মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন

ফসফরাসের উপস্থিতি, সন্দেহে তিন ব্যক্তি

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:১০ এএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২৩

দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়েছে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ‘ছ’, ‘জ’ ও ‘ঝ’ বগি। বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেনটি থামার পর ১৪টি বগির মধ্যে পুড়ে যাওয়া তিন বগির একটিতে যাত্রী ওঠানামা করেছেন। সেটি ‘ছ’ বগি। তিন মিনিটের বিরতিতে ওই ‘ছ’ বগিতে কয়েকজন ওঠানামা করেন।

পুলিশের সন্দেহ, যাত্রীবেশে ‘ছ’ বগিতে নাশকতাকারীরা উঠেছিল। এরপর সুযোগ বুঝে ‘জ’ ও ‘ঝ’ বগির মাঝে আগুন দেয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, ট্রেনে পোড়া জিনিসের নমুনায় ফসফরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আগুন দেওয়ার সময় রাসায়নিক ব্যবহার করা হতে পারে। এর সঙ্গে পেট্রোল দিয়েও আগুন লাগাতে পারে।

jagonews24

সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে একটি তদন্ত সংস্থা তিনজন ব্যক্তিকে সন্দেহ করছে। যারা বিমানবন্দর থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে ওঠেন। এই তিনজনের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছেন এমন বেশ কয়েকজনের ফুটেজ পাওয়া গেছে। এর বাইরে কেউ উঠেছেন কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি নাশকতাকারীরা বিমানবন্দরের আগের স্টেশনগুলোর মধ্যে কোনো একটি থেকে উঠেছেন কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: ঢাকায় ফের ট্রেনে আগুন 

ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনাটি ছায়াতদন্ত করছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

সিটিটিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, আগুনের ঘটনায় আহত কয়েকজনের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন জানিয়েছেন আগুন লাগার আগে ট্রেনের দরজা খুলে দুজন যুবক আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে একজন যাত্রী তাদের জিজ্ঞেস করেন, এই ঠান্ডার মধ্যে দরজা খোলা রেখে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চান। জবাবে ওই যুবকের একজন জানান, তারা দরজা বন্ধ করে তাদের সিটে কিছু সময়ের মধ্যে বসবেন।

সিটিটিসির এই কর্মকর্তা বলেন, তারা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলছেন এবং তাদের বক্তব্য নিয়েছেন। এরপর সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এছাড়া ওই দুই যুবক কোথা থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন তা জানার চেষ্টা চলছে।

jagonews24

ট্রেনে আগুন লাগাতে কী উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পোড়া জিনিসের নমুনায় ফসফরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে রাসায়নিক প্রতিবেদন পাওয়ার পর সঠিকভাবে বলা যাবে আগুনে কী ব্যবহার করা হয়েছিল।

হাতব্যাগ নিয়ে ওঠা এক যুবককে খুঁজছে পুলিশ

গোয়েন্দা তথ্যে জানা গেছে, দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বিভিন্ন স্টেশন এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে এক যুবকের আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়েছে। তাকে খোঁজা হচ্ছে।

মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের পরিচালক মো. খালেদ মোশারেফ বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে ঢাকা রেলওয়ে থানায় মামলা করেছেন। রেলওয়ে পুলিশ মামলাটির তদন্ত করলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) তদন্ত করার আগ্রহ জানিয়েছে।

আরও পড়ুন: তেজগাঁওয়ে চলন্ত ট্রেনে আগুন, নিহত ৪ 

পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, রেলের গার্ড, স্টুয়ার্ড, চালক ও গেটকিপারদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শুনছে।

নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল সোমবার রাত ১১টার দিকে। মঙ্গলবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে ট্রেনটি যখন বিমানবন্দর স্টেশন এলাকায়, তখনই সেটিতে আগুন দেওয়া হয়। এতে পুরোপুরি পুড়ে যায় তিনটি বগি।

যাত্রীদের একাংশ বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নেমে গিয়েছিলেন। বাকিদের বেশির ভাগ ছিলেন ঘুমিয়ে। ট্রেনে নারীরা ছিলেন, শিশুরা ছিল, ছিলেন প্রবীণরাও। সবাই দেখলেন, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে পুরো বগি। এর মধ্যে চিৎকার, কান্না।

jagonews24

ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস জানান, মামলায় ট্রেনে নাশকতা চালিয়ে যাত্রী হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। রেলওয়ে পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট দুর্বৃত্তদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে কাজ করছে।

পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিটের দায়িত্বশীল কর্মকর্তরা জানিয়েছেন, বিমানবন্দর স্টেশনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তিনজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

