বিশ্বের ৩৩তম দেশ হিসেবে পারমাণবিক ক্লাবে বাংলাদেশ
# পারমাণবিক যুগে বাংলাদেশ
# গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
# আগামী সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলক উৎপাদন
# জিডিপিতে দুই শতাংশ অবদান রাখবে রূপপুর প্রকল্প
পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেলসহ বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে বর্তমান সরকার। তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু মেগা প্রকল্পই নয়, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে পারমাণবিক দেশের মার্যাদায় বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছে।
১৯৬১ সালে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু করতে ফ্রান্স ও রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে সেটি বাস্তবায়ন করে যেতে পারনেনি তিনি। বঙ্গবন্ধু সেটি করে যেতে না পারলেও তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছেন।
এরই মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের জন্য রাশিয়া থেকে ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ বা ইউরেনিয়াম এসেছে। আজ (৫ অক্টোবর) আনুষ্ঠানিকভাবে এই জ্বালানি হস্তান্তর করা হবে। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ঐতিহাসিক এই কমিশনিংয়ের মধ্যদিয়ে বিশ্বের ৩৩তম ইউরেনিয়াম জ্বালানির যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। আর এতেই খুলবে জ্বালানির নতুন দ্বার। এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনের পর জিডিপিতে অবদান রাখবে দুই শতাংশ।
আরও পড়ুন>> ইউরেনিয়াম জ্বালানির যুগে প্রবেশের পথে বাংলাদেশ
জানা গেছে, ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরের বছর ১৯৬২ সালে বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এরপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দেশ স্বাধীনের ৫২ বছর পর তা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। রাশিয়া থেকে আসা ইউরেনিয়াম গত ২৯ সেপ্টেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছায়। এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের কাছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের মহাপরিচালক আলেস্কি লিখাচেভ এই ইউরেনিয়াম আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করবেন। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকবেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি। হস্তান্তর প্রক্রিয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে কর্তৃপক্ষ। রোসাটমের জ্বালানি প্রস্তুতকারী কোম্পানি টেভেলের একটি প্রতিষ্ঠান নভোসিবিরস্ক কেমিক্যাল কনসেনট্রেটস প্ল্যান্ট (এনসিসিপি) রূপপুরে এই জ্বালানি উৎপাদন করছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানকে ঘিরে উৎসবের সাজে সেজেছে ঈশ্বরদীর রূপপুর এলাকা। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সড়ক ও প্রকল্প এলাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের ছবি সংবলিত ব্যানার, ফেস্টুনসহ বিভিন্ন রঙের পতাকা শোভা পাচ্ছে। ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের জন্য দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের ছবিসহ সুসজ্জিত মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। একদিকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অন্যদিকে সাজসাজ রব। সবমিলিয়ে রূপপুর প্রকল্প এলাকা যেন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ঐতিহাসিক এই মুহূর্তের সাক্ষী হতে প্রকল্পের শ্রমিক থেকে শুরু করে সবাই উন্মুক হয়ে আছেন।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করছেন নাসির উদ্দিন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুই বছর ধরে এখানে কাজ করছি। বিশাল একটি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মাধ্যমে এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হচ্ছে। এটা আমাদের কাছে আনন্দের বিষয়।’
আরও পড়ুন>> সেপ্টেম্বরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে রূপপুরের বিদ্যুৎ
আশরাফুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ‘চার বছর ধরে এই প্রকল্পে কাজ করছি। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের জ্বালানি খাতে বেশ ভূমিকা রাখবে।’
জানা গেছে, ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে উচ্চপর্যায়ের রুশ প্রতিনিধিদল রূপপুরে এসেছে । প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করছেন মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ফলে পুরো প্রকল্প ও গ্রিনসিটি আবাসিক এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বুধবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান কবিতার ভাষায় বলেন, ‘পিতা চেয়েছিল পরমাণু যুগ শুরু হোক রূপপুরে, পিতার চাওয়া হয়েছে পূরণ কন্যার হাত ধরে। রূপপুর আজ রূপ পেয়েছে অর্জন অশেষ; এই না হলে শেখের বেটি সাবাস, সাবাস বাংলাদেশ।’
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের জিডিপিতে দুই শতাংশ অবদান রাখবে জানিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘সাধারণত নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে ১২ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। সে হিসাবে মাত্র ৭ থেকে ৮ বছরের মধ্যে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ একটা মাইলফলক। এসবই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। ইউরেনিয়াম আসার মধ্যদিয়ে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র পারমাণবিক স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।’
