দেশে ফিরে খোলেন জুয়ার সাইট
চীনে পড়তে গিয়ে প্রতারকদের ফাঁদে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা
বাংলাদেশে ১০ থেকে ১২ হাজার চীনা নাগরিকের অবস্থান। তাদের অনেকে আছেন অবৈধভাবে। দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চীনের এই নাগরিকেরা সুযোগ বুঝেই পাতছেন নানা প্রতারণার ফাঁদ। বিশেষত, চীনে পড়তে যাওয়া বাংলাদেশি অনেক শিক্ষার্থী এ প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে বিপথগামী হচ্ছেন। এই শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হচ্ছে মূল অস্ত্র হিসেবে। বিভিন্ন অ্যাপস্ খুলে, জুয়ার সাইট চালিয়ে এবং অনলাইনে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের প্রলোভনে ফেলে তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
চীনে পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে প্রতারণায় জড়ানো তিন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে ৩০টি ভারতীয় সিমসহ গ্রেফতারের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।
গ্রেফতাররা হলেন- রাকিবুল ইসলাম রাতুল (২৪), আসাদুজ্জামান রাজু (২৯) ও মামুন হাওলাদার (২৭)।
গত ২ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগান থানায় এক ভুক্তভোগীর দায়ের করা মামলায় গোয়েন্দা কার্যক্রম ও তদন্তের ভিত্তিতে ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের (এডিসি) সাইফুর রহমান আজাদের নেতৃত্বে একটি দল ঢাকার বিমানবন্দর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এর আগে অ্যামাজন ডটকম (Amazon.com), দারাজ ডটকম ডটবিডি (Daraz.com.bd), ফ্লিপকার্ট ডটকম (Flipkart.com), পিকাবো ডটকম (Pickaboo.com) এর মতো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নামে ভুয়া সাইট খুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের দুই চীনা নাগরিকসহ ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
সেটির তদন্ত করতে গিয়ে নতুন করে এই চক্রের সন্ধান মেলে। গ্রেফতার তিনজন জানিয়েছেন, অনলাইনে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের লোভে ফেলে অ্যাপ খুলে জুয়ার সাইট চালিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রে জড়িয়েছিলেন তারা।
শনিবার (১৬ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যায়। তার মধ্যে অন্যতম বৃহৎ অংশ চায়নাতে মেডিকেল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য যায়। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ চায়নায় গিয়ে চাইনিজ ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠে এবং চাইনিজ বিভিন্ন প্রতারক চক্রের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার জন্য নিজেরাই চাইনিজদের সঙ্গে সংঘবদ্ধভাবে জড়িয়ে পড়ে। এসব চক্রের মূলহোতা চাইনিজরা।
অ্যাপ ও জুয়ার সাইট খুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চীনারা-
ডিবিপ্রধান বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় চাইনিজ প্রতারণার ফাঁদ রয়েছে। তারা তো ভালো বাংলা বা ইংরেজি বলতে পারেন না। তারা তখন চায়নায় পড়তে চাওয়া বাংলাদেশি চাইনিজ শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে। চাইনিজ ভাষায় পারদর্শী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দিয়ে বিভিন্ন প্রতারণার কাজটি করছে। অনলাইনে মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের লোভে ফেলে, অ্যাপ ও জুয়ার সাইট খুলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চাইনিজরা। কারণ প্রত্যেকটি প্রতারণার সাইটের অ্যাডমিন চীনে।
ভুয়া নামে বিকাশ ও নগদসহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
