ভয়াবহ যানজটে নাকাল নগরবাসী, কোন পথে ঢাকা?
*** ঢাকার যানজটে জিডিপির ২.৯ শতাংশ ক্ষতি: বিআইডিএস
*** বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর এখন ঢাকা: গবেষণা
*** ঢাকার সড়কে প্রতি ২ ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট যায় যানজটে: সিপিডি
*** কর্মঘণ্টা নষ্ট, জ্বালানি অপচয়, সড়কের ক্ষতি ও দুর্ঘটনা বাড়ছে: বুয়েট
রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার বাসিন্দা আবদুল্লাহ মামুন বাড্ডায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত৷ প্রতিদিন অফিসে যেতে প্রথমে নিউমার্কেট থেকে বাসে ওঠেন। পরে তেজগাঁও সাতরাস্তার মোড়ে নেমে হেঁটে যান এফডিসি মোড় পর্যন্ত৷ সেখান থেকে রাস্তা পার হয়ে হাতিরঝিলের ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে যান বাড্ডা-গুলশান লিংক রোডের গুদারাঘাট৷ সেখান থেকে আবারও হেঁটে পৌঁছান অফিসে৷
দিনের পর দিন মাসের পর মাস এভাবেই অফিসে যাতায়াত করেন আবদুল্লাহ মামুন। তার এভাবে যাতায়াতের একটাই কারণ- যানজট এড়িয়ে কম সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছানো৷ এতে অবশ্য প্রতিদিনই বাড়তি অর্থ খরচ হয়। কিন্তু তাতেও আফসোস নেই তার৷
মামুন জাগো নিউজকে বলেন, গাড়িতে (বাসে) গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকতে হয়৷ আমি এভাবেই যাওয়া-আসা করি। খরচ কিছুটা বেশি হলেও দ্রুত যেতে পারি৷ যানবাহনের জ্যাম মাড়াতে ভালো লাগে না। গাড়িতে গেলে জ্যামে বসে থাকতে থাকতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাই৷
শুধু মামুনই নন, ঢাকায় বসবাস করা এমন লাখ লাখ কর্মজীবী আছেন যারা প্রতিদিন গন্তব্যে পৌঁছাতে ভিন্ন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। তাদের অনেকে যানজট এড়াতে বিকল্প পথ বা বাহন বেছে নেন। একটু সময় বাঁচানোর জন্য প্রতিদিনের যাতায়াতে বাড়তি টাকা খরচ করেন।
একটি শহরের রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত সেই শহরের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ, অর্থাৎ চার ভাগের এক ভাগ। অথচ ঢাকায় মোট রাস্তার পরিমাণ আয়তনের মাত্র ৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিকল্পিত ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ৮ শতাংশ রাস্তা দিয়েও ঢাকার যানজট নিরসন করা সম্ভব। তারা মনে করেন, দক্ষ লোকবল দিয়ে যোগাযোগ খাত পরিচালনা না করাসহ নানাবিধ কারণে ঢাকার যানজটের এ করুণ অবস্থা
ঢাকার যানজটের এ চিত্র সারা বছরের। তবে তা আরও অসহনীয় হয়ে ওঠে যে কোনো উৎসব-পার্বণ ঘিরে। দুয়ারে যখন ঈদুল ফিতর কড়া নাড়ছে, এমন সময় রাজধানীর প্রতিটি সড়ক ও মোড়ে যানজটও বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ৷ তারপরও তাদের ছুটে চলা থেমে নেই। এসময়ে রাস্তায় সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে ঈদের কেনাকাটা করতে বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলে যাওয়া মানুষদের।
আরও পড়ুন
- রোজার প্রথম দিনেই তীব্র যানজটে নাকাল রাজধানীবাসী
- দু-চারদিনের মধ্যে ঢাকার যানজট কমে যাবে
- সড়কে ঝুঁকিপূর্ণ ১২২ স্পট, যানজট নজরদারিতে রাখবে ড্রোন
সেলিম মিয়া ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, যা বেতন পান তাতে পরিবার নিয়ে কোনোরকম চলে তার৷ প্রতিদিন কল্যাণপুর থেকে সদরঘাটে যাওয়া-আসা করতে হয় তাকে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, রাস্তায় প্রচুর যানজট৷ বাসে বসে থাকতে থাকতে খুব ক্লান্ত লাগে। বিরক্ত হয়ে যাই। কাজ শেষে বাসায় ফিরে পরিবারকে যে একটু সময় দেবো সেটা আর হয়ে ওঠে না৷ জ্যামেই পুরো সময় চলে যায়।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
সাধারণত একটি শহরের রাস্তার পরিমাণ হওয়া উচিত সেই শহরের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ, অর্থাৎ চার ভাগের এক ভাগ। অথচ ঢাকায় মোট রাস্তার পরিমাণ আয়তনের মাত্র ৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিকল্পিত ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ৮ শতাংশ রাস্তা দিয়েও ঢাকার যানজট নিরসন করা সম্ভব।
