শাহজালালে ডলার কারসাজি
ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
দেশে ফেরা প্রবাসী শ্রমিকদের কাছে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা অবৈধভাবে সংগ্রহ করে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচারের অভিযোগে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থিত চারটি ব্যাংক ও দুটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের ২১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বুধবার (২৭ মার্চ) দুদকের উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় ১৯ জন ব্যাংকার ও দু’জন মানি এক্সচেঞ্জের মালিককে আসামি করা হয়েছে।
মামলার আসামিরা হলেন- রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ও বুথ ইনচার্জ আনোয়ার পারভেজ, প্রিন্সিপাল অফিসার শামীম আহমেদ, মো. আশিকুজ্জামান, সিনিয়র অফিসার মো. সুরুজ জামাল, অমিত চন্দ্র দে, মো. মানিক মিয়া, সাদিক ইকবাল, মো. সুজন আলী, মো. সোহরাব উদ্দিন খান, মো. শরীফুল ইসলাম ও মো. হুমায়ুন কবির।
সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সবুজ মীর, খান আশিকুর রহমান, এবিএম সাজ্জাদ, অফিসার সামিউল ইসলাম, সাপোর্টিং স্টাফ মো. মোশারফ হোসেন। মিচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের অফিসার মো. আবু তারেক প্রধান ও অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মো. আব্দুর রাজ্জাক।
এছাড়া এভিয়া মানি এক্সচেঞ্জারের কাস্টমাস সার্ভিস ম্যানেজার মো. আসাদুল হোসেন ও ইম্পেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জের পরিচালক কে এম কবির আহমেদকে আসামি করা হয়েছে।
আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ধারা এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৪৭ এর ১৩(১) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরের অভিযান চালায় দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। সেখানে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে ভয়াবহ কারসাজির তথ্য পায় দুদক। কারসাজির হোতাদের চিহ্নিত করতে চার কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয় দুদক। সংস্থাটির উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বিমানবন্দরের ভেতরে থাকা সাতটি ব্যাংকের শাখায় কর্মরতদের তথ্য চেয়ে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) কাছে চিঠি দেয় দুদক। একইভাবে দুই মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের বিষয়েও তথ্য চাওয়া হয়। অপরাধীদের শনাক্ত করতে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছেও চাওয়া হয় সংশ্লিষ্ট ফুটেজ।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা প্রতিদিন যে শতকোটি টাকার বেশি মূল্যের ডলার ও বৈদেশিক মুদ্রা আনেন, তা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করছে চক্রটি। জাল ভাউচারে যাত্রীদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে পরে তা খোলাবাজারে ছাড়া হচ্ছে। লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যাংক ও নিবন্ধিত মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হয়েও তারা বেআইনিভাবে বিদেশি মুদ্রা কিনে ব্যক্তিগত লাভের জন্য খোলাবাজারে বিক্রি করছেন।
জানা যায়, প্রতিদিন হাজার হাজার প্রবাসী কর্মজীবী ও বিদেশ হতে বাংলাদেশে ভ্রমণকারী হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে বাংলাদেশে আসেন। তারা তাদের সঙ্গে আনা বিদেশি মুদ্রা বিমানবন্দরে থাকা ব্যাংকের বুথ ও মানি এক্সচেঞ্জারে দেশীয় মুদ্রা বা বাংলাদেশি টাকায় এনক্যাশমেন্ট করে থাকেন। আইনানুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট প্রদর্শন এবং ভাউচার বা এনক্যাশমেন্ট স্লিপ দেওয়া, লেজার-সিস্টেমে এন্ট্রি করে যথাযথভাবে হিসাব রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ব্যাংকের অধিকাংশ বুথ এবং মানি এক্সচেঞ্জ বুথে দায়িত্বরত অসাধু কর্মকর্তারা তা প্রতিপালন করছে না।
জানা যায়, এভিয়া মানি এক্সচেঞ্জারের কর্মকর্তা মো. আসাদুল হোসেন ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়ের জন্য ব্যাংকের বুথগুলো প্রতিদিন প্রতি শিফটের জন্য প্রায় ২০-৩০ লাখ টাকা রেখে যায়। ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারা ওই টাকা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করে নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে তা আসাদুলকে সরবরাহ করে। আসামি মোঃ আসাদুল হোসেন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিকট উক্ত পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে তা বিমানবন্দরের বাইরে কার্ব মার্কেটে বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নিকট উচ্চ দরে বিক্রি করেন।
আরও জানা যায়, ইম্পেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড বিদেশি পর্যটক এবং বিদেশ প্রত্যাগত বাংলাদেশী নাগরিকদের কাছ হতে বৈদেশিক মুদ্রা, নোট, কয়েন এবং ট্রাভেলারস চেক কেনার ক্ষেত্রে নির্ধারিত ছক মোতাবেক বিক্রেতাকে যথাযথভাবে নগদায়ন প্রত্যয়নপত্র প্রদান না করে ও বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের প্রমাণ স্বরূপ নগদায়ন প্রত্যয়ন পত্রের ভিত্তিতে বিক্রয় না করে এবং বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের বিস্তারিত বিবরণ সঠিক ও সম্পূর্ণভাবে হিসাব বইতে সংরক্ষণ ব্যতীত ভাউচারবিহীন এবং ভুয়া ভাউচার প্রদানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করতো। দুদকের অনুসন্ধানে ওই প্রতিষ্ঠানের ভাউচারগুলো নিয়ামনুযায়ী পাসপোর্ট নম্বর, নাম, জাতীয়তা, রিসিভারস সিগনেচার পূরণ করার বিধান এবং পাসপোর্ট নাম্বার বাধ্যতামূলকভাবে লেখার নিয়ম থাকলেও কোনোটায় পাসপোর্ট নম্বর নেই, কোনোটায় কর্তৃপক্ষের সই নেই, কোনোটায় রিসিভার সিগনেচার নেই।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, বিদেশি মুদ্রায় ক্রয়-বিক্রয়ে ও মানি লন্ডারিংয়ে জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান, যথা- এভিয়া মানি চেঞ্জার ও ইমপেরিয়াল মানি ইম্পেরিয়াল মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেড জড়িত থাকার বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। অপরাধে জড়িতরা অবৈধভাবে ক্রয় করা ডলার, ইউরো, রিয়াল, রিঙ্গিত, পাউন্ড, দিনার ও অন্যান্য বিদেশী মুদ্রা সংগ্রহ করে বিদেশি মুদ্রা পাচারকারী, বিদেশি মুদ্রার কালোবাজারি ও বাংলাদেশ থেকে বিদেশে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারকারী দুর্নীতিবাজদের অবৈধভাবে সরবরাহ করে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হয়ে দেশের রিজার্ভ ঘাটতি তৈরি করে অর্থনৈতিক কাঠামোকে ভঙ্গুর করছে। এভাবে রিজার্ভ সংকট তৈরির ফলে সরকার বিদেশ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ জরুরি পণ্যসামগ্রী আমদানি করার জন্য এলসি খুলতে না পারার কারণে দেশের বাজারে প্রতিনিয়ত অস্থিরতা বিরাজ করছে।
এসএম/এমএএইচ/এমএস