ফের বিদ্যুতের দাম বাড়ালে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৯ পিএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
অধ্যাপক এম শামসুল আলম

ফের বিদ্যুতের দাম বাড়ালে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় গঠিত কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম।

মার্চেই বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারে সরকার, এমন ঘোষণা দিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। আপনার মন্তব্য জানতে চাই।

অধ্যাপক এম শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়েছে অযৌক্তিক ও অন্যায়ভাবে ব্যয় বাড়িয়ে। সরকার যে পদ্ধতিতে ব্যয় করে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়িয়েছে, তাকে আপনি কোনোভাবেই উন্নয়নের সঙ্গে মেলাতে পারবেন না। কোনো সূচকেই আপনি উন্নয়ন বলতে পারেন না।’

অযৌক্তিক বলছেন কেন? বিদ্যুতের তীব্র চাহিদা ছিল, যা এখনো বিরাজমান। সরকার তো বোঝাতে চাইছে সার্বিক উন্নয়নে বিদ্যুতের উন্নয়নই বড় ভূমিকা রাখছে?

‘যে কোনো আর্থিক উন্নয়নে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক। কিন্তু সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছে ঠিক, লোডশেডিং কি বন্ধ করতে পেরেছে? বিদ্যুতের সংযোগ দিয়েছে, তাতে সঠিকভাবে সরবরাহ করতে পারছে?

বিদ্যুতের দাম বাড়লে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে, এটি স্বাভাবিক কথা। ফের বিদ্যুতর দাম বাড়ালে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। সব জিনিসের দাম বাড়ানো হয়েছে জ্বালানির দাম বাড়ানোর অজুহাতে। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ স্বল্প বা সীমিত আয়ের। পণ্যের দাম বাড়লে সবচেয়ে বিপদে পড়ে এই মানুষ।

উন্নয়নের নামে বিদ্যুৎখাতে লুণ্ঠন চলছে। একদিকে বিদ্যুৎ বাড়ানোর কথা বলে সংযোগ দিলেও তাতে সরবরাহ যথাযথ না থাকায় আর্থিকখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে লুটপাট হয়েছে। এ কারণে সরকারের কল্যাণমূলক কাজের সম্প্রসারণ হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারবেন না। সরকারের মৌলিক কাজ হচ্ছে জনকল্যাণ করা। জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা সরকারের দায়।’

এবার বাড়ালে তার প্রভাব নিয়ে কী বলবেন?

‘ভোক্তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বিদ্যুতে দামের যে ঘাটতির কথা সরকার বলছে, তা অযৌক্তিক ব্যয়ের কারণে। এর দায় ভোক্তাদের নয়। সঠিক উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলে ঘাটতি থাকার কথা ছিল না। সরকার ভোক্তাদের অভিযোগ আমলে নেয়নি। সরকার জনগণের জ্বালানির অধিকার খর্ব করছে বা অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত করছে।

আরও পড়ুন
‘বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে ব্যয় হচ্ছে তা অর্ধেকে করা সম্ভব ছিল’
‘গোষ্ঠীস্বার্থের ভূত চেপে বসার কারণেই বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না’
‘সাধারণ মানুষ অনিশ্চিত জীবনমান নিয়ে বেঁচে আছে’

বিদ্যুতের দাম বাড়লে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে, এটি স্বাভাবিক কথা। ফের বিদ্যুতর দাম বাড়ালে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। সব জিনিসের দাম বাড়ানো হয়েছে জ্বালানির দাম বাড়ানোর অজুহাতে। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ স্বল্প বা সীমিত আয়ের। পণ্যের দাম বাড়লে সবচেয়ে বিপদে পড়ে এই মানুষেরা। দাম বাড়লে মানুষ পণ্য কম কিনবে। তাতে বাজারে চাহিদা কমে যাবে। উৎপাদনও কমে যাবে। আল্টিমেটলি সরকারের রাজস্ব আহরণ কমে যাবে।