‘জ’ বগির দায়িত্বে ছিলেন স্টুয়ার্ড মাঈন উদ্দিন ও ‘ঝ’ বগিতে নজরুল ইসলাম। তারা জানান, বিমানবন্দরে তাদের বগিতে কোনো যাত্রী ওঠেননি। তবে ‘ছ’ বগিতে থাকা স্টুয়ার্ড রিয়াদ হোসেন বলেন, তার বগিতে বেশকিছু যাত্রী ওঠানামা করেছেন।

রেল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোহনগঞ্জ থেকে ট্রেনটি ছাড়ার সময় ১৪টি বগির সিরিয়াল ছিল ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’, ‘ঘ’। ময়মনসিংহ এসে ইঞ্জিন ঘোরানোর কারণে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে বগিগুলোর ছিল ‘ঘ’, ‘গ’, ‘খ’, ‘ক’ সিরিয়ালে। আগুনে পুড়ে যাওয়া তিনটি বগির সিরিয়াল ছিল ‘ঝ’, ‘জ’, ‘ছ’। সামনের দিকে ‘ঝ’ ও ‘জ’ বগিতে প্রথমে আগুন লাগে। পরে এই আগুন ‘ছ’ বগিতেও ছড়িয়ে পড়ে।

আগুন দেওয়া হয় দুই বগির মাঝে

ট্রেনে প্রথম আগুন দেওয়া হয় ‘জ’ ও ‘ঝ’ বগির মাঝখানে। রেলকর্মীরা যখন এই আগুন নেভাতে ব্যস্ত, তখনই বগির ভেতরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা, যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ‘ছ’ বগিতেও। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ভোর ৪টা ৩৭ মিনিটে বিমানবন্দর স্টেশনে থামে। তিন মিনিট বিরতি দিয়ে ৪টা ৪০ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে যায়। এর তিন মিনিট পর ভোর ৪টা ৪৩ মিনিটে ‘জ’ ও ‘ঝ’ বগির মাঝে আগুন দেখতে পান রেলকর্মী ও যাত্রীরা। দুটি বগি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। যাত্রীরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। আগুন নেভাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন রেলের সংশ্লিষ্টরা। পরক্ষণেই ‘জ’ ও ‘ঝ’ বগিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ট্রেনটি তেজগাঁও থামার পর দেখা যায়, ‘ছ’ বগিতেও আগুন দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: গাজীপুরে ট্রেনে নাশকতার ঘটনায় ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৪ জন রিমান্ডে 

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কমলাপুর রেলওয়ে থানায় যে হত্যা মামলা হয়েছে সেই মামলায় ছায়াতদন্ত করছে র‌্যাব। র‌্যাবের ফরেনসিক, সাইবার মনিটরিং ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করা হচ্ছে। আশা করছি, শিগগির জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।

জানতে চাইলে ট্রেনটির পরিচালক (গার্ড) মো. খালেদ মোশারেফ বলেন, ‘জ’ বগিতে দায়িত্বে থাকা স্টুয়ার্ড মাঈন উদ্দিন মানিক আগুনের বিষয়টি টের পেয়ে তাৎক্ষণিক স্টুয়ার্ড ম্যানেজার রাহাত মিয়াকে জানান। রাহাত জানান আমাকে। ট্রেনটি তেজগাঁওয়ে যখন থামে, তখন সময় ৪টা ৫৮ মিনিট। খবর পেয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে আসে। পরে আসে আরও দুটি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে ৫টা ৫০ মিনিটে। ‘জ’ বগি থেকে শিশু, নারীসহ চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

jagonews24

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার জাগো নিউজকে বলেন, সর্বোচ্চ কোনো মহলের নির্দেশনায় এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। সেটি দেশের ভেতরে বা দেশের বাইরে থেকে অন্য কেউ ইঙ্গিত দিতেও পারে। অতীতে যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের ব্যাপারেও দৃষ্টি রয়েছে। তারা কিছুদিন থেকে বাসে আগুন দিচ্ছে। গাজীপুরে ট্রেনের লাইন কেটে রেখেছে। এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যে পার পাওয়া যাবে না, ডিএমপি সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জড়িতরা যত হাই লেভেলের বা লো প্রোফাইলের হোক, আমরা কাউকেই ছাড়বো না।

এদিকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে হরতাল-অবরোধের মধ্যে এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চারটি ট্রেনে আগুন দেওয়া এবং রেললাইন কেটে ফেলার একটি ঘটনা ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আর, সর্বশেষ গত মঙ্গলবার চারজনসহ মারা গেছেন পাঁচজন। রেললাইনে আরও ১৯টি অগ্নিসংযোগ এবং ৮টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

টিটি/এমআরএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।