তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় নেই কর্মপরিকল্পনা, ‘দুর্যোগ’ ঘোষণার দাবি
চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। প্রচণ্ড গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন। হিটস্ট্রোকে ঘটছে মৃত্যু। প্রতি বছর বেড়ে চলা এ তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় নেই সরকারের পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ।
তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে তারা তাপমাত্রা নির্ধারণ করে তাপপ্রবাহকে ‘দুর্যোগ’ ঘোষণারও দাবি জানান।
তারা বলেন, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেখা দিচ্ছে স্বাস্থ্যগত সমস্যা। তাই এটি মোকাবিলায় কর্মপরিকল্পনার আওতায় দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কাজ-কর্মের সময়ে পরিবর্তন আনাসহ কিছু কিছু ছোট উদ্যোগের মাধ্যমে তাপপ্রবাহের মধ্যেও কিছুটা সহনীয় রাখা যেতে পারে জীবনযাত্রা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কোনো বিস্তৃত এলাকাজুড়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি থাকলে মৃদু, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি থাকলে মাঝারি ও ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তীব্র এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে তাকে অতিতীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়।
দাবদাহের কারণে যদি কলেরা, অন্য কোনো মহামারি দেখা দেয়, জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সেক্ষেত্রে দুর্যোগ ঘোষণা হতে পারে। তাপমাত্রা ঠিক করে দিয়ে যে, এর বেশি হলে সেটা দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে। দুর্যোগ ঘোষণা করে কর্মকৌশল করা যেতে পারে।- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ
গত ২০ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল যশোরে। এটিই ছিল চলতি মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। ওইদিন দিনের তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৪ ও পাবনার ঈশ্বরদিতে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও তাতে জনজীবনে স্বস্তি আসেনি। ঈদের ছুটির পর গত ২১ এপ্রিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা থাকলেও তাপপ্রবাহের কারণে তা বন্ধ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ধরনের দাবদাহ স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। আমাদের শরীর যে তাপমাত্রায় স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে, এমন উচ্চ তাপমাত্রায় তা পারে না। নানা ধরনের শারীরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় অস্বাভাবিক হয়ে যায়। সরাসরি হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কারও জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আবার কারও কারও অন্য ধরনের অসুস্থতা ও সংক্রমণও হতে পারে। এটা (দাবদাহ) আমাদের জীবনযাত্রা ব্যাহত করছে তাতে সন্দেহ নেই।’
আরও পড়ুন
- হিট অ্যালার্ট আরও ৩ দিন, মে’র প্রথম সপ্তাহে বৃষ্টির আভাস
- রাজধানীর মহাখালী-গুলিস্তানে বেশি গরম
- হিটশকের ঝুঁকিতে বোরো ধান
- গরমজনিত অসুস্থতার চিকিৎসা নিতে এসেও গরমে অতিষ্ঠ রোগীরা
তিনি বলেন, ‘দাবদাহজনিত সমস্যা মোকাবিলায় একটা জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন করা দরকার। সেই কর্মকৌশলের একটি বিষয় থাকবে। এই যে পরিবর্তনগুলোর ফলে তাপ বাড়ছে, সেটাকে কীভাবে প্রশমিত করা যায়। গাছপালা লাগানো, বনায়ন, অনেক ছায়াবদ্ধ গাছ থাকলে তাপমাত্রা বাড়লেও মানুষের জীবনযাত্রা সহনীয় থাকবে।’
‘এছাড়া পানির আধার সংরক্ষণ করতে হবে। হাতিরঝিল ভালো উদাহরণ বলা যায়। ঢাকার চারপাশের জলাধারগুলো আমাদের সংরক্ষণ করা দরকার। এটা করলে দুটি লাভ- গ্রীষ্মকালে শহর পানিশূন্য হবে না এবং বর্ষাকালে পানিটা সহজে নেমে যেতে পারবে, শহর সাফার করবে না। এটা তাপমাত্রা সহনীয় রাখতে সহায়তা করবে। একটা কর্মকৌশল প্রণয়ন করে আমরা যদি সারাদেশের জন্য তা বাস্তবায়ন করি তাহলে হয়তো এটা (দাবদাহ) কিছুটা হলেও প্রতিহত করা যাবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক এ পরিচালক বলেন, ‘এর সঙ্গে জীবনযাত্রা মানানসই করতে হলে নানা উদ্যোগ নিতে হবে। স্কুলের সময়ে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এটা আগে থেকেই ছিল যে, গ্রীষ্মকালে হয় ছুটি দেওয়া হতো, না হয় সকালে স্কুল বসতো। এখন সূর্য অনেক আগে ওঠে, স্কুল সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত করা যেতে পারে। এতে শিশুদের তীব্র তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হতে হবে না।’
