বছরজুড়ে আলোচনায় ‘ডিবির ভাতের হোটেল’

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৪৩ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩

বছরজুড়েই নানান ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ কার্যালয়। বিভিন্ন অভিযানে যেমন ছিল ডিবির সফলতা, তেমন ছিল ডিবি কার্যালয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির ভাত খাওয়ানোর ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া। ছবি ভাইরালের পর ডিবি কার্যালয়কে অনেকে মন্তব্য করেন ‘ডিবির ভাতের হোটেল’ বলে।

তবে এসব মন্তব্য ডিবি ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে বলে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, ‘ডিবির ভাতের হোটেল’ কথাটি মানুষ রসবোধ থেকে বলছে।

আরও পড়ুন>>> ডিবিপ্রধান হারুনের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেলেন গয়েশ্বর 

হারুন অর রশীদ বলেন, ‘যেখানেই অপরাধ ঘটুক, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে অপরাধীদের শনাক্ত করে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করি। অনেকেই মনে করতে পারেন, ডিবি কার্যালয় একটা ভাতের হোটেল। এতে আমরা ডিমরালাইজড বা হতাশ নই। এটা পুলিশের মানবিক দিক।’

ডিবিপ্রধান হারুনের সঙ্গে খাবার খান গয়েশ্বর
গত ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। হাসিমুখে ডিবিপ্রধানের সঙ্গে তার খাবার খাওয়ার ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, হারুন অর রশীদ নিজে গয়েশ্বরের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন।

আপ্যায়ন করে সেটার ছবিসহ ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। যারা কাজটি করেছে- এটি অত্যন্ত নিম্ন রুচির পরিচায়ক, এক ধরনের তামাশাপূর্ণ নাটক। এতে কি সরকার প্রমাণ করতে চায় যে আমরা হাভাতে? ভিক্ষা করে খাই?

জানা যায়, ওইদিন খাবারের মেন্যুতে ছিল খাসির মাংস, মুরগির মাংস, একাধিক মাছের তরকারি, রোস্ট ও সবজি। এছাড়া আম, মালটা, আঙ্গুর ও ড্রাগন ফলও ছিল খাবারের টেবিলে। মধ্যাহ্নভোজ শেষে ডিবির একটি সাদা গাড়িতে করে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে তার বাসায় পৌঁছে দেন ডিবি সদস্যরা।

ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়াকে ন্যক্কারজনক বলেন গয়েশ্বর
রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আপ্যায়ন করে সেটার ছবিসহ ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। যারা কাজটি করেছে- এটি অত্যন্ত নিম্ন রুচির পরিচায়ক, এক ধরনের তামাশাপূর্ণ নাটক। এতে কি সরকার প্রমাণ করতে চায় যে আমরা হাভাতে? ভিক্ষা করে খাই? গ্রামের ভাষায় বলা হয় ‘খাইয়ে খোটা দেওয়া’।

আরও পড়ুন>>> ডিবির নয়, হারুন অর রশীদের বাসার খাবার খেয়েছি: গয়েশ্বর 

তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা ডিবির কার্যালয়ে সংস্থাটির পক্ষ থেকে যে খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল, সেই খাবার খাইনি। ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের জন্য বাসা থেকে পাঠানো খাবারই খেয়েছি। ডিবি কার্যালয়ে তার জন্য যে খাবারের আয়োজন করা হয়, তা তার স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী ছিল না। এছাড়া এ খাবার নিয়ে তার সন্দেহও ছিল। সে কারণে তিনি আর ওই খাবার খাননি।

গয়েশ্বর বলেন, ডিবিপ্রধান আমাকে অনুরোধ করেছেন, রুই মাছ তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। আর যেহেতু ডিবিপ্রধান নিজেই খাবারটি খাচ্ছেন, তখন আমার মনে হলো- এটা যদি খাই, তাহলে সমস্যা হবে না।

