আশঙ্কা হারিয়ে যাওয়ার
শিক্ষাজীবনে কাজে আসে না ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা
দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষা শেখানোর দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। প্রথম পর্যায়ে ২০১৭ সালে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদরি এবং গারো ভাষায় শিক্ষাকার্যক্রম চালু করা হয়। তবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় সেই উদ্যোগও তেমন কোনো কাজে আসছে না। এসব অঞ্চল থেকে ঢাকায় উচ্চশিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের নিজস্ব মাতৃভাষার শিক্ষক না থাকায় তারা প্রাক-প্রাথমিকেও নিজস্ব ভাষার বই পড়তে পারছেন না।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় অনেকটা ধর্মীয়ভাবে নিজস্ব মাতৃভাষা শেখার সুযোগ পেলেও ঢাকায় বড় হওয়া শিশুরা এটুকু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ঢাকায় চাকরি করে পরিবারসহ বসবাস করছেন। তাদের সন্তানরা শুধু পরিবারের মধ্যে যতটুকু সম্ভব তটতুকু মাতৃভাষা শিখতে পারছে। এতে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা বলছেন, সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এসব ভাষা, সংস্কৃতি ক্রমেই বিলীন হয়ে যাবে।
রাজধানীর বনানী এলাকায় বসবাস করেন সরকারি চাকরিজীবী চপল চাকমা এবং তার স্ত্রী অবান্তিকা চাকমা। তাদের দুই সন্তান যশ এবং খ্যাতি দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। দুজনই পড়ছে রাজধানীর ফার্মগেটে অবস্থিত শান্তিরানী স্কুলে। তাদের দুই সন্তানই বাংলা ভাষায় লেখা বই পড়ে বড় হচ্ছে। তবে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে নিজ ভাষায় কথা বলে তারা। নিজেদের ঘরেই দুই শিশুসন্তানকে নিজস্ব ভাষা শেখাচ্ছেন এই দম্পতি।
আরও পড়ুন
• সাংবিধানিক স্বীকৃতি চান শেরপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ
• ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কী ভাবছি?
অবান্তিকা চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব ভাষা এবং বর্ণমালা রয়েছে। বাসায় সব সময় আমরা নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলি। গ্রামে প্রাথমিকে বাচ্চাদের মাতৃভাষা শেখানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা শহরে বসবাস করি আমাদের সন্তানরা এই সুযোগটা পাচ্ছে না। ঢাকায় অনেক আদিবাসীর বসবাস। তাদের সন্তানদের জন্য একটা পৃথক প্রতিষ্ঠান হলে ভালো হয়। তাহলে সেখানে আমাদের কমিউনিটির সন্তানদের পড়ালেখা করতে সুবিধা হয়। সরকারের সহযোগিতা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের মাতৃভাষা যতটা টিকিয়ে রেখেছি, সবটাই নিজেদের উদ্যোগে।’
শান্তিরানী স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিস্টার প্রমিলা কস্তা বলেন, ‘প্রত্যেকটি ভাষাই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের নিজস্ব মাতৃভাষায় অন্তত প্রাথমিকের পড়ালেখা করা উচিত। আমাদের স্কুলে কয়েকজন শিক্ষার্থী আছে তারা অন্যদের মতো বাংলা ভাষায় লেখা বই পড়ছে, সঙ্গে ইংরেজীও পড়ানো হয়।’
ফার্মগেটের মনিপুরীপাড়ায় বেশ সংখ্যক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবার বসবাস করে। তাদের সন্তানরা অনেক সময় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। মনিপুরীপাড়ায় অবস্থিত তেজগাঁও ফার্ম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মেরিনা সুলতানা জাগো নিজকে বলেন, ‘আমার স্কুলে গত কয়েক বছরে পাঁচ থেকে সাতজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করেছে। বর্তমানে দুই শিক্ষার্থী আছে। তারা বাংলা ভাষায় লেখা বই পড়ে। আলাদা কোনো নির্দেশনা আমরা পাইনি।’
আরও পড়ুন
• সর্বস্তরে বাংলা: হাইকোর্টের নির্দেশনার ১০ বছর, বাস্তবায়নের চেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন
• ভাষাসৈনিকদের নামে সড়ক: নামফলক জরাজীর্ণ, পোস্টারে ঢাকা জীবনী
রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের ইংরেজী বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সানসাইনু মারমা। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে ঢাকায় আসা পর্যন্ত সবখানেই বাংলা ভাষার বই পড়েছেন। তবে পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সময় মাতৃভাষায় কথা বলেন সানসাইনু।
নিজেদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কেটেছে বান্দরবানে। আমি বাংলা ভাষার বই পড়েছি। শুধু ঘরে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মারমা ভাষায় কথা বলি। এখন আমাদের অঞ্চলের স্কুলে বাংলা এবং নিজস্ব ভাষার বই আছে। কিন্তু অধিকাংশ নিজস্ব ভাষার বই পড়ার সুযোগ পায় না। কারণ ওই ভাষার শিক্ষক ওইসব স্কুলে নেই। প্রাথমিকে আমাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা দেওয়া উচিত। আমি শঙ্কিত আমার মাতৃভাষা নিয়ে, এটি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। আমি অধিকাংশ সময় বাংলায় কথা বলি, কিন্তু আমার মাতৃভাষাকে ভালবাসি।
ময়মনসিংহের দুর্গাপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় হয়েছেন জয়া নকরেক। ভারত সীমান্তের নিকটে অবস্থিত এই দুর্গাপুরের কালিকাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিকের শিক্ষা নিয়েছেন তিনি। জয়ার সম্প্রদায় গারো এবং নিজস্ব ভাষার নাম আতং। রাজধানীর হলিক্রস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা জয় এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আরও পড়ুন
• সর্বস্তরে হোক বাংলা ভাষার প্রচলন
• বাংলা ভাষার ভবিষ্যত : ভাবনা-দুর্ভাবনা
জয়া নকরেক জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমি পরিবার থেকে নিজস্ব মাতৃভাষা শিখেছি। আমাদের নিজস্ব ভাষার কোনো বই ছিল না। আমি স্কুলে বাংলা ভাষার বই পড়েছি। আমাদের ভাষায় শুধু আমরাই কথা বলি, এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। দিন দিন এমন হচ্ছে যে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি উদ্যোগ নিতো তাহলে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ধরে রাখা যেতো।’
তেজগাঁও মহিলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী উমগখিং মারমা। ছোটবেলা কেটেছে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার খক্ষ্যং হেডম্যান পাড়ায়। এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের এলাকায় মাতৃভাষার বই, কিন্তু শিক্ষক নেই। যার কারণে আমরা শিখতে পারিনি। মাতৃভাষা শিখেছি বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে। ওখানে ভ্রান্ত (ধর্মীয় গুরু) আছেন। উনি ভালোভাবে ভাষা শেখান। আমাদের কাছে আমাদের ভাষা জনপ্রিয়। কিন্তু আমরা প্রাথমিকে আমাদের ভাষার বই পড়তে পারিনি। শিক্ষাজীবনে আমাদের মাতৃভাষা কোনো কাজে লাগে না। আমরা আমাদের ভাষাকে ভালোবাসি। আমাদের ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৌমিত্র শেখর জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যেসব এলাকায় কমিউনিটি আছে সেসব এলাকায় একটা স্কুল পরিচালনা করা সহজ। যদি ফার্মগেটে ২০ জন গারো বা ৫০ জন চাকমা ভাষার শিক্ষার্থী থাকে তাদের জন্য স্কুল দেওয়া কঠিন। যদি এসব স্কুলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যায় তাহলে ভালো হয়। তাছাড়া আলাদা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা কঠিন একটা কাজ।’
আরও পড়ুন
• পার্বত্য চট্টগ্রাম: বড় সমস্যা বাঙালি-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব
• ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উন্নয়ন রয়ে গেছে অন্ধকারে
বাংলা ভাষা অনেকটা হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, ‘ইংলিশ ভার্সন চালু হওয়াতে বাংলার ওপর চাপ পড়ে গেছে। বাংলাও আসলে সংকটের মধ্যে রয়েছে। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা যেহেতু কম, তাদের ভাষাও সংকটের মধ্যে রয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে এমনটা হয়েছে, এটা আসলে বিশ্বায়নের একটা কুফল। বিশ্বায়নের ফলে ভাষা, সংস্কৃতি ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, এটা আসলে রক্ষা করা কঠিন৷
ভাষা সৈনিক আহমদ রফিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি শুনেছি অনেক সময় তারা নিজস্ব ভাষায় পড়ার জন্য আন্দোলন করে। আমরা যদি আমাদের ভাষা নিয়ে দাবি করতে পারি, আন্দোলন করতে পারি তাহলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের এই দাবি আমরা অস্বীকার করবো কেমন করে? তাদের চাহিদা এবং দাবিকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। ওরা যেহেতু সংখ্যায় কম এবং তাদের ভাষা প্রচলিত না, এজন্য তাদের ভাষাকে আমরা সরিয়ে দিতে পারি না।’
এনএস/ইএ/এএসএম