যোগাযোগ বিশেজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে ছোট ও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব গাড়ি সড়কের বেশিরভাগ জায়গা দখলে রাখছে। দক্ষ লোকবল দিয়ে যোগাযোগ খাত পরিচালনা না করাসহ নানাবিধ কারণে ঢাকার যানজটের এ করুণ অবস্থা৷ যে হারে যানজট বাড়ছে এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ৷ যানজটে আরও স্থবির হয়ে পড়বে পুরো ঢাকা শহর৷
জনবহুল এ শহরের যানজট নিরসনের লক্ষ্যে প্রকল্প হাতে নেওয়ার এক দশকেরও বেশি সময় পর গত বছরের (২০২৩ সাল) ২ সেপ্টেম্বর বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এ অংশে যান চলাচল শুরু হয়। বিদেশি বিনিয়োগে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় পরিবহন খাতে এটিই প্রথম প্রকল্প।
দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ২ শতাংশই বাস করে ঢাকায়৷, যা এ অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ। চীনের বৃহত্তম শহর সাংহাই, যেখানে দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশের বাস। প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধান শহরে বাস করে দেশটির জনসংখ্যার ২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে তা ৮ দশমিক ১ শতাংশ। ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস করে বাংলাদেশে এমন শহর আছে মাত্র পাঁচটি। চীনে এমন শহরের সংখ্যা ১০২টি, ভারতে ৫৪টি, ইন্দোনেশিয়ায় ১৪টি এবং পাকিস্তানে ১০টি
সম্পূর্ণ এক্সপ্রেসওয়ে অর্থাৎ তেজগাঁও থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত চলতি বছরের (২০২৪ সাল) জুনে চালুর লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। পুরো উড়ালসড়কে ৩১টি স্থান দিয়ে যানবাহন ওঠানামা (র্যাম্প) করার ব্যবস্থা থাকছে। কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশে ওঠা-নামার জন্য মোট ১৫টি র্যাম্প রয়েছে।
এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ তিন চাকার যান ও বাইসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্য যানবাহন ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিবেগে চলতে পারবে। মূল এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। র্যাম্পসহ এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
তবে এক্সপ্রেসওয়েতে ব্যক্তিগত যানবাহন তথা প্রাইভেটকার চলাচল বেশি হওয়ায় বাসের যাত্রীরা তেমন একটা সুফল পাচ্ছেন না৷ সরেজমিনে দেখা যাচ্ছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি নেই, তবে তার ঠিক নিচের সড়কে যানজটে আটকা পড়ে আছে শত শত গাড়ি৷
মেট্রোরেলে প্রতিদিন এখন অনেক মানুষের যাতায়াত
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর সরকারের আরেক মেগা প্রকল্প মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের উদ্বোধন হয়৷ ওইদিন সর্বপ্রথম মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ৷ পরদিন ২৯ ডিসেম্বর থেকে এ অংশটি সর্বসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর মেট্রোরেলের দ্বিতীয় ধাপের উদ্বোধন হয়৷ ওইদিন আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের উদ্বোধন হয়৷ জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) মেট্রোরেল নির্মাণ করছে এবং এ প্রকল্পে সহজ শর্তে ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিয়েছে।
মেট্রোরেল চালুর পর সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছেন মিরপুর এবং উত্তরার বাসিন্দারা৷ আগে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হতো, এখন সেই পথ খুব সহজে ও অল্প সময়ে পাড়ি দেওয়া যাচ্ছে। আধা ঘণ্টারও কম সময়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে পারছে মানুষ।
মিরপুর থেকে প্রতিদিন সচিবালয় এলাকায় যাতায়াত করেন জয়৷ তিনি জাগো নিউজকে বলেন, মেট্রো চালুর আগে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত আসতে দেড়-দুই এমনকি তিন ঘণ্টাও লেগে যেতো। এখন খুব সহজে অল্প সময়ে চলে আসতে পারি৷ মেট্রো আমাদের জীবন অনেক সহজ করে দিয়েছে৷
তবে উল্টো চিত্র রাজধানীর অন্য সড়কগুলোতে৷ সেসব সড়কে যানজটে নাকাল নগরবাসীকে এখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামেই কাটাতে হয়।
আরও পড়ুন
- যানজটে নাকাল ঢাকা, বাড়ছে শারীরিক-মানসিক ভোগান্তি
- ট্রাফিকে জনবল সংকট প্রকট, প্রক্সি দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ!