নিতাই রায় চৌধুরীকেও মধ্যাহ্নভোজ করান ডিবিপ্রধান
২৯ আগস্ট ব্যক্তিগত কাজে ডিবি কার্যালয়ে যান বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী। এসময় তাকেও দুপুরের খাবার খাওয়ান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পুত্রবধূ নিপুণ রায়ের বাবা নিতাই রায় চৌধুরী। নিতাই রায়ের খাবার মেন্যুতে ফলের পাশাপাশি মাছ, মাংস ও ভাতের ব্যবস্থা ছিল। ওইদিনও ডিবিপ্রধান নিজ হাতে খাবার তুলে দিয়ে বিএনপি নেতাকে আপ্যায়ন করেন।

আরও পড়ুন>>> এবার ডিবি কার্যালয়ে ডাল-ভাত খেলেন হিরো আলম 

ডিবি কার্যালয়ে ডাল-ভাত খান হিরো আলম
হত্যার হুমকির অভিযোগ নিয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের সঙ্গে দেখা করেন আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল ইসলাম ওরফে হিরো আলম। ওইদিন দুই সহযোগীসহ ডিবি কার্যালয়ে দুপুরের খাবার খান তিনি। তবে ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কাছে পুলিশ কর্মকর্তাদের আপ্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও খাবার নিয়ে কিছুটা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন হিরো আলম।

আমাদের আলুভর্তা আর ডাল দেওয়া হয়েছে। এটা ঠিক না। দুরকম খাবার দিচ্ছেন, ঠিক নাকি? অপু বিশ্বাস আসলে অনেক খাবার দিছেন, নেতা আসলেও অনেক কিছু খেতে দিছেন। আর আমারে খালি আলুভর্তা, ডাল, ভাজি দিছেন।

এ সময় হিরো আলম বলেন, ‘আমাদের আলুভর্তা আর ডাল দেওয়া হয়েছে। এটা ঠিক না। দুরকম খাবার দিচ্ছেন, ঠিক নাকি? অপু (অপু বিশ্বাস) আসলে অনেক খাবার দিছেন, নেতা আসলেও অনেক কিছু খেতে দিছেন। আর আমারে খালি আলুভর্তা, ডাল, ভাজি দিছেন।’

আরও পড়ুন>>> এবার ডিবি কার্যালয়ে ভাত খেলেন ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর 

সমঝোতার পর ডিবিতে খাবার খান অপু-তাপস
ঢালিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপু বিশ্বাস ও গানবাংলা টিভির সিইও কৌশিক হোসেন তাপস গত ১৯ ডিসেম্বর ডিবি কার্যালয়ে দুপুরের খাবার খান। কিছু বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ছিল। ডিবি কার্যালয়ে সেসব বিষয় সমঝোতার পর সেখানে দুপুরের খাবার খান তারা। তাদের খাবারের মেন্যুতে ছিল ভাত, মাংস, মাছ, ডাল, লাল শাক, সবজি ও ভর্তা।

ভাত খেয়েছেন শাহজাহান ওমর
গত ৬ ডিসেম্বর দুপুরে ডিবি কার্যালয়ে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের সঙ্গে ভাত খান বিএনপি থেকে সদ্য বহিষ্কৃত ঝালকাঠি-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম। খাবারের মেন্যুতে ছিল ভাত, মাংস, মাছ, ডাল, সবজি ও ভর্তা।

অনেকেই মনে করতে পারেন, ডিবি কার্যালয় একটা ভাতের হোটেল। এতে আমরা ডিমরালাইজড বা হতাশ নই। এটা পুলিশের মানবিক দিক...
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ/ ফাইল ছবি

খাবার শেষে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে আলাপে নিজের অভিযোগের কথা জানান শাহজাহান ওমর। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের শাহজাহান ওমর বলেন, ‘আমি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছি। আমার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী এমনকি আমার জুনিয়র আইনজীবীর মোবাইল ফোনে কল করে নানান কথা বলা হচ্ছে। ওই বিষয়টিই হারুন সাহেবকে জানাতে এসেছিলাম।’

