ইলিশে শঙ্কা, সম্ভাবনা পর্যটনে

অর্জিত হয়নি গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার সক্ষমতা

আবু আজাদ
আবু আজাদ আবু আজাদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:১৭ পিএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশের নৌযানগুলোর গভীর সমুদ্রাঞ্চল থেকে মৎস্য আহরণ সক্ষমতা না থাকায় এবং এ নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগের সমন্বয়হীনতায় বিশাল সমুদ্র এলাকা থেকে পেলাজিক মৎস্য সম্পদ আহরণ ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরোলেও ১০০ মিটার গভীরতার বাইরের সমুদ্র সম্পদ সম্পর্কে এখনো কোনো জরিপ পরিচালনা করতে পারেনি বাংলাদেশ।

৬১ কোটি ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণের জন্য পাইলট প্রকল্প নেয় ২০২০ সালের জুলাইতে। গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ ধরতে তিনটি লং লাইনার প্রকৃতির ফিশিং ভ্যাসেল সংগ্রহের কথা থাকলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি সেই উদ্যোগ। অভিযোগ রয়েছে, এই সুযোগে দুটি প্রতিবেশী দেশের (ভারত ও শ্রীলঙ্কার) জেলেরা প্রতিনিয়ত বঙ্গোপসাগরের গভীর জলসীমায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে বিপুল পরিমাণ মাছ লুটে নিচ্ছে।

বঙ্গোপসাগর ঘিরে সুনীল অর্থনীতির নানা সম্ভাবনা নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব থাকছে আজ।

আরও পড়ুন: সরকার ‘সুনীল অর্থনীতি’র ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে

সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট এর সাবেক পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির অতিথি শিক্ষক গবেষক হাসান আহম্মেদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের জেলেরা সমুদ্রের ৬০ মিটারের বেশি গভীরে গিয়ে মাছ ধরতে পারেন না। বেসরকারি বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর সক্ষমতা থাকার পরও ১০০ মিটারের বেশি গভীরতায় ফিশিং করে না। ফলে গভীর সাগরে টুনাসহ সমগোত্রীয় মাছ শিকারে বাংলাদেশের কোনো আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি বা সফলতা নেই। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ শুধু টুনা মাছ রপ্তানি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে।

গভীর সাগরে মাছ শিকার কতদূর
২০১৮ সালে ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের (আইওটিসি) সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার অধিকার পেয়েছে। সদস্য দেশ হিসেবে সংস্থাটিকে প্রতিবছর ৭০ হাজার মার্কিন ডলার (৭৭ লাখ টাকা) পরিশোধ করতে হয় বাংলাদেশকে। কিন্তু সক্ষমতা না থাকায় এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ শিকার করতে পারেনি বাংলাদেশ।

গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ ধরতে তিনটি লং লাইনার প্রকৃতির ফিশিং ভ্যাসেল সংগ্রহের কথা থাকলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি সেই উদ্যোগ। অভিযোগ রয়েছে, এই সুযোগে দুটি প্রতিবেশী দেশের (ভারত ও শ্রীলঙ্কার) জেলেরা প্রতিনিয়ত বঙ্গোপসাগরের গভীর জলসীমায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে বিপুল পরিমাণ মাছ লুটে নিচ্ছে

সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর, চট্টগ্রামের সাবেক পরিচালক মো. শরিফ উদ্দীন বলেন, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে টুনা ও সমগোত্রীয় মাছ শিকারের জন্য ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে জাহাজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠান এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না।

তবে ‘সরকারের দ্বৈত নীতির কারণে গভীর সাগরে টুনা বা পেলাজিক মাছ শিকার সম্ভব হচ্ছে না’- এমনটিই মনে করেন বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এসকে আবিদ হুসাইন।

তিনি বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী ২০০ মিটার গভীরতার পরে সাগরে মাছ ধরতে যে জাহাজ প্রয়োজন তা আমদানির জন্য খরচ হবে শতকোটি টাকা। অথচ এখন পর্যন্ত সরকার সেখানে একটি জরিপ পরিচালনাও করতে পারেনি। তাহলে ব্যবসায়ীরা কী ভরসায় জাহাজ আমদানিতে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে?

আরও পড়ুন: সমুদ্রের ২২ ব্লকে মিলতে পারে ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস

এসকে আবিদ হুসাইনের ভাষ্য, সরকার ব্যবসায়ীদের টুনা শিকারের জন্য ৫৫ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ আমদানি করতে বলছে। অথচ এ খাতে সরকারি প্রকল্পের জন্য তিনটি জাহাজ কেনা হচ্ছে মাত্র ২৫ মিটার দৈর্ঘ্যের। এ বৈষম্য কেন? আমাদেরও যদি ওই মানের জাহাজ দিয়ে টুনা শিকারের অনুমতি দেওয়া হতো তবে মৎস্য আহরণে দেশ অনেক এগিয়ে যেতো। এছাড়া টুনার মত পেলাজিক মাছ আহরণের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ উদ্যোগ নেওয়া হলে তা বেশি সময়োপযোগী হবে বলে মনে করি।

তবে আশার কথা শোনাচ্ছেন মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার। তিনি জাগো নিউজকে জানান, দাপ্তরিক বিভিন্ন জটিলতায় লং লাইনার কেনার কাজটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আগামী মার্চ মাস নাগাদ গভীর সাগরে টুনা মাছের জরিপ কাজ পরিচালনার জন্য দুটি লং লাইনার কেনার কাজ সম্পন্ন হবে।