তিনি বলেন, ‘বাজারঘাট যাতে মানুষ রাতে করে সেই পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। রিকশাচালকসহ শ্রমজীবী মানুষ রাতে তাদের শ্রম দেবে, সেটা তাদের জন্য আরামদায়ক হবে। এ বিষয়গুলো কর্মপরিকল্পনায় থাকতে পারে।’
দাবদাহের সময় পানির চাহিদা তীব্র হয় জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘সরকার দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু উদ্যোগ নিতে পারে। ফুটপাতে বড় বড় ট্যাঙ্ক দিয়ে ট্যাপ লাগিয়ে দিলে মানুষ নিরাপদ পানি নেবে। মানুষের শরীরে যদি যথেষ্ট জলীয়বাষ্প থাকে তাহলে সে গরমে বেশি অসুস্থ হবে না। অনেক এলাকায় এখন পানি উঠছে না, সেখানে সরকারিভাবে পানির ব্যবস্থা করতে হবে।’
সবশেষ ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেকে বলছেন তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করার জন্য। এটা পলিসি লেভেলের সিদ্ধান্ত।- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান
বেনজির আহমেদ বলেন, ‘কর্মকৌশলের একটি লক্ষ্য থাকবে যাতে দাবদাহে কারও মৃত্যু না হয়। এতে সরকারেরও প্রশংসার জায়গা তৈরি হবে। এভাবে আমাদের চলতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দাবদাহের কারণে যদি কলেরা, অন্য কোনো মহামারি দেখা দেয়, জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, সেক্ষেত্রে দুর্যোগ ঘোষণা হতে পারে। তাপমাত্রা ঠিক করে দিতে হবে যে, এর বেশি হলে সেটা দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে। দুর্যোগ ঘোষণা করে কর্মকৌশল করা যেতে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ড. মো. জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দাবদাহের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। তাপ যাতে সহনীয় হয় সেই পদক্ষেপগুলোও নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রচুর গাছপালা লাগাতে হবে, জলাশয় রাখতে হবে। জলাধার নষ্ট করা যাবে না। সারা পৃথিবীতেই তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তো আছেই। দাবদাহ দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সার্বিকভাবে জনজীবন বিঘ্নিত হচ্ছে।’
‘আগে মানুষ একটা ছাতা নিয়ে ঘুরতো, সেটা বেশ বড় ছিল, রং ছিল কালো। কালো রঙটা এমনি এমনি ছিল না। কালো তাপ শোষণ করে নিচে ঠান্ডা রাখতো। এখন ছাতার রং রঙিন। এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।’
জিল্লুর রহমান আরও বলেন, ‘তাপমাত্রা প্রতি বছরই বাড়ছে, এজন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। আমরা আগের চেয়ে বেশি গরম অনুভব করি গ্রীষ্মকালে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছরই দেশে তাপপ্রবাহের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব বাড়ছে। এটাকে দুর্যোগ ঘোষণা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘হিটস্ট্রোক হচ্ছে, শিশুরা অ্যাফেক্টেড হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের আয়-উপার্জন কমে যাচ্ছে। তাপপ্রবাহের একটা নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির ওপরে পড়ছে।’
তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো উদ্যোগ আছে কি না জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সবশেষ ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেকে বলছেন তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করার জন্য। এটা পলিসি লেভেলের সিদ্ধান্ত।’
তিনি বলেন, ‘তবে এ সময়ে নিরাপত্তার জন্য যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া দরকার, সে বিষয়ে আমরা মানুষকে সচেতন করছি। ছায়ায় থাকা, পানি পান করা, বেশি রোদে হাঁটাহাঁটি না করা, খোলা শরীরে বাইরে না যাওয়া- এগুলো আমরা বলছি। এখন এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করাই মূল কাজ। সেটা আমরা যেভাবে পারছি করছি।’
সচিব আরও বলেন, ‘এখন আমাদের দুর্যোগের তালিকায় তাপপ্রবাহ নেই। বিষয়টিও সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে। আগে এগুলো এভাবে ছিলও না। গত শনিবার (২০ এপ্রিল) সৌদি আরবে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর আমাদের যশোরে ছিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সৌদি আরবের চেয়েও বাংলাদেশে তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।’
আপনারা নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণার প্রস্তাব উত্থাপন করবেন কি না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ সচিব বলেন, ‘দেখা যাক। যখন আমরা কথা বলবো তখন এ বিষয়টি উত্থাপন করবো।’
আরএমএম/এএসএ/এএসএম