হারুন অর রশীদ বলেন, চাইনিজরা তাদের দেশেও এসব প্রতারণায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাজে লাগায়। আবার কিছু শিক্ষার্থীকে কিভাবে টাকা ইনকাম করা যায়, সখ্যতা গড়ে তুলে বিষয়টি মগজ ধোলাই করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। কিছু বাংলাদেশি বেনামি সিম তারা সংগ্রহ করে। সেসব দিয়ে বিকাশ ও নগদসহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে নেয়।
এসবের মূল পরিকল্পনাকারী হচ্ছে দুই চীনা নাগরিক গাগা (Gaga) এবং চিং চং (Chig Chog)। তারা প্রতারণার জন্য চায়নায় একটা সার্ভার স্থাপন করেছে। সেখান থেকে চিং চং বিকাশ, নগদসহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট প্রতারণা করে। এরপর কিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমে টাকা তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে।
গ্রেফতার রাতুল, রাজু ও মামুন সম্পর্কে ডিবিপ্রধান বলেন, গ্রেফতার রাতুল, রাজু, মামুন বাংলাদেশ থেকে পড়ালেখার উদ্দেশ্যে চীনে গিয়ে চাইনিজ ভাষা শিখে প্রতারক চক্রের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে এবং সবাই তথ্য-প্রযুক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে ওঠে। তাদের সম্পর্কের এক পর্যায়ে চাইনিজরা তাদের বলে যে তারা কিছু অ্যাপস তৈরি করেছে। অ্যাপস ব্যবহার করে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা সম্ভব।
তাদের সেই কার্যক্রমে কিছু বাংলাদেশি সিম, বিকাশ/নগদ অ্যাকাউন্ট, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের প্রয়োজন। সবাই মূলত স্বল্প সময়ে অবৈধভাবে অধিক উপার্জনের আশায় এই প্রতারণার কাজে যুক্ত হয়ে চাইনিজদের বাংলাদেশি সিম বিকাশ/নগদ অ্যাকাউন্ট ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সরবরাহ করে।
প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে কিছু মানুষকে প্রতারিত করতে সক্ষম হবার পরে, তারা এই কাজ অব্যাহত রাখে এবং স্বল্প সময়ে লাখ লাখ টাকা আয় করে।
প্রতারণার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, গ্রেফতার রাতুল, রাজু, মামুন অনলাইনে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং, অনলাইন ফিন্যান্সিং, বেটিং সাইট, সি-ফাইন্যান্স, লোন অ্যাপস ও হানিট্রাপেও সরাসরি জড়িত।
গ্রেফতার চীনা প্রতারক চক্রের হয়ে বাংলাদেশি অ্যাজেন্ট হিসেবে কাজ করে। এই চক্রে দেশি-বিদেশি আরও বিভিন্ন লোকজন জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য মিলেছে। চক্রটি মানুষকে অনলাইনে টাকা উপার্জনের কিংবা পার্ট-টাইম চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করতো।
প্রতারণার কাজে ভারতীয় সিম ব্যবহার
তারা সিম রেজিস্ট্রেশনকালে কৌশলে একাধিক ফিঙ্গার প্রিন্ট সংগ্রহ করে Mochicloner Apps এর মাধ্যমে একটি মোবাইল ফোনে ১০০টি বিকাশ অ্যাকাউন্ট অ্যাপস তৈরি করে। লালমনিরহাট, জামালপুর, সাভারসহ বিভিন্ন স্থানের প্রতিনিধিদের ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট সংগ্রহ পূর্বক সাভার ইপিজেডে চাইনিজ প্রতারকের মাধ্যমে মূল পরিকল্পনাকারী গাগা ও চিং চং নামক দুই চাইনিজের সঙ্গে বাংলাদেশি চাইনিজ ছাত্ররা মূল লিংক হিসেবে কাজ করে। প্রতারণার কাজে তারা ভারতীয় সিম ব্যবহার করে।
সিম কেনার সময় ফিঙ্গার প্রিন্টে যাচাই করুন
অনলাইন কেনাকাটা, অনলাইন প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন বলেন, অনলাইনে কাজের বিনিময়ে টাকা ইনকাম করার বিজ্ঞাপন দেখলেই বিনিয়োগ করা যাবে না। অবশ্যই যাচাই-বাচাই করা উচিত। কোনো সিম কেনার সময় ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অপরিচিত কারও সঙ্গে ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশন থেকে বিরত থাকতে হবে।
এ ধরনের কোনো প্রতারণার শিকার হলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন ডিবিপ্রধান।
টিটি/এমকেআর/জেআইএম