আলোচনাসভায় বক্তারা
মেগাসিটি সবার জন্য ‘মেগা-সর্বনাশে’ রূপান্তর হচ্ছে
‘ঢাকার জনসংখ্যা, ঘনত্ব, বসবাসের যোগ্যতা দৈনিক বিবর্তন ঘটছে। মেগাসিটি শুধু প্রান্তিক জনগণের জন্য নয়, বরং সবার জন্য একটি ‘মেগা-সর্বনাশ’ এ রূপান্তর হয়ে যাচ্ছে। আমরা গ্রাম থেকে শহরে এ রকম মেগাসিটি দেখতে এসেছিলাম কি না, এ প্রশ্ন আমাদের সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ণায়ক খুঁজে বের করতে হবে। মেগাসিটি তৈরি করতে গিয়ে সেখানের মানুষ ও প্রকৃতি হারিয়ে যাচ্ছে কি না, এসব বিষয় লক্ষ্য করতে হবে।’
মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) কার্যালয়ে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন বিআইপির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। পরিকল্পনাবিদ ড. তসলীম শাকুর ও স্থপতি ড. শায়ের গফুর সম্পাদিত মেগাসিটি অব দ্যা গ্লোবাল সাউথ ইন দ্যা ২০২০ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন এবং ‘মেগাসিটির বিবর্তন ও শহরের বাসযোগ্যতার রূপান্তর’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করে বিআইপি।
আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করেন বিআপির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। সমাপনী বক্তব্যে তিনি বলেন, আজিমপুর কলোনিতে মেগাসিটির ডিমান্ড পূরণ করতে গিয়ে এমন একটি অবস্থা করে ফেলেছি, যেখানে বসবাসযোগ্যতা হারিয়ে গিয়েছে। তাই বাংলাদেশের পরিকল্পনাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য একটি মন্ত্রণালয় গঠন করার জন্য সব অ্যাডভোকেসি আহ্বান করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি নগর গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মেগাসিটি নিয়ে এই প্রকাশনাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। শুধু ঢাকাই নয়, পুরো বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জন্য অচিরেই নগর, গ্রামীণ ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিষয়ে একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিআইপির প্রকাশিত স্থানিক পরিকল্পনা কাঠামোতে বর্ণিত প্রস্তাবের প্রতিফলন ঘটানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
স্বাগত বক্তব্যে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, বিশ্বের দশটি বড় মেগাসিটি তার একটিতে আমরা বসবাস করি। এ বইটিতে বাংলাদেশের অন্যান্য শহরের যেসব কেস স্টাডি উপস্থাপিত হয়েছে তা দেশের নীতি নির্ধারকসহ গবেষক এবং নগর পরিকল্পনাবিদদের কাজে আসবে। আমরা ১০-১৫ বছর পড়ে যদি নগরের কিনারায় পরিবেশ বা নদী না খুঁজে পাই, তাহলে সেটাকেই কালচার হিসেবে মেনে না নিয়ে বরং আমাদের দেশের কালচারটাকে আমাদের বুদ্ধিমত্তা এবং পেশাজীবীদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একটি নির্দিষ্ট নির্ণায়ক ঠিক করতে হবে।
বইটির উপস্থাপনায় স্থপতি ড. শায়ের গফুর বলেন, আমাদের নগর পরিকল্পনায় পেশার স্বীকৃতি এবং কার্যপরিধিকে সামনে না এনে একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ বইটির শুধু মেগাসিটি নয়, আমরা আমাদের যার যার শহরের যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলোকে সামনে তুলে এনেছি।
