অকার্যকর সিগন্যাল বাতি, সম্বল হাতের ইশারা
প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বাস চট্টগ্রাম মহানগরীতে। নগরীতে চলাচল করে সাড়ে তিন লাখ যান্ত্রিক যানবাহন। পাশাপাশি আছে তিন লাখের বেশি প্যাডেলচালিত রিকশা। এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। নগরীজুড়ে যত্রতত্র পার্কিং, ট্রাফিক নির্দেশনা না মানা, অবৈধ যানবাহন চলাচল করার কারণে অব্যবস্থাপনা দেখা দিয়েছে নগর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়। দুর্ঘটনা, প্রতারণা কিংবা যানজটে নাকাল হয়ে মাশুল গুনতে হচ্ছে নগরবাসীকেই। নগর ট্রাফিকের অব্যবস্থাপনা নিয়ে নিজস্ব প্রতিবেদক ইকবাল হোসেনের ছয় পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে পঞ্চমটি।
৩০ বছর আগে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চললেও বর্তমানে চলছে হাতের ইশারায়। অধিকাংশ বাতি অকার্যকর। পরিবহন ব্যবস্থাপনার পুরো ঝক্কিটাই কায়িকভাবে সামলাতে হচ্ছে ট্রাফিক বিভাগকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক সময় কাজ করতে হয় দায়িত্বরতদের। তবে এতেই তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এভাবে সামলাতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না বলেও দাবি অনেকের।
জানা যায়, ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪২টি মোড়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি সংযোজন করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। পরবর্তীসময়ে মেরামতের অভাবে ধীরে ধীরে নষ্ট হয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি। ২০০৪ সালের দিকে এসব বাতির ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যায়। ম্যানুয়াল পদ্ধতির পরিবর্তে ডিজিটাল পদ্ধতির স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ট্রাফিক সিস্টেম চালু করতে ২০১৪ সালে জরিপ কার্যক্রম শুরু করা হয়।
২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর নগরীর ব্যস্ত মোড়গুলোতে সিগন্যাল বাতির মাধ্যমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালু করে সিএমপি। নগরীর দুই নম্বর গেট, ওয়াসা মোড়, টাইগার পাস, চৌমুহনী, বাদামতলী, বারেক বিল্ডিং এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থা। প্রত্যেক মোড়ে আলাদা আলাদা সুইচ পয়েন্ট বসানো হয়। এ উদ্যোগের ৫-৬ মাসের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়ে সিগন্যাল বাতি।
সরেজমিনে নগরীর কয়েকটি স্পটে দেখা যায়, সিগন্যাল বাতির পোস্টগুলো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। টাইগার পাস এলাকায় একটি সিগন্যাল পোস্ট বেঁকে গেছে, নিউমার্কেট দোস্ত বিল্ডিংয়ের সামনের সিগন্যাল পোস্টের সামনে অনুষ্ঠানের তোরণ বসানো।
পোস্টগুলোতে বাতির কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০১৯ সালে পরীক্ষামূলকভাবে লাগানো বাতিগুলোও নেই। ওই সময় সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থাপন করা ব্যাটারি সম্বলিত সুইচগুলোও নেই। প্রতিটি মোড়ে হাতের ইশারায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছেন ট্রাফিক সদস্যরা।
• আরও পড়ুন>> পুলিশের স্বনামে-বেনামে গ্রামের অটোরিকশা নগরে
• যত্রতত্র থেমে যাত্রী ওঠানো-নামানো, দেখেও দেখেন না ট্রাফিক পুলিশ
• ভাড়া মিটারে চলে না সিএনজিচালিত অটোরিকশা, যাত্রীদের হয়রানি
নগরীর টাইগার পাস মোড়ে দেখা যায়, সড়কের চারদিকের মধ্যে দুদিকে সিগন্যাল পোস্টগুলো থাকলে ঝুঁকিপূর্ণভাবে দণ্ডায়মান। কথা হলে অলি উল্লাহ নামে এক ট্রাফিক সদস্য বলেন, ‘আমরা হাতের ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করি। কোনো সমস্যা হয় না। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন কোনো সিগন্যাল বাতিই নেই।’
নগরীর চৌমুহনী এলাকায় দায়িত্বপালনকারী ট্রাফিক সার্জেন্ট শেখ শাহাদাৎ বলেন, ‘এখন চট্টগ্রাম নগরীর কোথাও সিগন্যাল বাতি নেই। ট্রাফিক সদস্যরা হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন।’
হাতের ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সুবিধা উল্লেখ করে সার্জেন্ট শাহাদাৎ বলেন, ‘সিগন্যাল বাতি থাকলেও অনেক সময় গাড়িগুলো মানতো না। এতে বিড়ম্বনা আরও বেশি ছিল। এখন গাড়ির চাপ বুঝে প্রয়োজন অনুযায়ী ট্রাফিক ম্যানেজ করা যায়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রাফিকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা কার্যত এখনো ডিজিটাল কিংবা স্মার্ট হতে পারছি না। যে কারণে হাতের ইশারায় আমাদের ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট করতে হচ্ছে। সিএমপির ট্রাফিক বিভাগে জনবল সংকট রয়েছে। অথচ স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি সংযোজন করা গেলে বর্ধিত জনবলের প্রয়োজন পড়তো না। কায়িক শ্রমের পরিবর্তে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো।’
তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালেও চট্টগ্রাম শহরের কয়েকটি মোড়ে সিগন্যাল বাতি বসানো হয়েছিল। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা মাথায় রেখে না লাগানোর কারণে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ এগুলোতে ইলেট্রনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত থাকে, এতে সময়ে সময়ে মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা পুনঃস্থাপন করতে হয়। অথচ এসবের কোনো বাজেট না রেখেই প্রকল্প করা হয়েছিল। যে কারণে প্রকল্পের সুফল পাওয়া যায়নি।’
নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী আলী হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০০০ সালেও চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রতিটি মোড়ের সিগন্যাল বাতি জ্বলতো। লালবাতি দেখে গাড়ি থামতো, সবুজ বাতি জ্বললে গাড়ি চলতে শুরু করতো। এখন সেই সিগন্যাল বাতিগুলো চট্টগ্রাম শহরের কোথাও নেই। পাশাপাশি গাড়ির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাফিক সদস্যরা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যান। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘তিন-চার বছর আগে মোড়ে মোড়ে সিগন্যাল বাতি বসানো হয়েছিল। ওই সিগন্যালগুলো মোড়গুলোতে দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্যরাই রাস্তার পাশে বসানো সুইচ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন। ওই সময়ে প্রকল্পটির জন্য টাকা খরচ করা হয়েছিল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দিন যতই যাচ্ছে, নগরীতে গাড়ির সংখ্যা ততই বেড়ে চলছে। সেজন্য পরিকল্পনামাফিক ডিজাইন করে সিগন্যাল বাতি স্থাপন করতে হবে। নয়তো সুফল মিলবে না।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে সিগন্যাল ব্যবস্থা চালুর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সিএমপির সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক হয়েছে। নগরীর কাজীর দেউড়ি ও নিউমার্কেট মোড়ে দুটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।’
এসব সিগন্যাল কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে পরামর্শকরা কাজ করছেন। তাদের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
সরেজমিনে নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকায় দেখা যায়, ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি স্থাপনের জন্য কাজীর দেউড়ি মোড়ের চারদিকে বাতি স্থাপনের জন্য কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এখনো বাতি সংযোজন করা হয়নি। এরই মধ্যে নতুন তৈরি দুটি কাঠামো বেঁকেও গেছে। মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্যরা বলেন, ‘সিগন্যাল বাতির পোস্টগুলো প্রায় তিন মাস আগে বসানো হয়েছে। এখনো বাতি লাগানো হয়নি।’ অন্যদিকে নিউমার্কেট এলাকায় এখনো কোনো কাঠামোই তৈরি করা হয়নি।
সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর একটি বড় ও পুরোনো। এ শহরে এক সময়ে কেন্দ্রীয়ভাবে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালিং ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তীসময়ে এসব সিগন্যাল অকার্যকর কিংবা নষ্ট হলে ২০১৯ সালের দিকে নির্দিষ্ট কিছু মোড়ে বাতি দিয়ে সিগন্যাল ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরে বড় বড় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ চলমান থাকায় অনেক স্থানে সিগন্যাল পোস্ট তুলে ফেলতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও সিডিএ’র সঙ্গে আমরা ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন ও কার্যকরের বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমরা প্রায় তিন মাস আগে এ বিষয়ে প্রস্তাবনাও দিয়েছি। আশা করছি নগরীর বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো শেষ হলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল সংযোজন করা সম্ভব হবে।
এমডিআইএইচ/এএসএ/জেআইএম