পর্ব-২

রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে চলে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তর

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:২৮ এএম, ২৮ নভেম্বর ২০২৩
নওশাদ থেকে চম্পা

পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর তথ্য মতে, দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ১২ হাজার ৬২৯ জন। এছাড়া ৮৫ হাজার ৯৫৭ জন মানুষ পুরুষ না কি নারী অথবা তৃতীয় লিঙ্গের সে বিষয়ে কোনো কিছুই শনাক্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। ফলে দেশজুড়ে যেসব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ দেখা যায় তাদের সবাই প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় লিঙ্গের কি না তা নিয়েও সন্ধিহান বলছে পুলিশ। সম্প্রতি এক তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের এক চক্রের সন্ধান পায় ঢাকা জেলা পিবিআই।

পুলিশ বলছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত এক যুগে বহু মানুষকে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তর করা হয়েছে। ভুয়া চিকিৎসক ও অসাধু কিছু চিকৎসকরা অর্থের লোভে পড়ে নানা প্ররোচনায় পড়া কিছু মানুষকে অপারেশন ও বিভিন্ন ধরনের হরমোনাল ইনজেকশন দিয়ে শারীরিক পরিবর্তন করান। ফলে দেশে যত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছে তাদের মধ্যে প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা আরও খুব কম হতে পারে।

ঢাকার ধামরাই থানায় মানব পাচার ও প্রতিরোধ আইন এবং বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইনে করা এক মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মো. হাদিউজ্জামান নামের এক ভুয়া চিকিৎসককে গ্রেফতার করে পুলিশ। হাদিউজ্জামানের দেওয়া তথ্য ও পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া ডাক্তার ও অসাধু ডাক্তাররা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রূপান্তর করার তথ্য।

ঢাকা জেলা পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসা পেশায় কোনো সনদ না থাকলেও ২০১২ সাল থেকে মো. হাদিউজ্জামান দেশের বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তর করেন। রাজধানীর গুলশানের নিকেতন এবং রামপুরা থানাধীন এলাকায় তার একটি বাসায় অপারেশন করতেন। এছাড়াও খুলনা, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, যশোরে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের জন্য অপারেশন করতেন।

শুধু চিকিৎসকের সনদ না থাকা ভুয়া চিকিৎসক মো. হাদিউজ্জামানাই নয়, তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের জন্য অপারেশন করেন এমন আরও ৬ থেকে ৭ জনের নাম পেয়েছে পুলিশ। এদের মধ্যে ২-৩ জন রয়েছেন এমবিবিএস ডাক্তার। আর বাকি অধিকাংশই কোনো চিকিৎসক নয়। তাদের কোনো চিকিৎসক সনদও নেই। ঢাকার বেশ কয়েকটি জায়গায় এদের চলে এই তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের কাজ।

জানা গেছে, বর্তমানে যশোরের মনিরামপুর থানায় একটি ক্লিনিকে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের কাজ চলে। রাজধানীর মিরপুর-১ নাম্বারে একটি মার্কেটের একটি তলায় এই কাজ করেন একজন এমবিবিএস ডাক্তার। রাজধানীর শ্যামলী, মিরপুর, রামপুরা এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের জন্য অপারেশন করা হয়। যশোরের মনিরামপুর, বসুন্দিয়া, বাগেরহাটের চিতলমারী, খুলনার রূপসা এলাকায়ও তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তর করা হয়। এসব স্থানে কোন কোন চিকিৎসক জড়িত রয়েছে তাদের তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের বিষয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. কুদরত-ই-খুদা জাগো নিউজকে বলেন, কথিত চিকিৎসক হাদিউজ্জামানকে গ্রেফতারের পর আমরা বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও বেশ কয়েকটি ক্লিনিকে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের জন্য অপারেশন করা হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন আছে ভুয়া চিকিৎসক এবং কয়েকজন এমবিবিএস ডাক্তার। তাদের সবার ব্যাপারে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি এবং ক্লিনিকগুলোর ও তথ্য সংগ্রহ করছি। আমরা জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।

চক্রের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল আইজিপি) বনজ কুমার মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের একটি চক্রের তথ্য আমরা পেয়েছি। এ চক্রে যারাই জড়িত থাকবে তাদের সবাইকে আইনের আওতা আনা হবে।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, চিকিৎসাশাস্ত্রে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে কিংবা বৈধ সনদ ছাড়া চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়া অবৈধ ও বেআইনি। ফলে যারা ভুয়া ডাক্তার সেজে অপারেশন করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষে রূপান্তর করছেন, তারা অপরাধ করছেন। আর যারা বৈধ সনদ থাকার পরও জেন্ডার পরিবর্তনের অপারেশন করছেন তারাও অপরাধ করছেন। কারণ বাংলাদেশের আইনে জেন্ডার পরিবর্তন বৈধ নয়।

সমাজে এর বিরূপ প্রভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য রাষ্ট্র নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা তৈরি করেছে। এরপরও যারা নিজেদের পরির্তন করছেন এবং যেসব ডাক্তাররা এর সঙ্গে জড়িত তারা সমাজে ভিন্ন একটি ব্যবস্থা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে করে জেন্ডার পরিবর্তন করা মানুষটি যেই পরিবারটিতে ছিল সেই পরিবারটিও ভাসমান হয়ে যায়। সমাজের মানুষও তাদের একটু আলাদা দেখতে থাকে।

তৃতীয় লিঙ্গের অধিকাংশ মানুষ এখনো অন্যের কাছ থেকে টাকা তুলে জীবনজীবিকা চালান। অনেকে নানা অপরাধেও জড়িয়ে পড়েন। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি কৃত্রিম উপায়ে বাড়ানো হয় তাহলে একদিকে সমাজে জেন্ডার ভারসাম্যহীনতার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে তারা আরও নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও মনে করেন এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ।

ভুয়া ডাক্তার ও অসাধু ডাক্তাররা দীর্ঘদিন ধরে অপারেশন করে তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তার করা ও তাদের বিষয়ে পদক্ষেপের বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্টার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. লিয়াকত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বিএমডিসির পক্ষে একা দুই একটা অভিযান চালিয়ে এটাকে পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে না। এরজন্য আইনকে আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আইনে যাতে কোনো ফাঁক-ফোকর না থাকে। মনিটরিং করা আলাদা কার্যক্রম যা বিএমডিসির সীমিত স্টাফ দিয়ে করা সম্ভব নয়। কারণ বিএমডিসির কাজ শুধু এটা নয়। তাছাড়া বিএমডিসির নিজস্ব যেমন অফিস নেই আবার বিভাগীয় পর্যায়ে যেই অফিস হওয়ার কথা সেটাও নেই। ফলে সারাদেশকে ঢাকা থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। আমাদের সক্ষমতাটাও বুঝতে হবে।

আরএসএম/এমআইএইচএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।