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, শুধু ঢাকার যানজটের কারণেই বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশে। অপরিকল্পিত নগর সম্প্রসারণের পরোক্ষ ক্ষতির হিসাব যুক্ত হলে এ ক্ষতি জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে নগরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপের বিষয়টিও উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ২ শতাংশই বাস করে ঢাকায়, যা এ অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ। চীনের বৃহত্তম শহর সাংহাই, যেখানে দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশের বাস। প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধান শহরে বাস করে দেশটির জনসংখ্যার ২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে তা ৮ দশমিক ১ শতাংশ।
২৫ বছর আগেও ঢাকায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিবেগ ছিল ২৫ কিলোমিটার, এখন সেটা কমতে কমতে ৩-৪ কিলোমিটারে নেমেছে৷ এটা কন্টিনিউয়াসলি নিচের দিকে যাচ্ছে৷ গুগল বলছে এটা শূন্যে নেমে যাবে৷ এর মধ্যে অনেক বিনিয়োগও হয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোনো সুরাহা হয়নি৷ উন্নয়ন যা হয়েছে তা খণ্ডিত৷ যারা উন্নয়ন বড় করে দেখছেন সিস্টেম সম্পর্কে তাদের ন্যূনতম ধারণা নেই৷ যানজট নিরসনে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান জরুরি
প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস করে বাংলাদেশে এমন শহর আছে মাত্র পাঁচটি। চীনে এমন শহরের সংখ্যা ১০২টি, ভারতে ৫৪টি, ইন্দোনেশিয়ায় ১৪টি এবং পাকিস্তানে ১০টি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর এখন ঢাকা। ১৫২টি দেশের এক হাজার ২০০টির বেশি শহরের যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণ করে এ চিত্র তুলে আনা হয়েছে। যান চলাচলে এ ধীরগতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা দেশের অর্থনীতিতেও।
তিন লাখের বেশি মানুষের বসবাস, এমন সব শহরে গাড়িতে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে কত সময় লাগছে, সেসব তথ্য গুগল ম্যাপ থেকে সংগ্রহ করে গবেষণায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সপ্তাহের বিভিন্ন দিন এবং দিনের বিভিন্ন সময়ে যাতায়াতের তথ্যও নেওয়া হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাস্তায় চলাচলের গতি ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়াতে পারলে দেশের জিডিপি বাড়বে ১০ শতাংশ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় বসবাসকারী জনগণকে সড়কে প্রতি দুই ঘণ্টায় যানজটে বসে কাটাতে হয় ৪৬ মিনিট। বছরে জনপ্রতি গড়ে ২৭৬ ঘণ্টা নষ্ট হয় যানজটের কবলে।
যানজটে জীবন থেকে হারিয়ে যায় অনেকটা সময়
রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি বুঝতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) ২০২০ সালের জুলাইয়ে একটি গবেষণা করে৷ যেখানে যানজটের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে৷ ওই গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার সড়কে গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার৷ অথচ একজন সুস্থ মানুষ হেঁটে ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারেন৷
এছাড়া ওই গবেষণায় যানজটের কারণে ক্ষতির দিক হিসেবে কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়া, অতিরিক্ত জ্বালানি অপচয়, পরিবেশের ক্ষতি, সড়কের কাঠামোগত ক্ষতি এবং দুর্ঘটনা - পাঁচটি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল৷ গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটির মতো ট্রিপ তৈরি হয়৷ এই দুই কোটি ট্রিপের মধ্যে বড় অংশ হলো অফিসগামী৷
যানজটের কারণে প্রতিদিন ঢাকার মানুষের ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে৷ জ্যামে বসে থেকে পরিবহনের অতিরিক্ত ৪০ শতাংশ জ্বালানি খরচ হচ্ছে৷ গাড়ি রাস্তায় জ্যামে আটকা থাকার সময় কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস পরিবেশ দূষিত করছে। ফলে অনেক মানুষ ফুসফুসজনিত রোগে ভুগছে৷ শুধু এ কারণেই প্রতিদিন ঢাকার মানুষকে অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করতে হচ্ছে৷ যার দৈনিক মোট মূল্য ৮ থেকে ৯ কোটি টাকা৷
