ঢাকা শহরে সংসদ সদস্যদের কাজ কী?

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ০৯:০৪ এএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩

#রাস্তা-ঘাটসহ নাগরিক সেবার কাজ করে সিটি করপোরেশন
#সংসদ সদস্যরাও বলছেন, তাদের আসলে বেশি কাজ নেই
#সংসদ সদস্যরা শুধু ডিও দেন

সংসদ সদস্যদের কাছে সাধারণ জনগণের প্রাপ্তির প্রত্যাশা থাকে অনেক। নিজ এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ফায়ার স্টেশন কিংবা বাঁধ নির্মাণ প্রভৃতি কাজে সংসদ সদস্যের ভূমিকা চান সাধারণ মানুষ। তারা মনে করেন, এসব কাজে এলাকার সংসদ সদস্য এগিয়ে এলে সহজেই বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু রাজধানী ঢাকার চিত্র একটু ভিন্ন। এখানে কাজ মানেই সিটি করপোরেশন। তাহলে সংসদ সদস্যের কাজ কী, তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশাই বা কী থাকে, আর সংসদ সদস্যরাই বা কী করেন- বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট নয় অধিকাংশ মানুষ।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ১৭২ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর রয়েছেন। এ দুটি সংস্থায় আছেন মন্ত্রী পদমর্যাদার দুজন মেয়র। তারা নগরে সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, সড়কবাতি লাগানো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশক নিধন, হাটবাজার নিয়ন্ত্রণসহ ২৮ ধরনের সেবা দেন। এছাড়া নগরের পার্ক, খেলার মাঠ নির্মাণ, অবকাঠামো উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও নেন তারা।

আরও পড়ুন>> সুবিধা দিতে গিয়ে নাগরিক ভোগান্তি বাড়ালো ডিএসসিসি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দোরগোড়ায়। এ নির্বাচন সামনে রেখে নাগরিকদের প্রশ্ন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় সংসদ সদস্যদের কাজ কী। তারা নাগরিকদের কী ধরনের সেবা দেন। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে তারা সমন্বয়ই বা করেন কীভাবে?

সিটি করপোরেশন এলাকায় তো এমপিদের কাজ করার মতো কিছু নেই। সব কিছুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা করেন। তারপরও নির্বাচনী এলাকার যেসব অবকাঠামো উন্নয়ন করা দরকার ছিল, সেগুলোর জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনে ডিও দিয়েছি। করপোরেশনের মেয়রসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করেছি।- রাশেদ খান মেনন

আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশন এলাকায় নাগরিক সেবায় সব কাজই করবেন মেয়র ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর। সিটি করপোরেশন এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্যদের ভূমিকা নেই বললেই চলে। তারা কিছু ক্ষেত্রে নিজ এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দেন। মন্ত্রণালয় যদি সেই ডিও আমলে নেয়, তাহলে আইন অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ পায় সিটি করপোরেশন। পরে সিটি করপোরেশন নিজেদের মতো করে দরপত্র আহ্বান করে কাজ সম্পন্ন করে।

সংবিধান অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্যদের কাজ আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখা। আর স্থানীয় পর্যায়ে উপদেষ্টার দায়িত্বে থেকে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় পরামর্শ দেওয়া। এর বাইরে সংসদ সদস্যদের তেমন কোনো কাজ নেই।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর তৃতীয় তফসিলে সিটি করপোরেশনের কার্যাবলির বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। এ তফসিল অনুযায়ী ২৮টি দায়িত্ব রয়েছে সিটি করপোরেশনের। তবে মোটাদাগে সিটি করপোরেশনের মূল কাজ সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, সড়কবাতি লাগানো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশক নিধন ও সিটি এলাকার হাটবাজার নিয়ন্ত্রণ।

আরও পড়ুন>> পরিষ্কার হলো বাইশটেকি-জয়নগর খাল, স্থানীয়দের স্বস্তি

এছাড়া সিটি করপোরেশনের কার্যাবলিতে রয়েছে ভাঙাচোরা ভবন সংস্কারে মালিককে নোটিশ দেওয়া, নগরবাসীর জন্য শৌচাগার নির্মাণ, পার্ক, উদ্যান, খোলা জায়গা রক্ষা, বিয়ে-তালাক রেজিস্ট্রি, হাসপাতাল ও মাতৃসদন পরিচালনা, ড্রেন পরিষ্কার, পুকুর ও সরকারি জলাধার রক্ষা, গোসল ও কাপড়চোপড় ধোয়ার স্থান নির্মাণ, খেয়া পারাপারে ঘাট নির্মাণ, বাজার ও কসাইখানা নির্মাণ, মৃত প্রাণীর দেহ অপসারণ, রাস্তা খননের অনুমতি, নতুন হোল্ডিং নম্বর, হোল্ডিং ট্যাক্স সার্ভিস কার্যপ্রণালি, হোল্ডিংয়ের নামজারি, ডিএএমএফএ, ট্রেড লাইসেন্স ও নবায়ন পদ্ধতি, জন্ম ও মৃত্যু সনদ বিতরণ, কবরস্থান ব্যবস্থাপনা ও কমিউনিটি সেন্টার বুকিং। এর বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবে সিটি করপোরেশন। তবে তা হতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী।