ইলিশ নিয়ে আছে শঙ্কা
ইলিশ এখন বৈশ্বিক সম্পদ। বাংলাদেশের জাতীয় জিডিপির ১ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। দেশে ২৪ লাখের বেশি মানুষ ইলিশকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ করেন।

বাংলাদেশ ইলিশ আহরণে শীর্ষ দেশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের আহরণ ছিল ২ দশমিক ৯৮ লাখ মেট্রিক টন। যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭১ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। বিগত ১৫ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ।

সরকার ব্যবসায়ীদের টুনা শিকারের জন্য ৫৫ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ আমদানি করতে বলছে। অথচ এ খাতে সরকারি প্রকল্পের জন্য তিনটি জাহাজ কেনা হচ্ছে মাত্র ২৫ মিটার দৈর্ঘ্যের। এ বৈষম্য কেন? আমাদেরও যদি ওই মানের জাহাজ দিয়ে টুনা শিকারের অনুমতি দেওয়া হতো তবে মৎস্য আহরণে দেশ অনেক এগিয়ে যেতো

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ফিশারি ঘাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, নতুন মৌসুম শুরুর পর চট্টগ্রাম উপকূলে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার টন ইলিশ ধরা পড়ছে। তার মধ্যে শুধু ফিশারি ঘাটেই ৫০০ টনের বেশি ইলিশের বিকিকিনি হয়। তাছাড়া সদরঘাট, রাশমনিঘাট, আনন্দবাজার, উত্তর কাট্টলী, দক্ষিণ কাট্টলী ও আকমল আলী ঘাটে আরও অন্তত ৫০০ টন ইলিশ নামছে প্রতিদিন।

তবে পানিদূষণ ও নাব্য সংকটসহ নানা কারণে জাতীয় মাছ ইলিশ বাংলাদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

‘জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প সংস্থান ও গবেষণা (কম্পোনেন্ট এ ও বি)’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইলিশ-সমৃদ্ধ পদ্মা, মেঘনা ও অন্য নদীসমূহের তীরবর্তী শহর এবং কলকারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য সরাসরি নদীর পানিতে মিশছে। ফলে সেসব নদীর পানির গুণাগুণ ক্রমান্বয়ে মাছসহ জলজ প্রাণীর বাসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ইলিশ একসময় হয়তো বাংলাদেশের জলসীমায় প্রজনন বন্ধ করে অন্য কোথাও নতুন ক্ষেত্র বেছে নিতে পারে।

আরও পড়ুন: গভীর সমুদ্রে খনন শত শত প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটাতে পারে

গবেষক হাসান আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, সমুদ্র থেকে আহরিত মাছের ৬০ শতাংশই ইলিশ। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলারগুলো গভীর সাগরে মাত্রাতিরিক্ত ইলিশ আহরণ করছে, ফলে ইলিশ নিয়েও শঙ্কা আছে। ইলিশ অনেক হাইলি মাইগ্রেটরি মাছ। এক জায়গায় বাস্তুসংস্থানের সমস্যা হলে তারা বাসস্থান পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে যায়। বাংলাদেশে ২০০২-০৩ সময়ে ইলিশ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল।

তিনি বলেন, শুধু সুন্দরবনকে যদি মাছের জন্য সংরক্ষিত করা যেতো, অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলা যেতো, তাহলে দেশের সমুদ্র উপকূলে মাছের প্রজনন ও বাস্তুসংস্থানের সংকট হতো না।

উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক পর্যটন
পর্যটন একটি বিশাল বৈশ্বিক ব্যবসা, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য হ্রাস করে। বাংলাদেশে ৭১১ কিলোমিটার উপকূল রেখাজুড়ে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত রয়েছে। তবে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক অঞ্চলের বেশিরভাগ পর্যটন স্পটই এখনো অনুপযুক্ত। কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ কয়েকটি স্পটে উপকূলীয় পর্যটনে কিছুটা সাফল্য এলেও সামুদ্রিক পর্যটন অনেকাংশেই এখনো উপেক্ষিত।

পর্যটনকে শিল্পখাত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৯৯ সালে। কিন্তু পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষাকে ভিত্তি করে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে টেকসই পর্যটনের কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

ইলিশ-সমৃদ্ধ পদ্মা, মেঘনা ও অন্য নদীসমূহের তীরবর্তী শহর এবং কলকারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য সরাসরি নদীর পানিতে মিশছে। ফলে সেসব নদীর পানির গুণাগুণ ক্রমান্বয়ে মাছসহ জলজ প্রাণীর বাসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ইলিশ একসময় হয়তো বাংলাদেশের জলসীমায় প্রজনন বন্ধ করে অন্য কোথাও নতুন ক্ষেত্র বেছে নিতে পারে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অধ্যাপক ড. মো. ম. মারুফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের মোট ২৫টি প্রাণ-প্রতিবেশগত অঞ্চলের মধ্যে ১১টিই উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত। এসব অঞ্চলে ১০টি বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ৫টি জাতীয় উদ্যান এবং ১৭টি মৎস্য অভয়ারণ্য রয়েছে। দেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক অঞ্চলের এসব গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুসংস্থান ও প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকাকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তোলা যেতে পারে।

আরও পড়ুন: প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয়ের সম্ভাবনা

সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী বলেন, উপকূলীয় এলাকার পর্যটনকে সমৃদ্ধ করতে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, বরগুনার তালতলী ও পাথরঘাটা নিয়ে একটি সমন্বিত পর্যটন অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। তাছাড়া প্রতিবেশী তিন দেশ ভারত, মালদ্বীপ আর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সমুদ্রপথে ক্রুজ সেবা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ৭৭ কোটি টাকা করে মোট ২৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে তিনটি ক্রুজ শিপ।

এএজেড/এমকেআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।