মিয়ানমারে অস্থিরতা থাকলে বাংলাদেশে আরও অনুপ্রবেশ ঘটবে
গত সাড়ে ছয় বছর ধরে বাংলাদেশের জন্য অন্যতম সংকটের নাম রোহিঙ্গা। এ সংকট দীর্ঘতরই হচ্ছে। ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে নতুন করে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ভিটেমাটি ছেড়ে আসা এই বিশাল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের চোখে প্রশংসাই কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিষয়টি মানবিক হলেও বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের পক্ষে বছরের পর বছর ধরে তাদের ভরণ-পোষণ বেশ কঠিন।
এসময়ে বিদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্র ও দাতা সংস্থা সহায়তার হাত বাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে আশার কথা শোনানো হলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের এখনই উচিত সময়। আর এক্ষেত্রে ভারত ও চীনের সহায়তা নিতে পারে বাংলাদেশ।
মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সংঘাতমত পরিস্থিতি, বাংলাদেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সুযোগ-সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশের করণীয় ইস্যুতে জাগো নিউজ-এর কাছে মতামত ব্যক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি মনে করছেন, ভারত ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের সময় এসে গেছে।
এ বিশ্লেষকের মতে, মিয়ানমারে অস্থিরতা বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। মিয়ানমারে অস্থিরতা থাকলে বাংলাদেশে আরও অনুপ্রবেশও ঘটবে।
আরও পড়ুন>>
• মিয়ানমার থেকে আর কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না
• মিয়ানমার সংঘাতে সৃষ্ট উদ্বেগ জাতিসংঘকে জানাবে বাংলাদেশ
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মার কমিউনিটি এখন কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। যদিও এ বিভাজন এবারই প্রথম না। তবে এবার কয়েকটি মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। সিভিল এবং মিলাটারি উভয়ের মধ্যেই ভাঙন ধরেছে। অতীতে সিভিল ও মিলিটারির মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিল এবং এর ভিত্তিতেই অং সান সু চি নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও পার্লামেন্টে সামরিক বাহিনীর একধরনের দখলদারত্ব তখনো ছিল।
‘২০২০ সালের নির্বাচনে যখন অং সান সু চি বড় ব্যবধানে জয়ী হলেন, তখন সামরিক জান্তা বুঝে গেল যে তাদের ক্ষমতা খর্ব করা হতে পারে। নানা অজুহাতে সু চিকে সরিয়ে দিয়ে বন্দি করা হলো। তবে এর আগেও সু চিকে বন্দি করার ঘটনা বহুবার ঘটেছে। তখন সমঝোতা এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি সামলানো হয়েছে। এখন সে পরিস্থিতি নেই। সু চির দল এবং তার সমর্থকেরা এখন সশস্ত্র যুদ্ধ করে যাচ্ছে। কেন এমনটি করলো এবারে, বোঝা মুশকিল।’
মিয়ানমারে অস্থিরতা বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। মিয়ানমারে অস্থিরতা থাকলে বাংলাদেশে আরও অনুপ্রবেশও ঘটবে। মিয়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মার কমিউনিটি এখন কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। যদিও এ বিভাজন এবারই প্রথম না। সিভিল এবং মিলাটারি উভয়ের মধ্যেই ভাঙন ধরেছে। অতীতে সিভিল ও মিলিটারির মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিল এবং এর ভিত্তিতেই অং সান সু চি নির্বাচিত হয়েছিলেন
‘এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থন দিচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। এটি মিয়ানমারের রাজনীতির জন্য বড় ঘটনা বলে মনে করছি। মিলিটারির মধ্যেও যেমন বার্মার কমিউনিটি আছে, সিভিলদের মধ্যে যারা সশস্ত্র তাদের মধ্যেও আছে। এতে তিনটি ঘটনা ঘটছে।’
ঘটনাসমূহ ব্যাখ্যা করে ড. ইমতিয়াজ বলেন, প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্ট করেছে, যার মধ্যে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জড়িত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে। অ্যাক্টে বিভিন্ন পক্ষকে নানাভাবে সহায়তার কথা বলা আছে। আমেরিকা বার্মা অ্যাক্ট করার পর মিয়ানমারে সশস্ত্র আন্দালন আরও বেড়ে যায়।
‘দ্বিতীয়ত, শতাধিক অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেও বড় বড় ১০ থেকে ১২টি গোষ্ঠী স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সক্রিয় এখন, যারা অনবরত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। মিয়ানমার সরাসরি অন্য কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি। কিন্তু যখনই কোনো সমস্যায় পড়েছে তখনই সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মারা এক হয়ে কাজ করেছে। তা সামরিক বাহিনীর প্রশ্নেই হোক আর বৌদ্ধধর্মের প্রশ্নেই হোক। এবারে যেহেতু বার্মারা নানা ভাগে বিভাজিত, তাই সবাই একই সমাধান মেনে নিতে পারছে না।’
আরও পড়ুন>>
• তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ কমলেও কাটেনি আতঙ্ক
• মিয়ানমারের সংঘাতে প্রায় জনশূন্য নাইক্ষ্যংছড়ির ৭ গ্রাম