বইটির সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. তসলীম শাকুর বলেন, এ বইটি এশিয়া এবং আফ্রিকার সমসাময়িক মেগা শহরগুলোর ওপর অত্যাধুনিক গবেষণার একটি চমৎকার সংগ্রহ দেবে। মেগা-নগরায়ণ প্রক্রিয়াগুলো এখন আর শুধু স্থানীয় প্রভাবের অধীনে নয় বরং বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে খুব সমন্বিত করা হয়েছে। মেগাসিটিগুলোর ওপর বৈচিত্র্যময় কিন্তু অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এ সমৃদ্ধ সংগ্রহটি অনেক মূল্যবান হবে এবং মেগাসিটিগুলোর আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য সমসাময়িক বিশ্বের পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, পরিবেশবিদ, অ্যাক্টিভিস্ট এবং ছাত্রদের দিকনির্দেশনা দিতে সক্ষম হবে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ আলোচক বিআইপির সাবেক সভাপতি পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বিআইপিকে এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা বিআইপি প্রাঙ্গণে আয়োজন করার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি পরবর্তীতে এমন সমসাময়িক বিষয়াবলীর প্রকাশনায় নবীন পরিকল্পনাবিদদের আরও বেশী অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি বলেন, পূর্বাচলের ডিজাইন পপুলেশন ২৫ লাখ। এই নকশাটি করা হয়েছিল ৯০ দশকের দিকে, পরবর্তীতে ২০০১ এর দিকে তা প্রচলিত হয়। ২০০৬ এ যখন নতুন বিধি প্রণয়ন হয়, সে বিধি অনুযায়ী ঐ এলাকার পুরো জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ লক্ষ। এবং ২০০৭ এর সংশোধনীর পর জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৮০ লাখে। আমরা পেশাজীবীরা আসলে পরিকল্পনাগুলোকে নষ্ট করছি সাধারণ মানুষ নয়। পরিশেষে তিনি বলেন, ড্যাপের উপস্থাপনা গুলো বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত না হলেও যদি সেগুলোর অনুসরণ করা যায়, তাহলেও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা ভালো একটি ঢাকাকে রেখে যেতে পারবো।
অনুষ্ঠানের বিশেষ আলোচক বিআইপির উপদেষ্টা পরিষদ আহ্বায়ক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, বিশ্বের ৩৪ টি মেগাসিটির মধ্যে ২১ টিই এশিয়াতে, যার মধ্যে ঢাকা অন্যতম। বিভিন্ন দেশের মেগাসিটির চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবিলা করছে, এই বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করা হয়েছে বইটিতে যা আমাদের সবাইকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, একটি দেশের প্রেক্ষাপট আরেকটি দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা। এ ভিন্নতার তথ্যভাণ্ডার হিসেবে এ বইটি সব গবেষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ইনফরমাল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কোথাও কাজ হয় না। কিন্তু নগরের ট্রানজিশনের পরিচয় পেতে হলে এর ওপর গুরুত্ব দেওয়া অত্যাবশ্যক। আমাদের চোখে ঢাকা শহরকে দেখলে নগরের ধার অথবা কিনারা হিসেবে দেখতে গেলে আর বুড়িগঙ্গা নদী খুঁজে পাই না। ১০-১৫ বছর পরে আরও বেগতিক অবস্থায় পরিণত হওয়ার আগে এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলী নিয়ে আরও প্রকাশনা হওয়া প্রয়োজন।
পরিকল্পনাবিদ ড. মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, নগর, নগর-ব্যবস্থা বিষয়ে আমাদের দেশে ডাটার একটি ঘাটতি এখনো রয়ে গিয়েছে। যার অভাব পূরণে এ বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। তবে, দেশের সভ্যতা বিবেচনা করলে পুরান ঢাকার একজনকে রাজউকের ঝিলমিল প্রজেক্টে থাকতে বলা হলে তিনি থাকতে চাইবেন না। কিন্তু আমাদের আদর্শ পরিস্থিতি কোনটি হবে, সেটি বিবেচনা করতে হবে।
পরিকল্পনাবিদ গোলাম রহমান বলেন, বুড়িগঙ্গার যেই পানি আগে আমরা পান করতাম, সেই নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে নাক ঢাকতে হয়। শহরের এমন বিবর্তন লিপিবদ্ধ করার জন্য যারা কাজ করছেন তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তিনি।
এমএমএ/এমএএইচ/