চট্টগ্রামে এক্সপ্রেসওয়ে
শতবর্ষী গাছ কাটা নিয়ে ক্ষুব্ধ পরিবেশবাদীরা, ভিন্ন কথা দুই সংস্থার
* শতবর্ষী কোনো গাছ কাটা হবে না, বলছে সিডিএ
* ৪৬টি গাছ কাটার অনুমোদন দেওয়ার কথা জানালো বন বিভাগ
বাস্তবে প্রকল্পের কাজ শেষ না হলেও গত বছরের ১৪ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয়েছে চট্টগ্রাম এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের। উদ্বোধনের প্রায় পাঁচ মাস পর শুরু হতে যাচ্ছে কিছু র্যাম্প নির্মাণের কাজ। এর মধ্যে রয়েছে টাইগারপাস এলাকার র্যাম্প। এ র্যাম্প নির্মাণের জন্য কেটে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে শতবর্ষী কিছু গাছ। এ নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন পরিবেশকর্মী ও সচেতন মহল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে প্রতিবাদ। মাঠেও হয়েছে কর্মসূচি। তবে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এবং বন বিভাগ।
সিডিএ বলছে, শতবর্ষী কোনো গাছ কাটা হবে না। বন বিভাগ সব গাছে মার্কিং করায় ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বন বিভাগ বলছে, আমরা ৪৬টি শিশু গাছ কাটার অনুমতি দিয়েছি। ৪৬টি গাছ কাটার কথা বলে একশ গাছ কাটলে তার দায় বন বিভাগ নেবে না।
জানা যায়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) নির্মাণের জন্য নগরীর টাইগারপাস থেকে নিউমার্কেটমুখী সড়কের রেলওয়ে পাবলিক হাইস্কুল গেট পর্যন্ত সড়ক বিভাজকে থাকা গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেয় সিডিএ। ওই স্থানে গাছ কেটে র্যাম্প নির্মাণের জন্য এরই মধ্যে মাটি পরীক্ষা করা হয়েছে। নির্ধারিত গাছগুলোও মার্কিং (চিহ্নিত) করা হয়েছে।
এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নামবে এখানে
শতবর্ষী গাছ কাটার খবর চাউর হতে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে চট্টগ্রাম। পরিবেশবাদী থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মীসহ সচেতন লোকজন তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাছ কাটার বিরুদ্ধে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করছেন। প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালন করছে বিভিন্ন সংগঠন।
গণমাধ্যমকর্মী ও পরিবেশবাদী সংগঠক সরোয়ার আমিন বাবু জাগো নিউজকে বলেন, বন কেটে, গাছ কেটে আমরা উন্নয়ন চাই না। চট্টগ্রাম বিদ্বেষী একটি মহল টাইগারপাস সংলগ্ন সিআরবির শতবর্ষী গাছগুলো কাটার পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকরা, যারা সবুজবাদী, পরিবেশবাদী তারা এ গাছ কাটার সিদ্ধান্ত প্রতিহত করবো।
আরও পড়ুন
- বরিশালে ঝুঁকিপূর্ণ দেখিয়ে অর্ধশতবর্ষী ১২৯ গাছ কাটার পাঁয়তারা
- চোখের সামনেই পুড়ে মরছে শতবর্ষী গাছ, দেখার যেন কেউ নেই
সোমবার দুপুরে টাইগারপাস এলাকায় কথা হয় পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. ইদ্রিস আলীর সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, টাইগারপাস এলাকায় এক দুই থেকে শুরু করে পঞ্চাশ-একশ বছরের বৃক্ষ রয়েছে। এসব বৃক্ষ আমাদের অক্সিজেন দেয়, কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। গাছ মাটিকে সুরক্ষিত করে। ঝড়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে। এক প্রজন্মের ইতিহাস অন্য প্রজন্ম পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয় বৃক্ষ।
শত বছরের পুরোনো গাছ কেটে উন্নয়ন কোন প্রজন্মের জন্য? এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, যারা এসব পুরোনো গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা অত্যন্ত মুর্খতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা (সিডিএ) উন্নয়নের নাম দিয়ে ৬ কিলোমিটার পাহাড় কেটে রাস্তা বানিয়েছে। তাদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের আগামী প্রজন্ম বিপন্ন হবে। তাদের এ ভুল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে দেওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, এখানে ৪৬টি গাছ কাটার অনুমতি দিয়েছে বন বিভাগ। এসব গাছের সঙ্গে পরিবেশ সম্পর্কিত। এসব গাছ কাটার অনুমতি দেওয়ার দায়িত্ব তাদের (বন বিভাগ) কে দিয়েছে? আমরা পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে, নিজেদের রক্ষার তাগিদে চট্টগ্রামের সবাই মিলে গাছ কাটার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবো।
এ নিয়ে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ ক্ষোভ-বিক্ষোভে সরব হয়েছে। চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজের ব্যানারে সোমবার বিকেলে নগরীর টাইগারপাস মোড়ে শতবর্ষী গাছের নিচে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
টাইগারপাস, চট্টগ্রাম
সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, যদি র্যাম্প করতে হয় অনেক জায়গা আছে। এখানে গাছ কেটে কেন করতে হবে? এখানে কোনো গাছ কাট চলবে না। প্রকৃতি ঠিক রেখে যেকোনো উন্নয়ন করা সম্ভব। চট্টগ্রামের একমাত্র দ্বিতল সড়ক নষ্ট করে এবং এখানকার শতবর্ষী গাছ কেটে র্যাম্পের কোনো প্রয়োজন নেই।