সরকার ভর্তুকি কমানোর জন্য জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করছে, অথচ এতে সরকারের রাজস্ব কমছে। ভোগব্যয় বাড়লে পণ্য কেনা থেকে মানুষ বঞ্চিত হলো, অপরদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হলো। রাজস্ব কমলে প্রবৃদ্ধি কমে যায়। বিনিয়োগ কমে যায়। গত কয়েক বছর ধরে আমরা তা দেখতে পাচ্ছি। ঘাটতি কমাতে সরকার টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে দেবে। তাতে ডলারের দাম আরও বাড়বে। এতে সরকার দ্বিগুণ সংকটে পড়বে। উন্নত দেশ ভোক্তার ভোগব্যয় কমিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে। আমার কাছে মনে হয়েছে যতটুকু ভর্তুকি সরকার তুলে নেবে, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজস্ব হারাবে।’

আইএমএফ বলেনি যে মূল্যবৃদ্ধি করে ঘাটতি সমন্বয় করতে হবে। তারা ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বলে সাধারণত। আইএমএফ-এর প্রেসক্রিপশন মূল্যবৃদ্ধি করার একটি অজুহাত। মূল্যবৃদ্ধি করতে করতে এক সময় দেখা যাবে, আমদানি করা বিদ্যুতের চেয়ে আমাদের বিদ্যুতের মূল্য বেশি।

রাজস্ব হারানোর এমন বিষয় সরকারের জানার কথা। তাহলে সরকার আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের চাপে মূল্যবৃদ্ধি করতে বাধ্য হয় কেন?

‘আইএমএফ বলেনি যে মূল্যবৃদ্ধি করে ঘাটতি সমন্বয় করতে হবে। তারা ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বলে সাধারণত। আইএমএফ-এর প্রেসক্রিপশন মূল্যবৃদ্ধি করার একটি অজুহাত। মূল্যবৃদ্ধি করতে করতে এক সময় দেখা যাবে, আমদানি করা বিদ্যুতের চেয়ে আমাদের বিদ্যুতের মূল্য বেশি। কয়লানির্ভর কেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ পাচ্ছি, আমদানি করা বিদ্যুতের দামের চেয়ে বেশি এখন। সরকার সম্ভবত বিদ্যুৎ আমদানির পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।’

এমন মূল্যবৃদ্ধি মানুষও মেনে নিচ্ছে…

‘একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার কথা। এমন সরকার সর্বশক্তি দিয়ে জনপ্রত্যাশা পূরণ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সরকার জনদায় বোঝে কি না বলা মুশকিল। সরকার জনস্বার্থ উপেক্ষা করে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করছে। সরকারি কোম্পানিগুলোও যেমন লুটপাট করছে, ব্যবসায়ীদেরও লুটপাটের সুযোগ করে দিচ্ছে। সরকার সবকিছুকেই করপোরেটাইজড করে ফেলছে, যেখানে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। জ্বালানিখাতকে ব্যবসার প্রধান বাহন বানিয়ে ফেলছে।’

এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় কী? করণীয় নিয়ে কী বলবেন?

‘সরকার খাদ্য নিরাপত্তায় বিশেষ সাফল্য দেখাতে পেরেছে বলে মনে করি। এজন্য সরকার অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সরকার একটি পলিসি বা দর্শন গ্রহণ করেছে। কৃষি বা খাদ্য সরকারের রাজস্ব আদায়ের খাত নয়। মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া সরকারের দায়। সরকার বছরের পর বছর ভর্তুকি দিয়ে আসছে। কৃষিতে ভর্তুকি দিয়ে স্বাবলম্বী করা হয়েছে।

একই পলিসি নিতে হবে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কৃষির মতো করেই জ্বালানিখাত গুরুত্ব দিতে হবে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেই এদেশে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হবে। দেশ উন্নত হবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই দেশ উন্নত হবে। টেকসই এবং লুণ্ঠনমুক্ত জ্বালানি সরবরাহ করতে পারলেই আমরা অপার সম্ভাবনার বাংলদেশের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পারবো।

এএসএস/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।