‘তৃতীয়ত, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাঙনে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে। তাদের যে স্বায়ত্তশাসন, তার পরিধি আরও বাড়িয়ে চলছে। তারা কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করছে না। নিজেদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতার বাড়ানোর জন্য লড়ছে। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ কমানোর প্রত্যাশা করছে।’
মিয়ানমারে চীনের প্রভাব প্রসঙ্গে এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, আমেরিকা যেহেতু সরাসরি যুক্ত হতে চাইছে, সঙ্গত কারণে চীন আর বসে থাকবে না। চীন আগে থেকেই বার্মা ইস্যুতে সম্পৃক্ত। বিশেষত, সান রাজ্যে ‘থ্রি ব্রাদার্স’ নামে যে অ্যালায়েন্স হয়েছে, তাতে চীনের বড় ধরনের সাহায্য রয়েছে। যেখানে আরাকান আর্মিও আছে। আরাকান আর্মির সাফল্য কিন্তু দৃশ্যমান এবং তারা বিশাল জায়গা দখল করে ফেলছে। যার প্রভাব বাংলাদেশে এসেও পড়েছে। তিশ শতাধিক আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য বাংলাদেশে ঢুকে পড়লো। যদিও আমরা খুব তাড়াতাড়ি তাদের ফেরত পাঠাতে পেরেছি।
মিয়ানমার পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে ড. ইমতিয়াজ বলেন, মিয়ানমারে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে করে এর আশেপাশের দেশগুলোর শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিশেষত, দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকা যেভাবে ঢুকে পড়েছে, তাতে চীন এবং ভারত উভয়েই চিন্তিত। মিয়ানমার ইস্যুতে চীন ও ভারত বরাবরই একই পদক্ষেপ নিয়েছে। জাতিসংঘে ভোটাভুটির ক্ষেত্রেও তা-ই দেখেছি।
মিয়ানমারে অস্থিরতা বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। মিয়ানমারে অস্থিরতা থাকলে বাংলাদেশে আরও অনুপ্রবেশও ঘটবে। মিয়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মার কমিউনিটি এখন কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। যদিও এ বিভাজন এবারই প্রথম না। সিভিল এবং মিলাটারি উভয়ের মধ্যেই ভাঙন ধরেছে। অতীতে সিভিল ও মিলিটারির মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিল এবং এর ভিত্তিতেই অং সান সু চি নির্বাচিত হয়েছিলেন
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, তৃতীয় কোনো দেশ এখানে ঢুকে পড়ুক তা চীন কিংবা ভারত কেউই চাইবে না। ভারত চাইবে তার উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর স্থিতিশীলতা। মিয়ানমারে সংঘর্ষ বাড়তে থাকলে এ অঞ্চলে অস্ত্রের আনাগোনা বেড়ে যাবে। তাতে স্বাভাবিকভাবে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোয় বিচ্ছন্নতাবাদীরা সুবিধা পেয়ে যাবে। ভারতে অস্থিরতা বাড়বে। চীনও চাইবে না আমেরিকার অস্ত্রতে এ অঞ্চলে অস্থিরতা বাড়ুক।
‘মিয়ানমার ইস্যুতে কাজ করার বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত এবং চীনকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় এসেছে। মিয়ানমারে অস্থিরতা থাকলে বাংলাদেশে আরও অনুপ্রবেশ ঘটবে। ভারতেও আশ্রয় নিয়েছিল এর আগে। চীনে একাধিকবার প্রবেশ করেছিল। এসব ঘটনা সবার জন্য চিন্তার।’
আরও পড়ুন>>
• বিজিপিসহ ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে হস্তান্তর
• মিয়ানমার সংঘাত গোটা অঞ্চলের জন্য হুমকি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
‘বাংলাদেশ, চীন, ভারত এবং মিয়ানমার মিলে একটি কাঠামো দাঁড় করানোর কথা ছিল। স্থিতিশীলতার জন্য এই কাঠামো খুবই জরুরি এখন’- মত দেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
দেশটিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থন দিচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। এটি মিয়ানমারের রাজনীতির জন্য বড় ঘটনা বলে মনে করছি। মিলিটারির মধ্যেও যেমন বার্মার কমিউনিটি আছে, সিভিলদের মধ্যে যারা সশস্ত্র তাদের মধ্যেও আছে। যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্ট করেছে। অ্যাক্টে বিভিন্ন পক্ষকে নানাভাবে সহায়তার কথা বলা আছে। আমেরিকা বার্মা অ্যাক্ট করার পর মিয়ানমারে সশস্ত্র আন্দালন আরও বেড়ে যায়
দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে বার্মাদের ভূমিকার ওপর। এরই মধ্যে গোষ্ঠীগুলো তাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে ফেলেছে। আলোচনা করা জরুরি। এ আলোচনায় চীনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি জরুরি। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর আওতাও অনেক বড়। চীন এবং ভারতকে সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার দরকার।
‘বাংলাদেশের বড় মাথাব্যথা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। সম্প্রতি পালিয়ে আসা মিয়ানমারের আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ফেরত পাঠিয়ে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য চীনও একটি কাঠামো তৈরি করেছে। আরাকান আর্মিদের সঙ্গে চীনের ভালো সম্পর্ক। সব স্টাডি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এগোতে পারে এখন। দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গেই এ নিয়ে আলোচনা করুক বাংলাদেশ। শান্তি ফিরুক গোটা অঞ্চলে’- বলেন অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ।
এএসএস/এমকেআর