৭ খুনে তিন র‌্যাব কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিশ্চিত


প্রকাশিত: ০৮:১৮ এএম, ১৯ জুলাই ২০১৪

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত অপহরণ ও খুনের ঘটনায় র‌্যাব-১১ এর অধিনায়কসহ তিন কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি এখন নিশ্চিত। ইতিমধ্যে মেজর আরিফ ও এমএম রানা ঘটনার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের গডফাদার নূর হোসেনের সঙ্গে মাত্র ১২ লাখ টাকায় এই খুনের চুক্তি করেন র‌্যাব-১১ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন। পরে তার সঙ্গে যোগ দেন আরেক কোম্পানি কমান্ডার এমএম রানা। ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ।

মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে নূর হোসেনের সঙ্গে হত্যা পরিকল্পনা ও চুক্তি করেন মেজর আরিফ হোসেন। র‌্যাব সদর দফতরকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে র‌্যাব-১১ এর তিন কর্মকর্তা ওই অভিযান চালান। অবশ্য ঘটনার পরদিন ২৮ এপ্রিল ভোর ৫টায় র‌্যাব সদর দফতরে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন মেজর আরিফ হোসেন। জেরার মুখে মেজর আরিফ ঘটনার আদ্যপান্ত খুলে বলতে বাধ্য হন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পুরো সময়টির ভিডিও ধারণ করে র‌্যাব সদর দফতর। সাতজনকে অপহরণ ও হত্যা করে লাশ গুমের আগে-পরে তিন র‌্যাব কর্মকর্তার মোবাইল ফোনালাপও সংগ্রহ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও, মোবাইল ফোনালাপের অডিও রেকর্ডসহ আনুষঙ্গিক বেশকিছু প্রামাণ্য দলিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে বৃহস্পতিবার দেয়া হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

র‌্যাব-১১ এর সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফসহ জড়িত র‌্যাব কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তাদের মোবাইল ফোনালাপের বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রধান শাজাহান আলী মোল্লা বলেন, বিষয়টি এখন তদন্তাধীন। তাই এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকাই তিনি সমীচীন মনে করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির কাছে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বেশকিছু তথ্যপ্রমাণ দিয়েছেন। তারা সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিটির সামনে বলেছেন, সাতজনকে অপহরণের সঙ্গে র‌্যাব-১১ এর তিন কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি র‌্যাব সদর দফতর জানার পরপরই সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়। এরপরই ওই তিন কর্মকর্তাকে নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়।

তদন্ত কমিটি সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত করতে গিয়ে তারা জানতে পেরেছেন, নৃশংস ও চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার প্রধান পরিকল্পনাকারী নূর হোসেন। কিন্তু ঘটনার পর প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের পরিবার মামলা করতে গেলে পুলিশ প্রথমে নূর হোসেনের নাম এহাজার থেকে বাদ দিতে বলেছিল। কারণ নারায়ণগঞ্জের একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ফতুল্লা থানায় তৎকালীন ওসি আক্তার হোসেনকে ফোন করে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা নিতে নিষেধ করেন। এছাড়া ওই রাজনৈতিক নেতা ওসিকে মামলায় প্রয়োজনীয় ফাঁক রাখতে বলেন। যাতে অন্য কাউকে মামলায় জড়ানো যায়। মামলায় প্রয়োজনীয় ফাঁক রাখার জন্য ওসি ওই রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা ঘুষও নেন।

তদন্ত কমিটির একজন সদস্য জানান, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তার রাজনৈতিক কর্মী আবু সুফিয়ানকে এ ঘটনায় ফাঁসানোর চেষ্টাও করা হয়েছে। ঘটনার পর প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যানকেও বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে শহীদ চেয়ারম্যানকে দিয়ে শেখানো কথা বলিয়ে নেয়া হয়েছে।

তদন্ত কমিটি সূত্র জানিয়েছে, তদন্তে বেরিয়ে এসেছে সাতজনকে যে র‌্যাবই অপহরণ করেছে তা নারায়ণগঞ্জের তৎকালীন পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলামসহ একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা নিশ্চিত হয়েছিলেন। কিন্তু অপহরণের পরপরই সাতজনকে হত্যা করায় অপহৃতদের উদ্ধারে র‌্যাব সদর বা পুলিশের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি।