এদিকে গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানের পর আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর বলেন, ‘আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি। সবার যথাযথ কর্মপরিকল্পনা যদি ঠিক থাকে তাহলে আশা করছি আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে সংযোগ দিতে পারবো। এটা আমাদের টাইম লাইন। আমরা একা নয়, সবাই যদি আমরা যার যার দায়িত্ব পালন করি তাহলে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দিতে পারবো। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি উৎপাদনে গেলে প্রতিদিন জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে।’
আরও পড়ুন>> রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্প জিডিপিতে দুই শতাংশ অবদান রাখবে
তিনি বলেন, ‘প্রকল্প এলাকায় পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি এবং সংরক্ষণ করতে সেফটি ও ইন্টারন্যাশনাল অবলিগেশন সব মানা হয়েছে। ইউরেনিয়াম আনতে গিয়ে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি কমিশন ও রাশিয়ান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর শর্ত পূরণ করা হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক এলাকা আজ থেকে পারমাণবিক স্থাপনা হিসেবে গ্লোবালি রিকগনিশন পাবে।’
প্রকল্পের গ্রিনসিটি এলাকায় কথা হয় বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে। এ অর্জনে নিজেদের গর্বের অংশীদার মনে করে তারা বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য কত আনন্দ ও গর্বের তা বলে বোঝাতে পারবো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা চ্যালেঞ্জের মুখে প্রকল্পটি বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।’
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটিতে সাত হাজার পেশাদারসহ ৩০ হাজার দেশি-বিদেশি কর্মী কাজ করছেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে পারমাণবিক ক্লাবে প্রবেশ বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। কারণ এটি কার্বন নিঃসরণ হ্রাস লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। একই সময়ে এটি ফ্ল্যাশের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমিয়ে দেবে। আরএনপিপি প্রতিদিন ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর বৈশ্বিক উদ্যোগ নিশ্চিত করবে।
রাশিয়ান ঠিকাদার হিসেবে রোসাটম, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিটি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট নিয়ে গঠিত। মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরমাণু শক্তি কমিশন আরএনপিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। রাশিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি অ্যাটমস্টোএক্সপোর্ট প্রকল্পের অধীনে ১২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে। পারমাণবিক জ্বালানি রোসাটমের সহযোগী কোম্পানি টিভিইএল ফুয়েল তৈরি করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানি ক্রয় করে।
আরও পড়ুন>> ইউরেনিয়াম হস্তান্তর ঘিরে রূপপুরে উৎসবের আমেজ
ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট অনুসারে, পরমাণু শক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, ইউক্রেন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, সুইডেন, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ভারত, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলারুশ, স্লোভেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও আর্মেনিয়া। এবার যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের নামও। একবার পারমাণবিক জ্বালানি পাওয়ার প্ল্যান্টের চুল্লিতে লোড করা হলে এক বছরের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। এরপর চুল্লিতে পুনরায় জ্বালানি লোড করতে হবে।
জানা গেছে, প্রথম ইউনিট (১২০০ মেগাওয়াট) চালু করার জন্য ৭৫ টন ইউরেনিয়াম প্রয়োজন হবে। একবার জ্বালানি দেওয়ার পর ১৮ মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এরপর এক-তৃতীয়াংশ ইউরেনিয়াম অর্থাৎ ২৫ টন তুলে সেখানে নতুন করে লোড দিতে হবে। এরপর আবার ১৮ মাস চলবে। এভাবে ১৮ মাস পরপর আংশিক জ্বালানি পরিবর্তন করতে হবে। এক কেজি ইউরেনিয়াম প্রায় ১০০ টন কয়লার সমান তাপ উৎপাদনে সক্ষম। আর একই পরিমাণ তাপ তেলে উৎপাদন করতে হলে ৬০ টন ডিজেল প্রয়োজন হবে। যে কারণে এটি সহজে পরিবহনযোগ্য বিবেচনা করা হয়। এই জ্বালানি একবার লোড করে নিরবচ্ছিন্নভাবে ১৮ মাস বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ অন্য জ্বালানিতে পেতে হলে অনবরত সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হয়।
আরও পড়ুন>> রূপপুরে পৌঁছালো ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের রেডিয়েশন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। রেড়িয়েশনের মাত্রা মানুষের সহনশীল ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। আমরা ২৩টি রেডিয়েশন স্টেশন চালু করবো, সেখানে রেডিয়েশনের মাত্রা প্রদর্শিত হবে। যে কেউ দেখতে পারবেন। এসব স্টেশন ১৮ কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত থাকবে। আমরা দেখেছি ১২.৫ কিলোমিটার দূরে মনিটরিংয়ের প্রয়োজন নেই। বাসিন্দারা যেভাবে বসবাস করছেন সেভাবেই করতে পারবেন।
আরএসএম/ইএ/এমএস