বেইলি রোডে আগুন

‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বিবেচনা করা দরকার’

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৪৩ পিএম, ০২ মার্চ ২০২৪

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডকে ‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’ বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান।

শবিবার (২ মার্চ) বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর বাংলামোটরে বিআইপির সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন তিনি। ‘বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড এবং ভবনে জীবনের নিরাপত্তাঃ বিআইপির পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বিআইপি।

আরও পড়ুন

সংবাদ সম্মেলনে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার নিচের সারিতে অবস্থানের বিষয়টি বহুল আলোচিত। কিন্তু ঢাকায় যে পরিমাণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষকে বসবাস করতে হয়, বিশ্বের আর কোনো শহরে জীবনের এমন ঝুঁকি আছে কি না সেটা বিবেচনার দাবি রাখে। তিনি বলেন, নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বনানী এফআর টাওয়ার, মগবাজার, বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পর বেইলি রোডের ঘটনাটি ঢাকায় জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি আবার সবার সামনে নিয়ে আসলো। অথচ নগর পরিকল্পনা, ভবনের ডিজাইন, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা, ভবনের ব্যবহার, ভবনের অগ্নি প্রতিরক্ষা, ফায়ার ড্রিল, ভবন মালিকের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ এবং নগর সংস্থাসমূহের নিয়মিত তদারকি থাকলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। আর তাই এ ধরনের দুর্ঘটনা আসলে গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা না করলে এবং এই বিষয়ে যে সব ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, উদাসীনতা, দায়িত্বহীন ও অন্যায় আচরণ করেছেন তাদের যথাযথ আইনের আওতায় না আনলে পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।

আরও পড়ুন

আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজ নামের ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এর বেশির ভাগই ব্যবহার হয়েছে রেস্তোরাঁ হিসেবে; যা সুস্পষ্টভাবে ইমারত আইন ও নগর পরিকল্পনার ব্যত্যয়। ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ, একটি জুস বার (ফলের রস বিক্রির দোকান) ও একটি চা-কফি বিক্রির দোকান ছিল। ছিল মোবাইল ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম এবং পোশাক বিক্রির দোকানও। ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তার পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। ভবনের মালিকপক্ষের দায়িত্বহীনতা, ভবনে থাকা রেস্তোরাঁয় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে উদাসীনতার কারণেই অগ্নিকাণ্ডে এত প্রাণহানি হয়েছে। অথচ ভবনটিতে রেস্তোরাঁ করার কোনো অনুমতি ছিল না। তিনি বলেন, রাজউক কর্তৃক ভবনটির প্রথম থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক (শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে) এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম তলা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। ভবনটিতে রেস্তোরাঁ, শোরুম (বিক্রয়কেন্দ্র) বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কিন্তু ডেভেলপার কোম্পানি ভবন বুঝিয়ে দেওয়ার পর মালিকরা পুরো ভবনটি বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করছিলেন, যেখানে অনুমোদনহীনভাবে বেশিরভাগই ছিল রেস্টুরেন্ট। মালিকরা বেশি ভাড়ার জন্য এক কাজের জন্য অনুমতি নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করছিলেন। ভবন মালিকদের অতি মুনাফা লাভের প্রবৃত্তি এই আগুনের ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ।

‘কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বিবেচনা করা দরকার’

বেইলি রোডের ভবনটিতে কার্যকর কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা ছিল না জানিয়ে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এই দুর্ঘটনার আগে ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ভবন মালিক ও ভবনের ব্যবহারকারীরা। বিপরীতে বার বার নোটিশ দিয়েই দায় সেরেছে ফায়ার সার্ভিস। আগুন লাগার পর উত্তাপ আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় ভবনটির ওপরের তলাগুলো। চিকিৎসকদের ভাষ্যমতে যারা মারা গেছেন তাদের অনেকে কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিংয়ের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ একটি বদ্ধ ঘরে যখন বের হতে পারে না, তখন ধোঁয়াটা শ্বাসনালিতে চলে যায়। ভবনে জানালা না থাকা এবং পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন তথা বায়ুপ্রবাহের ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের শ্বাসরোধ হয়ে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ছিল শুধু একটিমাত্র সিঁড়ি। আর ভবনের একটি ফ্লোর ছাড়া সব ফ্লোরে অপরিকল্পিত উপায়ে এবং বিপজ্জনকভাবে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল।

আরও পড়ুন

বেইলি রোডের এই ঘটনাটি এমন সময়ে ঘটলো, যার অল্প কয়েকদিন আগেই চুড়িহাট্টার ঘটনার বর্ষপূর্তির দিন ছিল জানিয়ে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, চুড়িহাট্টার অগ্নি বিস্ফোরণ ঘটনার এতটা বছর পরেও কেন পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদামগুলো না সরানোর ব্যর্থতাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মানুষের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়গুলোতে যথাযথ গুরুত্ব দেবার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা কতটা উদাসীন। অথচ এই সময়ের মধ্যেই ঢাকায় মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভারসহ কত বড় বড় অবকাঠামোই আমরা নির্মাণ সম্পন্ন করে ফেলেছি, অথচ জীবন বাঁচানোর আয়োজনে যথাযথ ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে আমরা সম্মিলিতভাবে ব্যর্থ।

এমএমএ/এসএনআর/এমএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।