তদন্ত কমিটির একজন সদস্য বলেন, র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান তাদের যেসব তথ্য-উপাত্ত দিয়েছেন তার মধ্যে তিন র‌্যাব কর্মকর্তার ফোনালাপের রেকর্ড, এসএমএস ও জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও রয়েছে।

কথোপকথনের রেকর্ড পর্যালোচনা করে তারা দেখেছেন, ২৭ এপ্রিল ঘটনার দিন থেকে র‌্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ একটি বিশেষ ল্যান্ডফোন নম্বর ব্যবহার করে মেজর আরিফ ও এমএম রানার সঙ্গে কথা বলেন। আর মেজর আরিফ ও এমএম রানা তাদের সরকারি নম্বর বাদ দিয়ে রেজিস্ট্রেশনবিহীন একাধিক মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেন। অনেক গোপনীয় কথা তারা ফোনে না বলে একে অপরকে এসএমএসের মাধ্যমে বিশেষ বার্তা পাঠান।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সূত্রে ওই সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তার কথোপকথনের বিষয়বস্তু জানা গেছে। এতে দেখা যায় ২৭ এপ্রিল রাত ১টা ৩৬ মিনিটে মেজর আরিফ ও লে. কর্নেল তারেক সাঈদের কথোপকথন ছিল এ রকম :
লে. কর্নেল তারেক : হ্যালো
মেজর আরিফ : স্যার
লে. কর্নেল তারেক : কাজটা কি করে ফেলস?
মেজর আরিফ : শুনতে পাচ্ছি না স্যার (লাশ ডোবানোর জন্য নদীর মাঝখানে থাকায় মোবাইল ফোনে বাতাশের শোঁ শোঁ শব্দ আসছিল)
লে. কর্নেল তারেক : কাজটা কি শেষ?
মেজর আরিফ : জি স্যার। ফিনিস।
লে. কর্নেল তারেক : তোমাকে জিয়া স্যার (এডিজি অপস) ডাকসে?
মেজর আরিফ : আমাকে এডিজি স্যার ফোন করেছিল। র‌্যাব সদর দফতরে যেতে বলছে।
লে. কর্নেল তারেক : তুমি ফোন ধরলা কেন?
মেজর আরিফ : কি করব স্যার? বারবার ফোন দিচ্ছে।
লে. কর্নেল তারেক : তোমাকে না বললাম ফোনটা ব্যাটালিয়নে রেখে যাবা? ফোন নিয়ে গেছ কেন?
মেজর আরিফ : এবার ফোন করলে তাহলে কি বলব স্যার?
লে. কর্নেল তারেক : শোন, আমাকে ফোন করলে বলব আরিফকে মুন্সীগঞ্জের দিকে টহলে পাঠিয়েছি। তোমাকে ফোন করলেও তাই বলবা।
মেজর আরিফ : জি স্যার, তাই বলব।
লে. কর্নেল তারেক : রানার (লে. কমান্ডার এমএম রানা) সঙ্গে কথা হয়েছে?
মেজর আরিফ : হ্যাঁ হয়েছে।
তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, ২৮ এপ্রিল ভোর ৫টায় র‌্যাব সদর দফতরে মেজর আরিফকে ডেকে আনা হয়। সেখানে মেজর আরিফ র‌্যাব কর্মকর্তাদের দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হন। জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও তদন্ত কমিটির কাছে জমা দিয়েছেন র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির ওই সদস্য বলেন, কমিটির সাতজন সদস্য মিলে ভিডিওটি দেখেছেন। এতে দেখা যায়, আরিফ কিছুটা বিষণ্ন মুখে কর্নেল জিয়াউল আহসানের টেবিলের সামনে বসে আছেন। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ ছিল এ রকম :
এডিজি অপস : সাতজনের অপহরণের বিষয়টি খুলে বলো।
মেজর আরিফ : স্যার আমি কিছু জানি না।
এডিজি অপস : লুকিয়ে কোনো লাভ হবে না। ঘটনার বিষয়ে সব প্রমাণ আমার হাতে আছে। বলো এই কাজটা কেন করলা?
মেজর আরিফ : আমি সিও’র (লে. কর্নেল তারেক সাঈদ) সঙ্গে কথা বলব।
এডিজি অপস : কেন, তার সঙ্গে কথা বলতে হবে কেন?
মেজর আরিফ : সিও’র সঙ্গে কথা বলে উত্তর দিতে পারব।
এডিজি অপস : দেখ আমার কাছে কি ঘটেছে সব খুলে বলো। মুখোশ খুলে কথা বলবা। তা না হলে তোমাকে এখনই কোয়ার্টার গার্ড করব। বেশি চালাকি করলে পুলিশের হাতে তুলে দেব। বলো কি হয়েছে?
মেজর আরিফ : সিও স্যার যা বলেছেন তাই করেছি।
এডিজি অপস : এত বড় একটা জঘন্য কাজ কেন করলা?
মেজর আরিফ : (মাথা নিচু করে বসে। কোনো উত্তর নেই।)
এডিজি অপস : কি ভেবেছিলে? কেউ কিছু জানতে পারবে না। এত সহজ? সব খুলে বলো? কত টাকা নিয়ে এই কাজ করেছ?
মেজর আরিফ : সিও স্যার ওদের এর আগেও তুলে নিতে বলেছিল। কিন্তু দু’বার চেষ্টা করেও পারিনি বলে আমাকে খোঁটা দিত। বকাবকি করত।
এডিজি অপস : নূর হোসেনের সঙ্গে কি কথা হয়েছে তোমার? কত টাকা দিয়েছে?
মেজর আরিফ : কিছুদিন আগে নূর হোসেন ১২ লাখ টাকা আমার নামে এফডিআর করে দিয়েছে। আর কোনো টাকা নেইনি।
সূত্র জানিয়েছে, ভিডিওতে দেখা যায়, জিজ্ঞাসাবাদের সময় মেজর আরিফ কথা গোপন করার চেষ্টা করলে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান লে. কর্নেল তারেক সাঈদকেও ফোন করেন। ফোনে তিনি তাকে বলেন, ‘তারেক, তুমি আরিফকে সব কথা খুলে বলতে বল। সে কিন্তু কিছুই বলছে না। সব লুকানোর চেষ্টা করছে।’
এরপর কর্নেল জিয়া মোবাইল ফোনটি মেজর আরিফকে ধরিয়ে দেন। মেজর আরিফ তারেক সাঈদের সঙ্গে ওই মোবাইল ফোন দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন।

সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কমিটির কাছে যে ফোনালাপের অডিও রেকর্ড দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, ঘটনার দিন প্রধান সন্দেহভাজন নূর হোসেনের সঙ্গে মেজর আরিফের মোবাইল ফোনে দফায় দফায় কথা হয়। নূর হোসেন সাতজনকে খুনের পর কিভাবে লাশ গুম করতে হবে তার নির্দেশনা দেন। ঘটনার সঙ্গে র‌্যাবের জড়িত থাকার বিষয়ে চারদিক থেকে অভিযোগ আসতে থাকলে গ্রেফতার হওয়ার আগে লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ ও এমএম রানা নিজেদের মধ্যে কয়েক দফা মোবাইল ফোনে কথা বলেন।

তদন্ত কমিটির কাছে নূর হোসেন ও নারায়ণগঞ্জের একজন রাজনৈতিক নেতার কথোপকথনের অডিও রেকর্ডও দেয়া হয়েছে। ওই রেকর্ডে দেখা যায়, সাতজনকে অপহরণের পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে নূর হোসেন ও নারায়ণগঞ্জের একজন রাজনৈতিক নেতা ধানমণ্ডিতে সরকারদলীয় একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার বাসায় চলে যান। তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্য বলেন, র‌্যাব সদর দফতর থেকে পাওয়া ফোনালাপের অডিও রেকর্ড ও জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও তদন্ত প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে অনেকটা সহায়তা করবে। এসব বিশ্লেষণ করে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত সংযুক্ত করে খুব শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হবে। সূত্র : যুগান্তর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।