তবে সিডিএ বলছে, র্যাম্প নির্মাণের জন্য শতবর্ষী কোনো গাছ কাটা হবে না। ৪০টি ছোট গাছ কাটা হবে। সেখানে লাগানো হবে নতুন ৬০০ গাছ। যদিও বাস্তবে দেখা গেছে, বেশ কিছু শতবর্ষী গাছ কাটার জন্য সাদা/লাল কালি দিয়ে মার্কিং করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
এ নিয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জাগো নিউজকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণের জন্য টাইগারপাস এলাকায় ৪০টির মতো গাছ কাটা হবে। সবগুলো ছোট গাছ। ওখানে শতবর্ষী কোনো গাছ নেই। তাছাড়া ৪০টি কাটা হলেও র্যাম্প নির্মাণের পর আরও ৬০০ গাছ লাগানো হবে। পুরো প্রকল্পটি পরিবেশবান্ধব করে তোলা হবে।
তিনি বলেন, আমরা ৪০টির মতো গাছ কাটবো। কিন্তু বন বিভাগ ওখানে সবগুলো গাছে মার্কিং করেছে। যে কারণে বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এ ভুল বোঝাবুঝি লাঘবে স্থপতি আশিক ইমরানের নেতৃত্বে সিডিএ’র একটি টিম মঙ্গলবার টাইগারপাস এলাকা পরিদর্শন করবে। সেখানে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমকে ব্রিফ করা হবে।
গাছ কাটার অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে বন বিভাগের চট্টগ্রাম উত্তর বিভাগীয় কর্মকর্তা এস এম কায়চার জাগো নিউজকে বলেন, সিডিএ’র আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪৬টি গাছ কটার অনুমতি দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াইফুট ব্যাসের গাছ রয়েছে। সবগুলো শিশু গাছ। শতবর্ষী কোনো গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এখন সিডিএ ৪৬টি গাছ কাটার অনুমতি নিয়ে যদি একশ গাছ কেটে ফেলে তার দায়ভার বন বিভাগ নেবে না।
তিনি বলেন, আমি মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে যাবো। পরিদর্শনে যদি মনে হয় তারা অনুমোদনের বেশি গাছ কাটার চেষ্টা করছে, বা পুরোনো গাছ কাটার চেষ্টা করছে, তাহলে আমরা পুরো অনুমোদনই বাতিল করে দেবো।
অন্যদিকে পলোগ্রাউন্ড উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন সড়ক থেকে দেওয়ানহাটমুখী র্যাম্প নির্মাণ করতে ১৪ শতক জায়গা ব্যবহারের জন্য রেলওয়ের অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছে সিডিএ। সেখানে কতগুলো গাছ কাটা হবে সে সংখ্যা ওই আবেদনে উল্লেখ করেনি সিডিএ।
এ নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চল) প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নামানোর জন্য সিডিএ আমাদের কাছে জমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে। এখনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তার আগে রেলের ডিআরএম (বিভাগীয় রেল ব্যবস্থাপক)-এর নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি র্যাম্পের জন্য নির্ধারিত জায়গাটি পরিদর্শন করবে। সেখানে কী পরিমাণ জমি আছে, কত গাছ আছে, গাছ কাটা হবে কি না, এসব বিষয় যাচাই করে কমিটি প্রতিবেদন দেবে। এরপর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিডিএ সূত্রে জানা যায়, নগরীর লালখান বাজার থেকে শুরু হয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংযোগ সড়ক পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মিত হচ্ছে। র্যাম্প ও লুপ মিলে উড়াল সড়কটির মোট দৈর্ঘ্য হবে ২০ কিলোমিটার। চার লেনের এ এক্সপ্রেসওয়ের প্রস্থ ৫৪ ফুট। ৯টি এলাকায় ২৪টি র্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) থাকবে। নগরীর টাইগারপাস মোড়ে চারটি, আগ্রাবাদ মোড়ে চারটি, বারিক বিল্ডিং মোড়ে দুটি, নিমতলী মোড়ে দুটি, কাস্টমস মোড়ে দুটি, সিইপিজেড মোড়ে চারটি, কর্ণফুলী ইপিজেডের সামনে দুটি, কাঠগড়ে দুটি এবং পতেঙ্গা সৈকত এলাকায় দুটি র্যাম্প থাকবে।
বিভিন্ন বয়সী গাছ আছে কাটার তালিকায়
চট্টগ্রামের মূল শহর থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাতায়াত নির্বিঘ্ন করা, শহরের যানজট কমিয়ে আনার পাশাপাশি যাত্রাপথের দূরত্ব কমাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ।
২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন হয়। যৌথভাবে প্রকল্পটির কাজ পায় বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ও চীনা প্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিন। প্রকল্পটির চুক্তি মূল্য ছিল তিন হাজার ৭২০ কোটি ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৭২৮ টাকা।
২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের পাইলিংয়ের উদ্বোধন করেন। সর্বশেষ সংশোধনীতে প্রকল্প ব্যয় ও সময় বাড়ানো হয়। সংশোধিত ব্যয় অনুযায়ী আরও ৬৪৯ কোটি দুই লাখ ৪৩ হাজার ৯১ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন দেয় সরকার। এতে ব্যয় বেড়ে এখন প্রকল্পের মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে চার হাজার ৩৬৯ কোটি সাত লাখ ১০ হাজার ৮১৯ টাকা। নতুন বর্ধিত সময় অনুসারে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে।
ইকবাল হোসেন/এমএইচআর/জিকেএস