ডিএনসিসি-ডিএসসিসি
নিশ্চিত হয়নি বাংলায় সাইনবোর্ড-নামফলক ব্যবহার, নেই তদারকি
ভাষার মাস এলেই সামনে আসে মাতৃভাষা বাংলা চর্চার বিভিন্ন দিক। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিতে হাইকোর্টের আদেশও আছে। সে অনুযায়ী নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড ও ব্যানার বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এবার সে পদক্ষেপও নেয়নি। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড-নামফলক শুধু ইংরেজিতে লেখার প্রবণতা ফের বাড়ছে।
তবে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো প্রতিষ্ঠানকে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় বাংলায় নামফলক লেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ, ট্রেড লাইসেন্স করতে যে কয়েকটি শর্ত রয়েছে তার মধ্যে সাইনবোর্ড, নামফলকে প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় লিখতে হবে। এটি বাস্তবায়নে তারা বছরব্যাপী কাজ করছেন।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা। এ এলাকার প্রায় সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড ইংরেজি ও বাংলায় লেখা। তবে ইংরেজি বর্ণের ফন্টের তুলনায় বাংলা খুবই ছোট। ফলে রাস্তা থেকে খুব সহজে বাংলা লেখা তেমন কারও চোখে পড়ে না। আবার ওই এলাকাগুলোর অনেক শোরুমের নাম শুধুই ইংরেজিতে লেখা। কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম বিদেশি অন্য ভাষায় লেখাও দেখা যায়।
ডিএনসিসি এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ডে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও লিখছে। আর বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে শুধু ফেব্রুয়ারি নয়, সারা বছরই তদারকি করা হয়। ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে সাইনবোর্ডের অনুমোদন দেয় ডিএনসিসি। ব্যবসায়ীদের এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।- ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন
গুলশান-২ গোল চত্বরে বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ও ক্যামব্রিয়ান এডুকেশন গ্রুপের প্রধান কার্যালয়। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে বাংলা ব্যবহার করা হয়নি। নাম, ঠিকানা সবই ইংরেজিতে লেখা। অনেক দূর থেকেই তা দেখা যায়। তবে বাংলায় কেন সাইনবোর্ড লেখা হয়নি, এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কেউ কথা বলতে রাজি হননি। পরে বিএসবি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাশারের মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
আরও পড়ুন
নামফলক-সাইনবোর্ডে দেখা মিলছে বাংলা
সাইনবোর্ডে ‘বাংলা’ লেখার সময় বেঁধে দিলো রাসিক
সাইনবোর্ড বাংলায় না লেখায় ১০ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
বনানী-১১ নম্বর রোডে এপেক্সের বড় একটি শোরুম রয়েছে। কিন্তু এ শোরুমের সামনে ইংরেজি বর্ণে এপেক্স লেখা। কেন শোরুমের সামনে বাংলায় প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা নেই, তা জানতে চাইলে দোকানের কর্মীরা কথা বলতে রাজি হননি।
পুরান ঢাকার ওয়ারীর চণ্ডীচরণ বোস স্ট্রিট। এ স্ট্রিটের ফটকে বড় একটি সাইনবোর্ড টাঙানো। এটিতে ইংরেজিতে লেখা ‘বাংলাদেশ অক্সফোর্ড স্কুল’। ফটকের দুপাশে দুটি ফেস্টুনেও এই স্কুলের নাম ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। এ ফটকের পাশেই রয়েছে আরেকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে ইংরেজিতে লেখা ‘মি অ্যান্ড মম’। আবার ওয়ারীর রাইজ, স্টেপ, চা-হুয়ানামা, ওয়াইযাই থাইফুন নামে বিভিন্ন শোরুম-রেস্টুরেন্টে ইংরেজির পাশাপাশি ছোট করে বাংলায় প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা রয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অক্সফোর্ড স্কুলের চেয়ারম্যান আমির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকায় বাংলাদেশ অক্সফোর্ড স্কুলের তিনটি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে ওয়ারীর নারিন্দায় একটি ও বসুন্ধরায় আরেকটি। এই দুটি শাখার সাইবোর্ড বাংলায় লেখা। আর ওয়ারী শাখার সাইনবোর্ডটি অনেক আগের। তাই এটি ইংরেজি রয়ে গেছে।’ দ্রুত সময়ের মধ্যে তিনি সাইনবোর্ডে বাংলা লিখবেন বলে জানান।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্র জানায়, হাইকোর্ট বিভাগের ১৬৯৬/২০১৪ নম্বর রিট পিটিশনে দেওয়া আদেশ অনুযায়ী সব প্রতিষ্ঠানের (দূতাবাস, বিদেশি সংস্থা ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতীত) নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড ও ব্যানারে বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নির্দেশনা দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তাই বিগত বছরগুলোতে বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে টানা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে সংস্থা দুটি। এতে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান আইন মানতে বাধ্য হয়েছে।
এখন গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, ওয়ারীর ব্যাংক, বিমাসহ বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির নামফলকে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় প্রতিষ্ঠানের নাম লেখার প্রবণতা বাড়ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান শুধুই বাংলায় নামফলক লিখছে। তবে বিভিন্ন পণ্যের শোরুম, দোকানপাটে ইংরেজি লেখা নামফলক প্রাধান্য পাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বাংলায় নামফলক বা সাইনবোর্ড লাগাচ্ছেন কি না, তা তদারকি তেমন হয় না। বিগত বছরগুলো ফেব্রুয়ারি মাস শুরুর আগ থেকে নগরে সাইনবোর্ড, নামফলক বাংলায় লেখা নিশ্চিত করতে ধারাবাহিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হতো। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হতো। কিন্তু এবার ঢাকার দুই সিটির কোনো তৎপরতাই চোখে পড়েনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে জানান, বিগত বছরগুলোতে তারা বাংলায় নামফলক, সাইনবোর্ড ব্যবহার নিশ্চিত করতে অভিযান চালিয়েছেন। তবে চলতি বছর এখনো এ ধরনের অভিযান তারা শুরু করেননি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে অভিযান চালাবেন।
ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিএনসিসি এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ডে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও লিখছে। আর বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে শুধু ফেব্রুয়ারি নয়, সারা বছরই তদারকি করা হয়। বিশেষ করে ট্রেড লাইসেন্স করতে চাইলে এটিতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে সাইনবোর্ডের অনুমোদন দেয় ডিএনসিসি। ব্যবসায়ীদের এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, দফতরের নামফলক বাংলায় লেখার নির্দেশ দেন আদালত। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আদালত স্থানীয় সরকার বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। পরে ২০১৪ সালের ২৯ মে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় স্থানীয় সরকার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মাধ্যমে এটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়।
এমএমএ/এএসএ/এএসএম