সমস্যায় জর্জরিত ময়মনসিংহ, সমাধান কার হাতে?
• শহরে ১০টি রেলক্রসিং, দৈনিক ৪৭ ট্রেনের যাতায়াত
• নীতিমালা ছাড়াই হচ্ছে সুউচ্চ ভবন
পৃথিবীর অন্যতম ধীরগতির শহর ময়মনসিংহ। এ নগরের বড় সমস্যা যানজট ও জলাবদ্ধতা। এগুলোর সমাধানে নেওয়া হয়েছে প্রকল্প। সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নেও রয়েছে ধীরগতি। পরিবেশ দূষণ, অপরিকল্পিত সুউচ্চ ভবন নির্মাণসহ আছে আরও নানান সংকট। আসন্ন ৯ মার্চ সিটি করপোরেশনের ভোট ঘিরে এসব সমস্যার কথা বলছে নাগরিক সমাজ। তারা বলছেন, সমস্যা সংকুল এই সিটির জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে দ্রুত সমাধান করতে পারবেন, মেয়র পদে এমন একজনকে ‘সেবক’ রূপে চান তারা।
জানা গেছে, ৯ মার্চ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ভোট ঘিরে প্রস্তুতি চলছে জোরেসোরে। নির্বাচন কর্মকর্তারা কাটাচ্ছেন ব্যস্ত সময়। প্রার্থীরাও মাঠে বেশ সক্রিয়। এমন সময় নগরটি ঘুরে নানান সমস্যার চিত্র তুলে এনেছে জাগো নিউজ। এসব সমাধানে প্রার্থীদের পরিকল্পনাও জানতে চেয়েছে। নাগরিকদের পাশাপাশি প্রার্থীরাও এগুলোকে নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। সমাধানে বলেছেন নানান উদ্যোগের কথা।
এ নিয়ে ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি কাজী আজাদ জাহান শামীম জাগো নিউজকে বলেন, সিটি মেয়রকে নগরপিতা বলা হয়। আমি চাইবো, আমাদের প্রার্থীরা নগরপিতার অলঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসবেন। নিজেদের নগরের সেবক হিসেবে প্রমাণ করবেন। ছুটে যাবেন নগরবাসীর কাছে। নগরবাসীকে যেন মেয়রের পেছনে দৌড়াতে না হয়।
তিনি বলেন, ময়মনসিংহ পৃথিবীর অন্যতম ধীরগতির শহর। এখান থেকে কীভাবে বের হয়ে আসতে পারি সে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাস্তায় হাঁটারও জায়গা নেই। ফুটপাত দখলে থাকে। শহরে ১০টি রেলক্রসিং, দৈনিক ৪৭টি ট্রেন যাতায়াত করে। যানজটে ঢাকাকে হার মানিয়েছে। যানজটের এ শহরে আবার অপরিকল্পিতভাবে সুউচ্চ ভবন উঠছে যেগুলো কোনো নীতিমালা মানছে না। কেউ এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কেন পারছে না, সেটা নিয়েই মুখরোচক কথা শোনা যায়।
আরও পড়ুন>> কাচ্চি বিরিয়ানিতে মরা টিকটিকি
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের উন্নয়নকাজের জন্য ১৭শ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন, এর মধ্যে কর্তৃপক্ষ মাত্র ৩শ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে। এখানেও কাজে ধীরগতি, মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। যিনি মেয়র হবেন, তাকে এ জায়গায় জোর দিতে হবে। রাস্তার মান যেন ঠিক হয়। সবচেয়ে বড় বিষয়, রাস্তার যানজট কমাতে আমরা একটা প্রকল্প চাই- শহরের বাইপাস মোড় থেকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রেললাইন উঠিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পেছন দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেখান থেকে একটি লাইন ভৈরব লাইনে যুক্ত হবে। পুরোনো রেললাইনে ৩০০ ফুট প্রশস্ত একটি রাস্তা নির্মাণ করলে শহরের যানজট অনেকটা কমে যাবে।’
সামনে ভোটে ময়মনসিংহে কেমন মেয়র চান? এমন প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও নাগরিক আন্দোলনের পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক তুহিন তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, এমন মেয়র চাই যিনি এ শহরের নানান সমস্যা খুব দ্রুত সমাধান করবেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এ শহর সাজাবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যানজট। এ শহরে সার্বক্ষণিক যানজট লেগে থাকে। খুব স্বল্প সময়ে এ নিয়ে একটা কার্যকরী ব্যবস্থা নেবেন এমন মেয়র চাই। ময়মনসিংহ শহর ঘিরে ২০১১ সালে একটা প্ল্যান করা হয়েছিল, ‘ময়মনসিংহ স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান (এমএসডিপি।’ সেই প্ল্যান অনুসারে এ শহরকে একটি আইডিয়াল শহর হিসেবে গড়ে তোলার সমীক্ষা হয়েছিল। ওই আলোকে শহরকে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের রূপরেখা যিনি রচনা করতে পারবেন, এমন মেয়র চাই।
