওয়েভ কমাতে আসলে গাছের বিকল্প নেই।

আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি যেখানে গাছের উপস্থিতি রয়েছে সেখানে তাপমাত্রা কম অনুভূত হয়। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের করা গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীর নয়টি স্থানে গাছ বেশি থাকায় তাপমাত্রাও কম ছিল। এছাড়া বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে গাছপালা না থাকায় অন্য জায়গার চেয়ে তাপমাত্রা বেশি ছিল ৩ থেকে ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি। এ থেকে বোঝা যায় তাপমাত্রা প্রতিরোধে গাছ কতটা উপকারী।

জাগো নিউজ: তীব্র তাপমাত্রা সামাল দিতে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কী ভূমিকা রাখতে পারে?

ড. আহমদ কামরুজ্জামান: এক্ষেত্রে সরকারের স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের অনেক ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে নগরীতে মানুষের দুর্ভোগ কমাতে হবে। আমাদের শহরে পর্যাপ্ত যাত্রী ছাউনির অভাব রয়েছে। জনবহুল ও বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে যাত্রী ছাউনি এবং ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

যেখানে চলাচল বেশি, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি গাছ লাগাতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও আবহাওয়া অধিদপ্তর মিলে একযোগে গবেষণা করে কাজ করা যেতে পারে। নিয়মিত পাবলিক অ্যালার্ট করতে হবে। আমি মনে করি দীর্ঘদিনের সমস্যা আমরা একদিনে বা রাতারাতি সমাধান করতে পারবো না। সে কারণে সংশ্লিষ্টদের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সমাজের সবাই মিলে সমন্বিতভাবে এ দুর্যোগ কমাতে হবে।

আরএএস/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।