ঢাকায় বিদেশি পাইলট হিন্দির মৃত্যু

পিবিআইয়ের তদন্তে ইউনাইটেডের ‘অসঙ্গতি’, গালফ এয়ারের ‘অসহযোগিতা’

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৩০ এএম, ০৩ জানুয়ারি ২০২৪

২০২২ সালের ১৪ ডিসেম্বর গালফ এয়ারের ক্যাপ্টেন মোহান্নাদ ইউসুফ হাসান আল হিন্দি ডিউটিরত ও ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তাকে রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই তিনি মারা যান। ক্যাপ্টেন হিন্দি ইউনাইটেড হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিনের চিফ কনসালট্যান্ট ডা. ওমর ফারুকের অধীনে ভর্তি হয়েছিলেন। এ ঘটনায় হিন্দির বোন তালা আল হিন্দি জোসেফানো ডা. ফারুককে অভিযুক্ত করে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন।

ক্যাপ্টেন ইউসুফ হাসান হিন্দির মৃত্যু নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি আদালতে জমা দিয়েছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে পাইলটের পরিবারের করা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও এই মৃত্যুতে ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রক্রিয়াগত অসঙ্গতি এবং মামলার তদন্তে গালফ এয়ারের অসহযোগিতাসহ বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে।

আদালত পিবিআই এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কলেজকে (বিএমডিসি) এ ঘটনা তদন্ত করে পৃথক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দিতে পারেনি ইউনাইটেড হাসপাতাল-
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গালফ এয়ারের পাইলটকে ঘটনার দিন ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে ইউনাইটেড হাসপাতালে ডা. ওমর ফারুকের অধীনে ভর্তি করা হয়। তবে তখন তিনি হাসপাতালে ছিলেন না। ভর্তির পর পাইলটকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। ডা. ফারুক সকাল সাড়ে ৯টায় হাসপাতালে গিয়ে পাইলটের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। এসব বিভিন্ন পরীক্ষা চলাকালে দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে পাইলট হাসান আল হিন্দি মারা যান। ডা. ফারুকের অনুপস্থিতিতে তার অধীনে (ভোরে) কীভাবে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা হলো, এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো উত্তর দিতে পারেননি ওই চিকিৎসক।

ঘটনার পাঁচ মাস পর ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে ঘটনার দিনের সাড়ে ৮ ঘণ্টার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেয়ে আবেদন করা হয়। তবে এক চিঠিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ইউনাইটেড হাসপাতালের সার্ভারে ৩০ দিনের বেশি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থাকে না।

পিবিআই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চায়, একজন চিকিৎসকের অধীনে কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে সেই চিকিৎসক যদি হাসপাতালে না থাকেন তাহলে ওই রোগীর চিকিৎসার জন্য কী ধরনের প্রটোকল ব্যবহার করা হয়? এ বিষয়ে তাদের কোনো বিধি, প্রোটোকল বা কনভেনশন নেই বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

তবে বারডেমসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এই প্রোটোকল রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে পিবিআই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৃতব্যক্তির মৃত্যু সনদে হার্টে ৯৯ শতাংশ ব্লকেড থাকা সত্ত্বেও সকাল ৮টা পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরও ইউনাইটেড হাসপাতালের জুনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ডা. তুনাজ্জিনা আফরিন রোগীর হার্টে কোনো ধরনের সমস্যা নেই বলে মন্তব্য করেন। শুধু তা-ই নয়, সকাল ৮টায় ডা. আফরিন রোগীর খোঁজখবর নিতে সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট বা কোনো পরামর্শককে না জানিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেন।

চিকিৎসকদের অবহেলা ও হাসপাতালের রেকর্ডে জালিয়াতির প্রমাণ মেলেনি-
পিবিআইয়ের তদন্তে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিভিন্ন অসঙ্গতি পাওয়া গেলেও এ বিষয়ে মতামত দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)।

পিবিআই জানায়, তাদের পক্ষ থেকে ইউনাইটেড হাসপাতাল ও এর চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে মতামত জানতে চেয়ে বিএমডিসি সভাপতির কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়। আদালত বিএমডিসিকে একাধিকবার নির্দেশ নিলেও তারা কোনো মতামত দেয়নি। তাদের মতামত না পাওয়ায় ইউনাইটেড হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করা যায়নি।