আরও পড়ুন>>> হারুন নয়, তার স্ত্রীর হোটেলে খেয়েছি: শামীম ওসমান 

সরকারের সঙ্গে আপস করে জামিন পেয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাশিমপুরে আপস করে কেমন করে? ২৯ নভেম্বর নরমাল প্রসেসে আমার জামিন হয়েছে। ৩০ নভেম্বর (আওয়ামী লীগে) জয়েন করেছি।’

ডিবি কার্যালয়ে শামীম ওসমানের মধ্যাহ্নভোজ
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান ২৯ নভেম্বর দুপুরে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজন করেন। ওইদিন ডিবি কার্যালয় থেকে বের হলে সাংবাদিকরা তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চান। তখন শামীম ওসমান বলেন, ‘হারুন ভাইয়ের নয়, উনার স্ত্রী আমার বোন তার হোটেলে খেয়েছি।’

কোনো মানুষ যদি কারও বাড়িতে যায় তাকে আপ্যায়ন করতে হয়। আমরা স্বাধীন দেশের পুলিশ, আমরা যদি কাউকে আপ্যায়ন করি এটাতো খারাপ কিছু নয়। আর যারা রসবোধ থেকে ভাতের হোটেল বলেন, তারাও ভালো অর্থে বলেন, খারাপ অর্থে বলেন না। এতে আমরা উৎসাহিত হই।

শামীম ওসমান আরও বলেন, ‘হারুন ভাই আমার অনেক আগের পরিচিত। একসঙ্গে রাজনীতি করেছি। সে কারণেই দেখা করতে আসা। পাশাপাশি নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশকে নিয়ে অনেকেই ষড়যন্ত্র করছে। এসব তথ্য তাকে দিয়েছি। সাধারণ মানুষ হিসেবে তথ্যগুলো দিয়ে গেলাম। হারুন ভাই ক্যাপাবল অফিসার, তিনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।’

মধ্যাহ্নভোজ নিয়ে যা বলছেন ডিবিপ্রধান
‘ডিবির ভাতের হোটেল’ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘এটা রসবোধের প্রশ্ন। বাঙালি রসবোধ সম্পন্ন জাতি। বাংলা সাহিত্যে রসবোধ প্রয়োগ আমাদের মানসিক খোরাক জোগায়। আমি মনে করি রসবোধপ্রবণ একটি বিষয় হলো ভাত খাওয়ানো। আমরা আসলে কাউকে ডেকে এনে ভাত খাওয়াই না। কেউ যদি কাজের জন্য আমাদের কাছে আসেন, তার কাজটা করে দেওয়ার চেষ্টা করি। পাশাপাশি লাঞ্চ টাইম হলে লাঞ্চের অফার করি। তিনি যদি অফার গ্রহণ করেন তাহলে খেয়ে যান।’

আরও পড়ুন>>> সমঝোতার পর ডিবিতে দুপুরের খাবার খেলেন অপু বিশ্বাস-তাপস 

তিনি বলেন, ‘আমরা এখন স্বাধীন দেশের পুলিশ। একটা সময় থানায় যেতে মানুষ ভয় পেতো। এখন আমি একজন ডিআইজি, আমার কাছে শত শত লোক কোনো না কোনো কাজ আসেন। সাইবার বুলিংসহ বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে মানুষ আমাদের কাছে আসে।’

হারুন অর রশীদ আরও বলেন, ‘ইসলাম ধর্মে আছে- কোনো মানুষ যদি কারও বাড়িতে যায় তাকে আপ্যায়ন করতে হয়। আমরা স্বাধীন দেশের পুলিশ, আমরা যদি কাউকে আপ্যায়ন করি এটাতো খারাপ কিছু নয়। আর যারা রসবোধ থেকে ভাতের হোটেল বলেন, তারাও ভালো অর্থে বলেন, খারাপ অর্থে বলেন না। এতে আমরা উৎসাহিত হই।’

টিটি/কেএসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।