চট্টগ্রামের অগ্নিনিরাপত্তা
ফ্লাইওভারে আটকায় ল্যাডার, থেকেও অকার্যকর ফায়ার হাইড্রেন্ট
দুদিনের বেশি সময় ধরে জ্বলছে চট্টগ্রামের এস আলম সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মিলে লাগা আগুন। মিলের যে পাশে আগুন লেগেছে সেটি পাঁচতলা সমান উঁচু। অপরিশোধিত চিনি ও কেমিক্যালে ঠাসা। এত উঁচু ভবনের আগুন নেভাতে হলে পানি ছিটাতে হয় ওপর থেকে। কিন্তু এ ধরনের সক্ষমতা তাদের নেই বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তাদের কাছে থাকা বড় তিনটি ল্যাডার সরু রাস্তা ও ফ্লাইওভারের কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায় না। আর প্রায় দুইশ ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলেও পানির পর্যাপ্ত ফ্লো না থাকার কারণে ব্যবহার অযোগ্য।
এর আগে সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপো বিস্ফোরণেও ফায়ার সার্ভিসের এমন অসহায়ত্ব দেখা যায়। সামান্য অসাবধানতা থেকে জীবন হারান ১৩ জন ফায়ার ফাইটার। চট্টগ্রামের মতো বাণিজ্যিক রাজধানীর অগ্নিনিরাপত্তায় যে ধরনের ব্যবস্থা ফায়ার সার্ভিসের থাকার কথা ছিল তা নেই, যা আছে তা শহরের অপরিকল্পিত অবকাঠামোর কারণে ব্যবহার করতে পারছে না।
বহুতল ভবনের আগুন নির্বাপণ ও উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের একটি ২২ তলা, দুটি ১৭ তলা ও একটি ৭ তলা পর্যন্ত উদ্ধারকাজ চালাতে সক্ষম মই (ল্যাডার) রয়েছে। কিন্তু শহরের সরু রাস্তা, তার ওপর ফ্লাইওভারের কারণে অধিক উচ্চতার তিনটি ল্যাডারই কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
ওয়াসার সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে জুড়ে দিলেই তা ফায়ার হাইড্রেন্টে হয়ে যায় না। এজন্য আলাদা রিজার্ভার, পাম্প স্টেশন ও বুস্টার পাম্প থাকতে হয়, তাহলেই আগুন নির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় গতির পানি পাওয়া যায়। এসব সুবিধা না থাকায় ওয়াসার স্থাপিত ফায়ার হাইড্রেন্টেটগুলো ব্যবহার করতে পারছে না ফায়ার সার্ভিস।- চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এম আবদুল মালেক
এস আলম সুগার মিলের আগুন নির্বাপণে দুদিন ধরে কাজ করছেন চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুর্ঘটনাকবলিত গোডাউনটি প্রায় পাঁচ তলার সমান উচ্চতার। এটির পুরোটাজুড়েই চিনির কাঁচামাল মজুত আছে। শুধু নিচ থেকে আগুন নেভানো সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে ওপর থেকে পানি ছিটানোর বিকল্প নেই, কিন্তু সরঞ্জামের অভাবে আমরা করতে পারছি না।’
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের সাবেক উপ-পরিচালক মো. আবদুল হালিম বলেন, ‘চট্টগ্রামে বহুতল ভবনে দুর্ঘটনাকবলিতদের উদ্ধারের জন্য ৬৪ মিটার লম্বা যে ল্যাডার আছে তা প্রধান সড়কে চলতে গেলে চল্লিশ ফুট প্রশস্ত রাস্তা প্রয়োজন। শহরে তেমন রাস্তা নেই। এছাড়া শহরের প্রধান সড়কের পুরোটাজুড়েই ফ্লাইওভার। তাই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে এসব ল্যাডার নিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।’
সহকারী পরিচালক এম আবদুল মালেক বলেন, ‘বহুতল ভবনে আগুন নির্বাপণ ও উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য আমাদের যে ল্যাডারগুলো রয়েছে তা ব্যবহারের মতো প্রয়োজনীয় জায়গা নেই। এছাড়া শহরের সর্বত্র ইলেকট্রিক, ইন্টারনেট ও ডিশের তার ছড়ানো, তাই ল্যাডার নিয়ে কোথাও মুভ করা যায় না।’
আরও পড়ুন
- এস আলমের পোড়া চিনি ফেলা হচ্ছে কর্ণফুলীতে, মরছে মাছ
- চট্টগ্রামে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন-কারখানার তালিকা নেই কারও কাছে
- এস আলমের কারখানায় আগুনে পুড়লো এক লাখ টন চিনি
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, পুরো জেলায় এক হাজার ২৬ জনশক্তির বিপরীতে আছেন ৭৭৫ জন। কেমিক্যালের আগুন নেভানোর জন্য ফোম টেন্ডার রয়েছে মাত্র চারটি। এছাড়া উচ্চপ্রযুক্তির টার্নটেবল ল্যাডার (টিটিএল) ও স্নোরক্যালসহ আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও পর্যাপ্ত নয়।