এছাড়া পিবিআই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে জানতে চায়, কোনো চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তার অধীনে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা যায় কি না? পাশাপাশি ইউনাইটেড হাসপাতালের মতো একটি ব্যয়বহুল হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা বিশেষ চিকিৎসা দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে ভোর ৫টায় ভর্তি হওয়া একজন গুরুতর রোগীকে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে পারকিউটেনাস করোনারি ইন্টারভেশন (পিসিআই) করা হয়। এ বিষয়ে আপনার (স্বাস্থ্যের ডিজি) মতামত প্রয়োজন। কিন্তু ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে কোনো মতামত দেয়নি।

তাই চিকিৎসা প্রদানকালে চিকিৎসকদের অবহেলা ও হাসপাতালের রেকর্ডে জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে পিবিআই।

গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষ কোনো সহযোগিতা করেনি-
পিবিআইয়ের তদন্তে আরও বলা হয়েছে, গালফের কো-পাইলট খলিল আব্দুর রাজ্জাক ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাইলট ইউসুফ হাসানের সঙ্গে ছিলেন, ইউনাইটেড হাসপাতালে অবস্থান করেছেন, এমনকি মরদেহ জর্ডানে হস্তান্তরেও তিনি ছিলেন। কো-পাইলট খলিল এ মামলার সাক্ষী। তবে গালফ এয়ার তাকে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হাজির করা থেকে বিরত রেখেছেন।

পিবিআই বলছে, রাজ্জাকের মোবাইল ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো বা ফোনকল করা হলেও তিনি রেসপন্স করেননি এবং কোনো জবাবও দেননি। তবে একাধিকবার চিঠি দেওয়ার পর গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কো-পাইলট খলিল আব্দুর রাজ্জাক পিবিআইকে একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। সেই লিখিত বক্তব্য আদৌ রাজ্জাকের বক্তব্য কি না তা নিশ্চিত হতে পারেনি পিবিআই।

গালফের কান্ট্রি ম্যানেজারের বিষয়ে তদন্তে বলা হয়েছে, মামলার তদন্তকালে গালফ এয়ারের কান্ট্রি ম্যানেজার ঈসা শাহকে তদন্তকারী কর্মকর্তা বক্তব্য দেওয়ার জন্য একটি নোটিশ দেন। ঈসা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেন তাকে ডাকা হয়েছে?

পিবিআই উল্লেখ করেছে, গালফ এয়ারের সাক্ষীদের পিবিআইয়ের কাছে হাজির করানো এবং ভিকটিমের মেডিকেল রেকর্ড সংগ্রহ করে পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার, গালফ এয়ার এবং তার অফিসে কর্মরত ব্যক্তিরা সবসময় নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করে সাক্ষী ও মেডিকেল রেকর্ড পাঠানো থেকে বিরত থেকেছেন। তাদের একজন সহকর্মীর মৃত্যুর তদন্তকাজে তারা কোনোরকম সহযোগিতা করেননি। গালফ এয়ার কর্তৃপক্ষ রোগীর মরদেহের কোনো ময়নাতদন্ত বা সুরতহাল করেনি। এ বিষয়ে হিন্দির কো-পাইলট খলিল কিংবা মরদেহ বুঝে নেওয়া কান্ট্রি ম্যানেজার ঈসা শাহও কোনো বক্তব্য দেননি।

শাহজালাল বিমানবন্দর এবং বেবিচকও সহযোগিতা করেনি-
তদন্ত প্রতিবেদনে পিবিআই জানিয়েছে, এ ঘটনার তদন্তে একাধিকবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ও অভ্যন্তরীণ তদন্তের প্রতিবেদন চাইলেও তারা কোনো উত্তর দেননি। তাই বিমানবন্দরে ক্যাপ্টেন হিন্দির সঙ্গে কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়েছিল কি না তা জানা যায়নি।

গালফ এয়ারের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালাবে পরিবার-
পিবিআইয়ের প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে পাইলট মোহান্নাদের বোন তালা আল হিন্দি জোসেফানো বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে যথেষ্ট প্রমাণ উন্মোচিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো অপরাধ প্রমাণিত হয়নি বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তাতে আমাদের পরিবার হতাশ ও মর্মাহত।

তিনি বলেন, যতদিন না মোহান্নাদের আকস্মিক মৃত্যুতে জড়িত দোষী ব্যক্তিদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত হয়, ততদিন তার পরিবার তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে চায়। ভিকটিমের মৃত্যুতে জড়িত অপরাধী তথা যেসব চিকিৎসক চিকিৎসাজনিত অবহেলায় জড়িত তারা জেলে না যাওয়া পর্যন্ত এবং দায়ী গালফ এয়ার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো।

টিটি/এমকেআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।