কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

‘সাফল্য’ দেখাতে বাড়তি আলু উৎপাদনের তথ্যেই বিপত্তি

নাজমুল হুসাইন
নাজমুল হুসাইন নাজমুল হুসাইন , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২৬ এএম, ০৬ নভেম্বর ২০২৩
জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

গত মৌসুমে দেশে আলুর উৎপাদন অভ্যন্তরীণ চাহিদার চেয়েও প্রায় ২৪ লাখ টনের মতো বেশি বলে জানিয়েছিল সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। এরপরও ‘সংকট’ দেখিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী আলুর দাম ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শেষমেশ আমদানির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এর পর থেকেই বাড়তি উৎপাদনের ওই সাফল্যের তথ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে।

উৎপাদন উদ্বৃত্ত হলে আমদানির প্রয়োজন হচ্ছে কেন- এমন প্রশ্ন বিশ্লেষকদেরও। তারা বলছেন, ‘মিথ্যা সাফল্য’ দেখাতে সব সময় বাড়তি উৎপাদনের তথ্য দিচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এবছরও সেটা হয়েছে, যা চলমান আলু সংকটের বড় কারণ। স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন বাড়লে দাম কমে আসে। অথচ উদ্বৃত্ত আলুর দাম বেড়েই চলছে। মানে অধিদপ্তরের হিসাবে গলদ আছে।

আরও পড়ুন>> চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি আলুর, রপ্তানিতে সমাধান খুঁজছে সরকার

চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ার পরও আলু আমদানির সিদ্ধান্ত সঠিক পদক্ষেপ বলে মানতেও নারাজ ওইসব বিশ্লেষক। তারা বলছেন, মিথ্যা সাফল্য দেখাতে গিয়ে এবছর আলু নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা ব্যাহত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সংকট থাকলেও সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ কারণেই সরকারি পদক্ষেপ কিংবা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মতো বিষয়গুলোও সুপরিকল্পিত ও নির্ভুল নয়। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে, ভবিষ্যতে কৃষকদেরও গুনতে হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গত আলু উৎপাদন মৌসুমের শেষে (২০২২-২৩ অর্থবছর) এক কোটি ১২ লাখ টন আলু উৎপাদনের তথ্য দিয়েছিল। এ উৎপাদনের তথ্য আবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে মিলিয়ে চূড়ান্ত করতে হয়। পরবর্তীসময়ে চূড়ান্ত উৎপাদনের পরিমাণ বিবিএসে কম থাকায় ডিএই পরিসংখ্যান সামঞ্জস্য রাখতে উৎপাদন কমিয়ে এক কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার টন চূড়ান্ত করে। শেষ হিসাবেও অভ্যন্তরীণ চাহিদার তুলনায় আলুর উৎপাদন প্রায় ২৪ লাখ টন বেশি হয়। কারণ দেশে প্রতি বছর সর্বোচ্চ ৯০ লাখ টন আলুর চাহিদা রয়েছে।

ডিএই যত বলেছে, এত আলু যদি উৎপাদন হয় তবে এবছরও আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা। এখন তাহলে এ আলুগুলো কোথায় গেলো? আমরা শুরু থেকে বলেছি, এবার আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। সেটা কেউ শোনেনি।- বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু

যদিও ব্যবসায়ীরা শুরু থেকে এবছর আলুর উৎপাদন কমেছে বলে দাবি করে এসেছেন। তাদের দাবি, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়। অর্থাৎ, ডিএই ও ব্যবসায়ীদের তথ্যে ফারাক প্রায় ২০ লাখ টন। চলতি মৌসুমের শুরু থেকে মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানিয়ে কয়েক দফা এমন দাবি করেছে হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। তবে তাদের তথ্য আমলে নেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুন>> আলুর দামে আগুন, আমদানিতে সমাধান খুঁজছে সরকার

এতদিন ডিএইর উদ্বৃত্ত আলু উৎপাদনের তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আলু আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে সরকার। অথচ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আরও প্রায় দেড় মাস আগে সংকট মোকাবিলায় আলু আমদানি করতে চেয়েছিল। তখন উৎপাদন সঠিক রয়েছে বলে কৃষি মন্ত্রণালয় অনুমতি দেয়নি। এতদিন আমদানি না হওয়ায় প্রভাব পড়েছে এই কৃষিপণ্যের বাজারে। খুচরায় ভোক্তাকে আলু কিনতে গুনতে হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা।

পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ৩০ অক্টোবর আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওইদিন থেকেই অনুমোদনপত্র দেওয়ার কথা জানান কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। এরপর ভুল পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বছরের পর বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মিথ্যা সাফল্য দেখাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠতে শুরু করে। সরকারও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার বুলি দিলেও পরিস্থিতি সুখকর নয় বলে জানান বিশ্লেষকরা।

এসব বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিটি মহাপরিচালক তার সময়ে প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে বলে দেখাতে চান। বাস্তবতাটা মানতে চান না। প্রোডাকশনে কোনো পণ্য কম হয়েছে, এটা বলতে নারাজ। এজন্য প্রতি বছরই দেখা যায় আমাদের প্রোডাকশন বাড়ছে আর বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবটা এটাই। আমি মনে করি এটা সঠিক নয়। এবছর আলুর উৎপাদনও এভাবে বেশি দেখানো হয়েছে।’

একটি ফসলের উৎপাদন হুট করেই কমে-বাড়ে না। সামান্য কমবেশি হতে পারে। সেজন্য ধারাবাহিক উৎপাদনের তথ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে সেটা ডিএইর প্রতি বছরের উৎপাদনের তথ্য দেখলে বোঝা যায়। ডিএই আইল মেপে উৎপাদনের তথ্য হিসাব করে না। তথ্য শতভাগ নির্ভুল সেটাও দাবি করছি না। তবে ‘অধিকাংশ অ্যাকুরেট’।- ডিএই মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস

গবেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়, সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যে তথ্য দেয় সেটা বাস্তবের সঙ্গে অনেক সময়ই মেলে না। তাদের তথ্যের সঙ্গে আবার বিবিএসের তথ্যে বড় ধরনের ফারাক থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উৎপাদনের যে তথ্য দেওয়া হয় সেসব সামঞ্জস্যহীন।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে খাদ্য সংক্রান্ত যেসব তথ্য-উপাত্ত রয়েছে তাতে গরমিল আছে। দুঃখজনক যে, মোটাদাগের জিনিসগুলোর তথ্যে আগে কিছুটা সামঞ্জস্য ছিল। এখন তাও নেই। প্রকৃত উৎপাদন কতটুকু হলো, কতটুকু মানুষ খেয়েছে- এসব নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন তথ্য দেয়। মনে হয় হরেক রকম কথা শুনছি। সেজন্য সঠিক পরিকল্পনা হয় না, যা ভোক্তা ও চাষিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আলুর ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে।’

আরও পড়ুন>> একদিনেই এলো ৯৭৬ মেট্রিক টন আলু, খুচরায় কমছে দাম

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিএই যত বলেছে, এত আলু যদি উৎপাদন হয় তবে এবছরও আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা। এখন তাহলে এ আলুগুলো কোথায় গেলো? আমরা শুরু থেকে বলেছি, এবার আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। সেটা কেউ শোনেনি।’

যদিও আলু উৎপাদনের তথ্যে ‘বড় ধরনের কোনো গরমিল ছিল না’ বলে দাবি করেছেন ডিএইর মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সারাদেশে আমাদের (ডিএই) ১৪ হাজার ব্লক রয়েছে। একটি ইউনিয়নের তিনভাগের একভাগ একটি করে ব্লক। সেখানে একজন উপ-সহকারী রয়েছেন, যিনি উৎপাদনের তথ্য দেন।’

তিনি বলেন, ‘একটি ফসলের উৎপাদন হুট করেই কমে-বাড়ে না। সামান্য কমবেশি হতে পারে। সেজন্য ধারাবাহিক উৎপাদনের তথ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে সেটা ডিএইর প্রতি বছরের উৎপাদনের তথ্য দেখলে বোঝা যায়।’

আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে চাই, এখানে সিন্ডিকেট রয়েছে, তাদের গুদামে আলু রয়েছে। সেটা চিহ্নিত করা হোক। সেজন্য সব ব্যবসায়ীর ক্ষতি করা উচিত হবে না। সরকারের উচিত হিমাগার থেকে নির্ধারিত দামে আলু ছাড়ের ব্যবস্থা করা, যা এ সিন্ডিকেট করেছেন তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনা।- আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ড. ফেরদৌসী বেগম