জানা গেছে, সিটি করপোরেশন ঘোষণার পর দ্বিতীয়বার ভোট হলেও মেয়র পদে ভোটে হচ্ছে প্রথম। গতবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তৎকালীন পৌর মেয়র ইকরামুল হক টিটু। এবার দলীয় প্রতীক না দিয়ে তাকে বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের পাঁচ এবং জাতীয় পার্টির একজন প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এবার।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাও নগরের সমস্যার বিষয়ে ওয়াকিবহাল। তারা নিজেরাও সমাধান চান। তবে যেই আসুক, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতেও সম্মত তারা।
আরও পড়ুন>> অন্যের এনআইডি দিয়ে টিকিট কেটে কালোবাজারি, বুকিং সহকারী গ্রেফতার
ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামূল আলম জাগো নিউজকে বলেন, সিটি করপোরেশন মানুষের ওপর করের বোঝা চাপিয়েছে, এটা একটা সমস্যা। যানজট প্রকট। স্কুলের ছেলে-মেয়েরা যানজটের কারণে সময় মতো স্কুলে যেতে পারে না। রোগী সময় মতো হাসপাতালে যেতে পারে না। ভিড়ের কারণে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, আহত হচ্ছে, এমনকি মারাও যাচ্ছে। দীর্ঘ ৭/৮ বছরে সমাধানে কেউ উদ্যোগ নেয়নি। শুধু হচ্ছে সুউচ্চ ভবন। নিয়ম মানছে কি না তদারক করার লোক নেই। বর্ষায় জলাবদ্ধতা প্রকট হয়, কেউ সমাধানে উদ্যোগ নেয়নি।
তিনি বলেন, আপনার বাসায় একটা সাবমারসিবল বসাতে চাইলে আপনাকে তিন হাজার টাকা দিয়ে প্রথমে ফরম কিনতে হবে। অনুমতি দিলে ৮-৯ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। এমনিতেই সাবমারসিবল বসাতে ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ লাগে। অতিরিক্ত যদি ২০ হাজার চলে যায়, সেটা শহরবাসীর ওপর চাপ।
ময়মনসিংহ শহর আওয়ামী লীগের সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাদেক খান মিল্কি টজু জাগো নিউজকে বলেন, অনেক সমস্যা। রাস্তাঘাটে ধুলা। এত দূষিত শহর বিশ্বের কোথাও নেই মনে হয়। এটি একটি ধীরগতির শহর। এখানে জলাবদ্ধতা বড় সমস্যা। সম্প্রতি রাস্তা দ্বিতল হয়েছে, বাড়ি নিচে চলে গেছে। এ নিয়ে কাজ হচ্ছে, কিন্তু অপরিকল্পিত কাজ হচ্ছে। ভবন হচ্ছে পরিকল্পনা ছাড়াই। পানি দূষিত, দৃশ্যমান ময়লা থাকে।
আরও পড়ুন>> ‘ঘুস নিয়ে’ রশিদ না দেওয়ায় সেবা গ্রহিতার মারধরে হাসপাতালে নায়েব
ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যাপক গোলাম ফেরদৌস জিলু জাগো নিউজকে বলেন, আজ ময়মনসিংহে দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, বিভাগীয় শহর হিসেবে অনেক পরিবর্তন হবে। রাস্তাঘাট অপ্রশস্ত, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পানি নিষ্কাশন- কিছুই হয়নি। পরিবর্তনের মধ্যে সুউচ্চ ভবন হচ্ছে। ভূমিকম্পপ্রবণ এ এলাকায় যেভাবে ভবন হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে কী হবে জানি না। ময়মনসিংহের সমস্যার শেষ নেই। আমাদের প্রত্যাশা এই ১৫ বছরে হারিয়ে ফেলেছি। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ অনেক কিছু দিয়েছে। আমরা পাই নাই, তা কিন্তু নয়। কিন্তু এই সিটিকে আমরা যেভাবে সাজাতে চেয়েছিলাম, সেভাবে হয়নি। মানুষের ঘরে পানি যায়, রাস্তায় যায় না। কারণ রাস্তা উঁচু হয়ে গেছে। রাজস্ব অসহনশীল হয়ে গেছে। ৭০০ টাকার রাজস্ব ১ হাজার ৪০০ হতে পারে, কখনোই ৭ হাজার ১৪ হাজার হতে পারে না। মানুষ রাজস্বে অতিষ্ঠ।
তিনি বলেন, অটোরিকশার যা লাইসেন্স আছে, তারচেয়ে তিন-চার গুণ বাইরে থেকে আসে। চাঁদা দিয়ে ভেতরে ঢোকে। উপজেলা থেকে এসে এখানে ভাড়া বেশি পায়, এখানে থাকে। এ কারণে যানজট লেগেই থাকে। অটোরিকশার পেছনে তিনশ টাকার রং দিয়ে ৭ হাজার করে নিচ্ছে। বাইরে যে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এখান থেকে মুক্তি চাই। তাই নতুন মুখ চায় মানুষ। আমি আশাবাদী মানুষ আমাকে হতাশ করবে না।
ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ফারমার্জ আল নূর রাজীব জাগো নিউজকে বলেন, নামে সিটি হয়েছে ঠিক, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পাশের জেলা শহরগুলো কতটা এগিয়েছে, খোঁজ নেন। অথচ পুরোনো এ শহর সিটি করপোরেশন হয়েও এখনো পিছিয়ে। যানজট, জলাবদ্ধতাসহ সমস্যার শেষ নেই। এগুলো সমাধান করে স্মার্ট সিটি গড়তে হবে।
বর্তমান মেয়র ইকরামুল হক টিটু সব সমস্যা স্বীকার করে এগুলো সমাধানে কাজ চলমান বলে জানিয়েছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে অর্থনীতিতে চলে আসে স্থবিরতা। বেশির ভাগ সময় আমাদের সংকট মোকাবিলায় কেটেছে। বাকি যতটুকু সময় ছিল, আমরা থেমে থাকিনি, কাজ করেছি। অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলমান। শেষ হলে এসব সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হবে।
যানজট নিরসনে সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন ইকরামুল হক টিটু।
এসইউজে/এমএইচআর/এএসএম