এছাড়া যানজটে দীর্ঘ সময় গাড়ি আটকে থাকার কারণে সড়কের আয়ুষ্কাল ১৮-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাচ্ছে৷ এজন্য রাস্তা বারবার মেরামত করার প্রয়োজন হচ্ছে৷ এছাড়া যানজটের কারণে দুর্ঘটনাও বাড়ছে৷ কেননা গাড়ি দীর্ঘ সময় জ্যামে থাকার পর সিগন্যাল ছাড়লে চালকদের মধ্যে আগে ও দ্রুত যাওয়ার প্রবণতা থাকে। তখন পথচারীরা বেশি দুর্ঘটনার শিকার হন৷
গবেষণার তথ্য মতে, ঢাকায় দুর্ঘটনার শিকার ৬০ শতাংশই পথচারী৷ সব মিলিয়ে যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, যা বছরে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো৷ ২০১৭ সালেও এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার কোটি টাকা৷
বুয়েটের ওই গবেষক দলের নেতৃত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানটির এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তৎকালীন পরিচালক প্রফেসর ড. মো. হাদিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, রাজধানীতে পলিসি সাপোর্ট লাগবে৷ শুধু অবকাঠামো তৈরি করে ঢাকার যানজট নিরসন করা সম্ভব নয়৷ অবকাঠামো তৈরি করে যতটা না সড়কের সক্ষমতা বাড়ছে তার চেয়ে যানবাহনের সংখ্যা বেশি বাড়ছে৷
আরও পড়ুন
‘দিনে গড়ে ঢাকা শহরে ৫০টির বেশি ব্যক্তিগত গাড়ি এবং এক হাজারটির বেশি মোটরসাইকেল বাড়ছে৷ অন্য যানবাহনও ঢাকার সড়কে নামছে৷ যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই৷ ফিটনেসবিহীন গাড়ি যানজট, বায়ুদূষণ ও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ৷ এ গাড়িগুলো সড়ক থেকে বের করে ফেলতে হবে৷’
এ অধ্যাপক আরও বলেন, মেট্রোরেল পুরোপুরি চালুর ফলে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করছে। সে হিসাবে আরও ৮৮ শতাংশ যাত্রী রয়ে গেছে। তাদের নিয়ে এখন চিন্তা করা দরকার৷ এখনই ঢাকার ৪০ শতাংশ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করে৷ গণপরিবহনের গুণগত মান ভালো এবং চাহিদার বিপরীতে জোগান নিশ্চিত করা গেলে ৫৫ শতাংশ মানুষ তাতে চড়বে৷
ঢাকা থেকে রাজধানী বা প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ড. হাদিউজ্জামান বলেন, এমন অনেক অফিস আছে যেগুলো ঢাকায় থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই৷ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণটা খুব জরুরি৷ এভাবে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ কমিয়ে আনতে পারলে যানজট কিছুটা কমানো সম্ভব হবে৷
তবে পরিবহন সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোতে পেশাদার লোকবল না থাকার কারণে যানজটের এ সংকট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক।
ব্যক্তিগত গাড়ি ও প্রাইভেটকার যানজটের বড় কারণ
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পেশাদার লোকবল খুব প্রয়োজন। অথচ এ খাত অপেশাদার লোকে ছেয়ে গেছে। যারা সমস্যা তৈরি করতে পারে, কিন্তু সমাধান করার সক্ষমতা তাদের নেই এবং পেশাদারত্বও নেই৷ ফলে সমস্যাটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না৷ সর্বত্র এটিই প্রচলিত যে, যাকে যেখানে বসানো হয় তার ওপর কিছু অর্পিত দায়িত্বও থাকে। কিন্তু সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কখনো অজুহাত দিতে পারেন না যে, তার পর্যাপ্ত লোকবল নেই, সে কারণে তিনি পারছেন না৷ যদি তা-ই হয় তবে তো ওই ব্যক্তির দায়িত্বে থাকারই দরকার নেই৷ সড়ক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যত প্রতিষ্ঠান আছে কোনোটিতেই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখা লোকবল নেই৷ সেসব জায়গার অজ্ঞতা, অক্ষমতা আর বিশৃঙ্খলার প্রতিফলনই আমরা রাস্তায় দেখতে পাই৷
তিনি বলেন, বিশ্বের অন্য সিটিগুলোতে যখন হাইপ্রোফাইল মিটিং হয়, বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা যান, বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়- সেগুলো ম্যানেজ করার জন্য শহর আগে থেকে সাজিয়ে রাখা হয়৷ আমাদের দেশে সেটা কখনো হয় না৷
‘২৫ বছর আগেও ঢাকায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিবেগ ছিল ২৫ কিলোমিটার, এখন সেটা কমতে কমতে ৩-৪ কিলোমিটারে নেমেছে৷ এটা কন্টিনিউয়াসলি নিচের দিকে যাচ্ছে৷ গুগল বলছে এটা শূন্যে নেমে যাবে৷ এর মধ্যে অনেক বিনিয়োগও হয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোনো সুরাহা হয়নি৷ উন্নয়ন যা হয়েছে তা খণ্ডিত৷ যারা উন্নয়ন বড় করে দেখছেন সিস্টেম সম্পর্কে তাদের ন্যূনতম ধারণা নেই৷ যানজট নিরসনে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান জরুরি’- বলেন বুয়েটের এ অধ্যাপক।
এনএস/এমকেআর/এসএইচএস/এমএস