প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘যানজট নিরসনে চট্টগ্রামে যে অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলো অপরিকল্পিত। ১৯৯৫ সালের মহাপরিকল্পনায় যেসব বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল, তার বিপরীত কাজগুলো হয়েছে। এই বন্দরনগরে যানবাহনের জন্য যে সড়ক ও ফ্লাইওভার তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ ঠিকভাবে হয়নি। এমনকি নির্মাণকাজের ব্যবস্থাপনাও ছিল না। যার ফল আমরা ভোগ করতে শুরু করেছি।’
কাজে আসছে না ১৭৪ ফায়ার হাইড্রেন্ট
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরে ৩০টি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করে। পরবর্তী ধাপে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-০২ এর অধীনে স্থাপন করা হয় আরও ১৪৪টি ফায়ার হাইড্রেন্ট। তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এগুলোর একটিও এখন পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম ওয়াসার স্থাপিত ফায়ার হাইড্রেন্টগুলোতে মূল কনসেপ্টই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আগুন নির্বাপণের জন্য যে গতির পানি প্রয়োজন, তা মিলছে না এসব ফায়ার হাইড্রেন্টে। এছাড়া ফায়ার হাইড্রেন্টের জন্য আলাদা রিজার্ভারসহ যেসব সুবিধা থাকার কথা এর কোনোটাই নেই।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এম আবদুল মালেক জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওয়াসার সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে জুড়ে দিলেই তা ফায়ার হাইড্রেন্টে হয়ে যায় না। এজন্য আলাদা রিজার্ভার, পাম্প স্টেশন ও বুস্টার পাম্প থাকতে হয়, তাহলেই আগুন নির্বাপণের জন্য প্রয়োজনীয় গতির পানি পাওয়া যায়। এসব সুবিধা না থাকায় ওয়াসার স্থাপিত ফায়ার হাইড্রেন্টেটগুলো ব্যবহার করতে পারছে না ফায়ার সার্ভিস।’
হাইড্রেন্ট স্থাপনের সময় ওয়াসা ফায়ার সার্ভিসকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছে। ট্রায়াল রানের পর প্রকল্পের কাজ শেষ করে হাইড্রেন্টগুলো ফায়ার সার্ভিসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। উন্নত বিশ্বে এটি প্রচলিত রয়েছে। আমরা সেই আদলে কাজ করেছি।- চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম
তিনি বলেন, ‘ওয়াসা সাধারণত রেশনিং পদ্ধতিতে পানি সরবরাহ করে। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের সময়-স্থান ঠিক থাকে না। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে সংঘটিত হতে পারে। যে এলাকায় অগ্নিকাণ্ড, সেখানে গিয়ে দেখা যায় লাইনে পানি নেই। ওই বিপদের মুহূর্তে পানির সরবরাহের জন্য ওয়াসা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে পানি পেতে দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে হয়।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘হাইড্রেন্ট স্থাপনের সময় ওয়াসা ফায়ার সার্ভিসকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছে। ট্রায়াল রানের পর প্রকল্পের কাজ শেষ করে হাইড্রেন্টগুলো ফায়ার সার্ভিসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। উন্নত বিশ্বে এটি প্রচলিত রয়েছে। আমরা সেই আদলে কাজ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘পানি সরবরাহ ও পর্যবেক্ষণসহ সবকিছুই এখন ডিজিটালাইজ করা হয়েছে। পানি সরবরাহ চালু রাখা মুহূর্তের ব্যাপার।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্থপতি জেরিনা হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে নাগরিক সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। এসব প্রতিষ্ঠান পেশাজীবীদের বক্তব্যও শুনতে চায় না। শহরে প্রকৌশলী আছেন, কিন্তু পরিকল্পনাবিদ নেই।’
এএজেড/এএসএ/এএসএম