সংবিধান অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্যের কাজ হচ্ছে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখা। আর সিটি করপোরেশনের কাজ হচ্ছে নগরে অবকাঠামো উন্নয়ন করা। তবে এ অবকাঠামো উন্নয়নে সব সময়ই স্থানীয় সংসদ সদস্যের মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া সংসদ সদস্যরা ডিএনসিসিতে কোনো ডিও দিলে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।- সেলিম রেজা

বর্তমানে দেশে ১২টি সিটি করপোরেশন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় জাতীয় সংসদের আসন রয়েছে ১৬টি (ঢাকা-২, ঢাকা-৪, ঢাকা-৫, ঢাকা-৬, ঢাকা-৭, ঢাকা-৮, ঢাকা-৯, ঢাকা-১০, ঢাকা-১১, ঢাকা-১২, ঢাকা-১৩, ঢাকা-১৪, ঢাকা-১৫, ঢাকা-১৬, ঢাকা-১৭, ঢাকা-১৮)। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এসব আসনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব আসন থেকে শতাধিক প্রার্থী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নিজ নিজ এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে ভোটারদের দিচ্ছেন নানান ধরনের প্রতিশ্রুতি।

ঢাকা-৫ আসনের (যাত্রাবাড়ী-ডেমরা) সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম। তিনি ২০২০ সালের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হয়ে এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এবার তিনি দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচনী এলাকায় নাগরিকদের কাছে ভোট চাচ্ছেন তিনি। নির্বাচিত হতে পারলে বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু তার এসব প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু না যেতেই ঢাকায় চোখ রাঙাচ্ছে কিউলেক্স মশা

কাজী মনিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্যের সীমাবদ্ধতা জানি। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় সংসদ সদস্যদের কিছু করা আরও কঠিন। তারপরও নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেসব সমস্যা দেখেছি, তা ডিও লেটারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বা সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছি। সিটি করপোরেশন সেগুলো সমাধান করেছে। অর্থাৎ, নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেসব উন্নয়ন করা দরকার, সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় করেই সব করছি।’

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি। দলটির শীর্ষ নেতা রাশেদ খান মেনন ঢাকা-৮ আসনে তিন দফায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু এবার ওই আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তাই বরিশালের একটি আসন থেকে তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

দীর্ঘ ১৫ বছরে ঢাকা-৮ আসনে কী উন্নয়ন করেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে রাশেদ খান মেনন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এলাকায় তো এমপিদের কাজ করার মতো কিছু নেই। সব কিছুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা করেন। তারপরও নির্বাচনী এলাকার যেসব অবকাঠামো উন্নয়ন করা দরকার ছিল, সেগুলোর জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশনে ডিও দিয়েছি। করপোরেশনের মেয়রসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করেছি।’

ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউ মার্কেট, হাজারীবাগ এলাকা নিয়ে ঢাকা-১০ আসন। ২০২০ সালে এ আসনে উপ-নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ব্যবসায়ী নেতা মহিউদ্দিন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকায় তাকে তেমন দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন ভোটাররা।

কলাবাগানের ডলফিন রোডের বাসিন্দা আবুল বাশার বলেন, ‘নাগরিকদের সব কাজ সিটি করপোরেশনই করে। প্রয়োজনে বিচার-আচার স্থানীয় কাউন্সিলরই করেন। এখানে এমপি আছেন কি না তা জনগণ জানেও না। এমপি জনগণের কাজে লাগে না। ফলে এমপিও জনগণের সঙ্গে দেখা করেন না।’

গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর ফার্মগেটে নান্দনিক নকশার পদচারী সেতু উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এ অনুষ্ঠানে পদচারী সেতু সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী আনোয়ারা পার্কের অবকাঠামো উন্নয়নে ডিএনসিসিকে প্রকল্প নেওয়ার আহ্বান জানান স্বরাষ্টমন্ত্রী।

জবাবে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য তার নির্বাচনী এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে খুবই আন্তরিক। রাস্তাঘাট সংস্কার, সড়কবাতি স্থাপনসহ যে কোনো সমস্যা হলে তিনি ডিএনসিসিকে জানান। ডিএনসিসি দ্রুততম সময়ে এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করে।

জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী একজন সংসদ সদস্যের কাজ হচ্ছে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখা। আর সিটি করপোরেশনের কাজ হচ্ছে নগরে অবকাঠামো উন্নয়ন করা। তবে এ অবকাঠামো উন্নয়নে সব সময়ই স্থানীয় সংসদ সদস্যের মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া সংসদ সদস্যরা ডিএনসিসিতে কোনো ডিও দিলে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।’

এমএমএ/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।