রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
জ্বালানির চাহিদা পূরণে নিরাপত্তার ঝুঁকি কতটুকু?
রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরেনিয়াম বুঝে পাওয়ার মধ্য দিয়ে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্থাপনায় রুপ নিলো। দেশটির কারিগরি প্রযুক্তিগত ও অর্থ সহায়তায় এই প্রকল্পের কোনো অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাফ জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে ২০২৬ সালে।
ছয় দশক পর চালু হতে যাচ্ছে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। পাঁচ দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে তেমন অগ্রগতি হয়নি প্রকল্পটির। গত আট বছরে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার সরকার। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট পুরোপুরি চালু হলে দেশের ১০ শতাংশ জ্বালানির চাহিদা পূরণ হবে। কমবে জ্বালানির খরচও। দেশের জিডিপিতে এই প্রকল্প অবদান রাখবে দুই শতাংশ। এই প্রকল্পকে ঘিরে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি ঘটবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।
১৯৬১ সালে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেন। এরপর থমকে যায় কাজ। চার দশক পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেন। এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের বেশিরভাগ অর্থই ঋণ সহায়তা হিসেবে দিচ্ছে রাশিয়া।
আরও পড়ুন> প্রধানমন্ত্রী/রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পদক্ষেপ
২০১৩ সালে কাজ শুরু করে মাত্র ৮ বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শেষে প্রথম ইউনিটের জন্য রাশিয়া থেকে ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ বা ইউরেনিয়াম বুঝে পেয়েছে বাংলাদেশ। এখন জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার জন্য সঞ্চালন লাইনসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন হলেই শুরু হবে বিদ্যুৎ উৎপাদন।
গেলো ৫ অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জ্বালানি হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ৩৩তম ইউরেনিয়াম জ্বালানির যুগে প্রবেশ করলো দেশ। আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার সনদও পেয়েছে বাংলাদেশ।
পারমানবিক শক্তির ব্যবহার বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও জ্বালানি খরচ ও বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর কথা মাথায় রেখে সরকার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে।
এই প্রকল্প নিয়ে আশাবাদি স্থানীয়রা। তারা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আমাদের উপকারই হবে। তবে দুর্ঘটনা যেন না ঘটে সে বিষয়টির দিকে সরকারের বাড়তি নজর থাকলেই আমরা খুশি।
মো. মামুন সরকার নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি জাগো নিউজকে বলেন, রূপপরে এতো বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় এখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে। বিদ্যুতের চাহিদাও পূরণ করবে। তবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি যেন না থাকে সেটাই আমরা চাই।
আব্দুল মমিন নামে আরেকজন বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ঝুঁকি ও পরিবেশ দূষণ রোধ করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে বলা হচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে আশা করি পুরো উত্তরাঞ্চলের মানুষ সুফল পাবে। এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিস্ফোরণে মারা যায় বহু মানুষ। ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রে বিস্ফোরণের ঘটনা আজও ভুলতে পারেনি বিশ্ববাসী। সেই বিস্ফোরণে প্রাণ যায় ১৯ হাজার ৫০০ মানুষের। ভেঙে পড়ে ১০ লাখের বেশি সুউচ্চ ভবন।
রূপপুরের মত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য কতটুকু নিরাপদ সে প্রসঙ্গে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বাধুনিক ভিভিইআর প্রযুক্তি ব্যবহৃত হওয়ায় এখানে ঝুঁকি কম। তারপরও যদি দুর্ঘটনা ঘটে তবে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে না।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার কড়া নজরদারিতেতে নির্মিত হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সর্বাধুনিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই। প্রয়োজনের চেয়েও বেশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সাবধানতায় সংযোজিত ‘কোর ক্যাচার’। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতেও ছড়াবে না তেজস্ক্রিয়তা।
আরও পড়ুন> বিশ্বের ৩৩তম দেশ হিসেবে পারমাণবিক ক্লাবে বাংলাদেশ