মহাপরিচালক এ-ও বলেছেন, ‘ডিএই আইল মেপে উৎপাদনের তথ্য হিসাব করে না। তথ্য শতভাগ নির্ভুল সেটাও দাবি করছি না। তবে ‘অধিকাংশ অ্যাকুরেট’।

উৎপাদনের তথ্য সঠিক হলে সব সময় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের সঙ্গে কেন অমিল হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিসংখ্যান ব্যুরোর আরও বেশি সমস্যা রয়েছে। তাদের পাকিস্তান আমলের নির্ধারণ করা কিছু ক্লাস্টার রয়েছে, সেটা মেপে তারা উৎপাদনের তথ্য দেয়। অনেক জায়গায় এখন আর ফসলি জমি নেই। রাস্তাঘাট-ঘরবাড়ি হয়ে গেছে। তারপরেও তারা মান্ধাতার আমলের সিস্টেম নিয়ে পড়ে রয়েছে। এটা আমি কৃষি মন্ত্রণালয়কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।’

‘সাফল্য’ দেখাতে বাড়তি আলু উৎপাদনের তথ্যেই বিপত্তি

অযথা আলুর উৎপাদন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন আলুর দাম বেড়ে গেছে, অনেকে টকশোতে বলছে ডিএই তথ্য ভুল দিয়েছে। তারা কি মেপে দেখেছে, আমরা বেশি উৎপাদন দেখিয়েছি। এটা ধারাবাহিক বিষয়। চাইলেই হুট করে বড় সাফল্য দেখানো যায় না। বরং উৎপাদন গত বছরের চেয়ে এই অর্থবছরে কম দেখানো হয়েছে।’

আলুর দাম ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে বেড়েছে আবারও এমন দাবি করে বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘এবার আলুর চাহিদা ও সরবরাহে কোনো সামঞ্জস্য নেই। এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের নীতি-নৈতিকতার কোনো মিল নেই। কোথাও কখনো কোনো বাজারে আলু পাওয়া যায়নি এমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তারপরেও তারা সংকটের কথা বলছে। টাকা বেশি দিলে আলু বের করেছে।’

‘সাফল্য’ দেখাতে বাড়তি আলু উৎপাদনের তথ্যেই বিপত্তি

তিনি বলেন, ‘এখনো কোল্ডস্টোরেজে আলু রয়েছে। উৎপাদন বেশি না হলে এখন এত আলু কোথা থেকে এলো? আজও (বৃহস্পতিবার) বগুড়ার ডিসি এক হিমাগারে প্রচুর আলু মজুত পেয়েছেন। আসলে এটা একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের কারসাজি।’

ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে এসময় আলু আমদানির সিদ্ধান্ত ‘আত্মঘাতী’ মন্তব্য করেছেন আলু রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ও ফেরদৌস বায়োটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. ফেরদৌসী বেগম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আলু আমদানির সিদ্ধান্ত ‘মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার মতো’ হবে। এতে দেশে অবিক্রীত ২০ লাখ টন আলু পচে যাবে। ব্যবসায়ীদের বড় ক্ষতি হবে। বাড়তি আলু কোথায় যাবে?’

‘সাফল্য’ দেখাতে বাড়তি আলু উৎপাদনের তথ্যেই বিপত্তি

তিনি বলেন, ‘এ মাসেই চাষিদের আগাম আলু উঠবে। এসময় ভারত থেকে নতুন আলু এলে তারা দাম পাবে না। ক্ষেতেও আলু পচে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হতে পারে।’

ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে চাই, এখানে সিন্ডিকেট রয়েছে, তাদের গুদামে আলু রয়েছে। সেটা চিহ্নিত করা হোক। সেজন্য সব ব্যবসায়ীর ক্ষতি করা উচিত হবে না। সরকারের উচিত হিমাগার থেকে নির্ধারিত দামে আলু ছাড়ের ব্যবস্থা করা, যা এ সিন্ডিকেট করেছেন তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনা।’

এনএইচ/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।