ঈদ এলেই সন্তানের কথা মনে করে কাঁদেন বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা
ধনী-গরিব সবাই যখন ঈদ আনন্দে মশগুল সেসময়ও দূর নির্জন গ্রামে প্রিয়জন ছাড়া নিভৃতে বৃদ্ধাশ্রমে চোখের জল ফেলছেন একদল মানুষ। এ মানুষগুলোর মধ্যে অনেকেই আশায় ছিলেন এবার ঈদে অন্তত ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন কেউ না কেউ আসবে একটু খোঁজ নিতে। কিন্তু সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা ও রাত গড়ালেও ঈদের দুই দিন পরও কেউ খোঁজ নিতে আসেনি।
গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে ছোট সোহাগী গ্রাম। গ্রামটি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ী ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। এখানে ২০১৭ সালে স্বেচ্ছাশ্রমে গড়ে ওঠে মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রম। শুরু থেকেই মানুষের অনুদানে চলে আসছে এটি। বর্তমানে এখানে বাবা-মা আছেন ৪৫ জন। তাদের মধ্যে বৃদ্ধা রয়েছেন ২৬ জন, আর বৃদ্ধ ১৯ জন। অনেককে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে এখানে।
এ বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসরত মানুষগুলো কারো বাবা, কারো মা, কারো দাদ-দাদি, কারো নানা-নানি। নিঃসঙ্গ হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের চার দেওয়ালের আড়ালে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন অনেকেই।
অপরিচিতজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করলেও চরম অসহায়ত্ব আর একাকিত্ব কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে এসব মানুষদের। তবুও যেন বৃদ্ধাশ্রমই এ মানুষগুলোর কাছে শ্রেয়। চান না পরিবারে ফিরে গিয়ে কারো বোঝা হয়ে থাকতে। তাইতো শেষ বয়সে একটু নিশ্চিত মৃত্যুর আশায় আশ্রয় নিয়েছেন নির্জন এ বৃদ্ধাশ্রমে।
তবুও বছর ঘুরে ঈদ এলে প্রিয় সন্তানের স্মৃতি মনে হলেই সিক্ত হয় তাদের নয়ন। বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে সন্তাদের ভুলতে চেষ্টা করে প্রত্যেকেই ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেন নিজেদের মতো করে। সেবা আর চিকিৎসা দিয়ে অসহায় এ মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনাকারীরাও।
জবেদ আলী। বয়স একশর বেশি। একসময় তিনি কৃষিকাজ করতেন। সংসারে দুই ছেলে। পরিবার নিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কেটেছে তার। সন্তানদের বড় করে বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রীর নামে সামান্য জমি ছিল, সেটি দুই ছেলেকে লিখে দেন। এর মাঝে জবেদ আলী বয়সের ভারে অক্ষম হয়ে পড়েন। ছেলেরা তখন আলাদা হয়ে যায়। জীবনে শুরু হয় এক কঠিন অধ্যায়। সন্তানদের অবহেলা আর পুত্রবধূদের অত্যাচারে বাড়ি ছাড়তে হয় তাকে। স্ত্রীকে নিয়ে ভবঘুরে জীবন কাটিয়েছেন কিছুদিন। অবশেষে জবেদ আলীর ঠাঁই হয় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রমে। কিছুদিন পর স্ত্রীও তাকে একা রেখে চিরবিদায় নেন।
নিঃসঙ্গ হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের চার দেওয়ালের আড়ালে মুখ লুকিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন জবেদ আলী। স্মৃতিচারণ করে তিনি বললেন, তার বাড়ি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কালিডোবা গ্রামে।
জবেদ আলী বলেন, ছেলেরা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। পরে ভিক্ষা করে জীবন যাপন করেন। কিন্তু শেষ বয়সে আর চলাফেরা করতে পারেন না। অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে অবশেষে মেহেরুননেছা বৃদ্ধাশ্রমে আসেন। সাত বছর থেকে এখানেই আছেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে জবেদ আলী বলেন, ‘বেশ ভালোই আছি, নিজের সন্তানদের ছাড়াই ঈদ কাটালাম। এ কষ্ট কেউ অনুভব করতে পারবে না। এমন সন্তান যেন আর কারো না হয়। এটুকুই চাওয়া।’
বেশ কিছু ধরে বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন মজিরুন বেওয়া। বয়স প্রায় একশর কাছাকাছি। ১০ বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। তিন বছর আগে তার ঠাঁই হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রেম।
আবু তাহের (৭৫) ও লাইলী বেগম (৬২) দম্পতি আছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। ঘরে চার ছেলে-মেয়ে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। গত চার বছর থেকে বৃদ্ধাশ্রমে থাকলেও সন্তানরা তাদের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।
বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা জাহানারা বলেন, ‘এখানে থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই। ঈদের দিনে ভালো পোশাক আর খাবার দেওয়া হয়েছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবাও দেওয়া হয়।’
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আপেল মাহমুদ বলেন, এটি একটি স্বেচ্ছাশ্রমের প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা আছেন, তারা সবাই বৃদ্ধ মা-বাবা। আমরা তাদের সঙ্গে মা-বাবার মতো আচরণ করি। অনেকেই অসুস্থ আছেন। সময়মতো তাদের গোসল করাতে হয়। মাঝেমধ্যে অনেককে খাইয়ে দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও মানুষের অনুদানে চলে এটি। সমাজের বিত্তবানদের কাছে এই বৃদ্ধাশ্রমে সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
এফএ/এমএস