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জেনারেল ডিজাইনার ও ঠিকাদার রাশিয়ার রোসাটম করপোরেশন। প্রকল্পটিতে দুটি ইউনিট স্থাপিত হবে। যার পারমাণবিক চুল্লিতে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফুয়েল পেলেট, ফুয়েল ক্ল্যাডিং, প্রেসার ভেসেল, প্রথম কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং (অভ্যন্তরীণ), দ্বিতীয় কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং (বাহ্যিক)। এরমধ্যে চুল্লির ভেতরের প্রথম কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিংটি ১ দশমিক ২ মিটার পুরু যা যেকোনো পরিস্থিতিতে তেজস্ক্রিয়তা পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে আরও নিরাপদ রাখার জন্য বাইরে দ্বিতীয় কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দ্বিতীয় কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিংটি দশমিক পাঁচ মিটার পুরু। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিমান দুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষা দেবে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যাতে ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং ৫ দশমিক ৭ টন ওজনের বিমানের আঘাতেও এটি অক্ষত থাকবে। এছাড়া শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেও সুরক্ষিত থাকবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তায় পরমাণু চুল্লির ৩০০ মিটারের মধ্যে থাকবে না কোনো বসতি। পরের ২০ কিলোমিটারে থাকবে ২৩টি বিকিরণ পর্যবেক্ষণকেন্দ্র। ৪৫টি স্থানে টানানো থাকবে মনিটর। এসব মনিটর থেকে প্রতিনিয়ত বিকিরণ মাত্রা জানতে পারবে সাধারণ মানুষ।
নিরাপত্তা ও পরিচালনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। পরিবেশবান্ধব নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যবহার করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। অতিরিক্ত সাবধানতায় সংযোজিত হয়েছে কোর ক্যাচার। নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে কোনোভাবেই তেজস্ক্রিয়তা বাইরে আসার সুযোগ নেই।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যেভাবে নকশা করা হয়েছে, যেখানে রেডিয়েশন জোন থাকবে সেখানে ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি থাকবে না। দেশের নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি মেনে পারমাণবিক মডেলের যেই নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চিয়তা আমরা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) শর্ত অনুযায়ী অর্জন করেছি। আমাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে দুটি ইউনিটের কাজ চলছে। সবাই যথাযথভাবে কাজ করলে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম ইউনিট ও দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৬ সালে উৎপাদনে যাবে। দুটি ইউনিটে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলেও জানান প্রকল্প পরিচালক।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিটি ইউনিটে রয়েছে রাশিয়ার ভিভিইআর রিয়্যাক্টর থ্রি প্লাস প্রজন্মের পরমাণু চুল্লি। পরমাণু বিজ্ঞানীরা এই রিএ্যাক্টর প্রেসার ভেসেলকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘হার্ট বা হৃৎপিন্ড’ বলে থাকেন। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার কোনো উদাহরণ এখন পর্যন্ত নেই।
আরও পড়ুন> ২০২৫ সালের মধ্যে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু: প্রধানমন্ত্রী
প্রকল্প এলাকায় রয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আর এই নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রকল্প এলাকায় সাধারণ মানুষের প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ২৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রকল্পটি কাজ করছেন তাদের পরিবারের লোকজনও প্রবেশ করতে পারে না বলে জানান সেখানকার শ্রমিকরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা পালন করা হয় প্রকল্প এলাকায়। এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারে না। আমরা আমাদের পরিবারের মানুষকেও আনতে পারি না।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেছেন, কোনো ধরনের ঝুঁকি যেন না থাকে তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে থ্রি প্লাস প্রজন্মের চুল্লি বসানো হয়েছে। বসানো হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কোর ক্যাচার। এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য চুক্তি করা হয়েছে। এতেও মানা হবে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ফুকুশিমা বা চেরনোবিল দুর্ঘটনার কথা চিন্তা করে এখানে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বে যারা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে কেউ চায় না যেন এমন দুর্ঘটনা ঘটুক। যার কারণে আধুনিক প্রযুক্তি ও কোর ক্যাচার ব্যবহার করা হচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ এখানে হাইড্রোজেন যাতে অক্সিজেনের সংস্পর্শে না আসতে পারে, নিষ্ক্রিয় করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উচ্চ তাপমাত্রায় সবকিছু যদি গলেও যায় কোর ক্যাচার আবদ্ধ করে ফেলবে। তিনি আরও বলেন, আগে যেখানে এক কন্টেইনমেন্ট বিল্ডিং থাকতো সেখানে এখন ডাবল রয়েছে। এতে বাহ্যিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও নিরাপদ থাকবে। তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলোর কোর ক্যাচারের মাধ্যমে যাতে পরিবেশে নির্গমনের সুযোগ না থাকে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
আরএসএম/এসএনআর/জেআইএম