রেলপথ নির্মাণে বাঁকে বাঁকে অনিয়ম
কোনো ভাউচার ছাড়াই সাধারণ চাহিদার নামে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে অনিয়মিতভাবে দুই কোটি ৮৩ লাখ ১১ হাজার ৬৫৩ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। দরপত্রে অংশ না নেওয়ার পরও বিধিবহির্ভূতভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয় এক কোটি ৩৯ লাখ ৯ হাজার ৮শ টাকার। প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পাথর কেনা হয়েছে ৬৭৬ দশমিক ০৭ ঘনমিটার। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ায় পরামর্শক খাতে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে তিন কোটি ৮৫ লাখ ২৬ হাজার টাকা।
ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেলওয়ে লাইন নির্মাণ প্রকল্পে উঠে এসেছে এমন অনিয়মের চিত্র। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ছাড়াও কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে কমিটি।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আইএমইডির প্রতিবেদন দাখিলের বিধান রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় সমাপ্তি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। জুন ২০১৯ সালে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এর পরেই সমাপ্তি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে আইএমইডি। আইএমইডির পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন প্রকল্পটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেন।
ঢালারচর রেলওয়ে স্টেশন/সংগৃহীত
আরও পড়ুন>> ঢালারচর রেললাইন প্রকল্পে ধীরগতি
আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেলওয়ে লাইন নির্মাণসহ কিছু প্রকল্পের সমাপ্তি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এসব প্রকল্পে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি পেয়েছি। এগুলো নিরসনে সুপারিশ করেছি সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ে। কোনোটা নিষ্পত্তি আবার কিছু বিষয়ে অবগতি করার জন্য বলেছি। কোনো প্রকল্পে এক মাস ও কিছু প্রকল্পে ১৫ দিন সময় দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সমাপ্ত হওয়া কিছু প্রকল্পে অডিট আপত্তিও দেখা গেছে, যা নিষ্পত্তি হয়নি। তবে এটার জবাব মন্ত্রণালয় দিতে পারবে। আমরা নিষ্পত্তির সুপারিশ করেছি মাত্র।’
প্রকল্পে যত অনিয়ম
আইএমইডির পর্যবেক্ষণে নানান অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকার পরও ঠিকাদারের চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। অননুমোদিত বিলম্বকালের জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ ঠিকাদারের কাছ থেকে সাড়ে সাত কোটি টাকা আদায়যোগ্য বলে মত দিয়েছে আইএমইডি।
আরও পড়ুন>> রেলের অনিয়ম রোধে এবার চবির ১৭ শিক্ষার্থীর অবস্থান
দরপত্রে অংশ না নেওয়ার পরও বিধিবহির্ভূতভাবে মেসার্স রোজলীন ট্রেডার্সের সঙ্গে এক কোটি ৩৯ লাখ ৯ হাজার ৮শ টাকার চুক্তি করা হয়। এই চুক্তি ও ঠিকাদার নিয়োগ গুরুতর অনিয়ম। প্রকল্পে পিপিআর/২০০৮ এর বিধি ৩৯(৪) লঙ্ঘন করে প্যাকেজ নম্বর ডাব্লিউডি-২ এর সময় বাড়ানো হয়। প্রকল্পে চুক্তির শর্তও লঙ্ঘন করা হয়, ফলে এ খাতে সরকারের ক্ষতি হয় ২২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।
রেললাইন/সংগৃহীত
আইএমইডির পর্যবেক্ষণে আরও উঠে এসেছে, প্রয়োজনের তুলনায় ৬৭৬ দশমিক ০৭ ঘনমিটার পাথর অতিরিক্ত কেনা হয়েছে। এতে সরকারের অপচয় হয়েছে ৪৫ লাখ ২৯ হাজার ৬৬৯ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ায় পরামর্শক খাতে তিন কোটি ৮৫ লাখ ২৬ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে। ওয়ে অ্যান্ড ওয়ার্কস ম্যানুয়ালের সেকশন ১৯০১ মোতাবেক মেজারমেন্ট বুক সংরক্ষণ করা হয়নি। অনিয়মিতভাবে ১৬ কোটি ১৫ লাখ ৫ হাজার ২০৩ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ডাব্লিউডি-৬ প্যাকেজে চুক্তি মূল্য অপেক্ষা অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে ২৩ লাখ ১০ হাজার ৭০৭ টাকা। ডাব্লিউডি-২ প্যাকেজের মাধ্যমে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রেল কোচ কেনায় সরকারের এক কোটি তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা অপচয় হয়েছে।
ভাউচার ছাড়াই চার কোটি টাকা বিল পরিশোধ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিম) অসীম কুমার তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাউচার ছাড়া বিল পরিশোধের কোনো সুযোগ নেই। এটা একটা অনিয়ম। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবো। এটা ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
আরও পড়ুন>> ‘খুঁজে বের করব, কাদের কারণে রেলে আস্থা হারিয়েছে মানুষ’
আইএমইডি প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা দক্ষদের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) নিয়োগ দেই। ভাউচার ছাড়া বিল পরিশোধের কথা নয়, হয়তো কোথাও আছে। ভাউচার যদি না পাওয়া যায় তখন দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেলওয়ে লাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তবে আইএমইডির সমাপ্ত প্রতিবেদন এখনো আমাদের হাতে আসেনি।’
পাবনা রেলওয়ে স্টেশন/সংগৃহীত
আইএমইডির সুপারিশ
প্রকল্পে আইএমইডি কিছু সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রকল্পে ব্যয় ৭৪ দশমিক ৪৬ এবং সময় ৮৪ দশমিক ২১ শতাংশ বেড়েছে। ভবিষ্যতে মূল অনুমোদিত ব্যয় ও সময়সীমার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও মন্ত্রণালয়কে সচেষ্ট থাকতে হবে। প্রকল্প যথাযথভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বাংলাদেশ রেলওয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের লক্ষ্যে জনবল নিয়োগসহ রুটে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে। রেললাইনের পাশে আগাছা-আবর্জনা অপসারণ ও ড্রেনগুলো সচল রাখার জন্য নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
আইএমইডির পরিদর্শনে উঠে এসেছে, প্রকল্পটি দুটি সেকশনে বিভক্ত। এর মধ্যে মাঝগ্রাম থেকে পাবনা পর্যন্ত সেকশনের দূরত্ব ২৫ কিমি ও পাবনা থেকে ঢালারচর পর্যন্ত সেকশনের দূরত্ব ৫৩ দশমিক ৮০ কিমি। প্রথম লটে সাতটি ও দ্বিতীয় লটে ছয়টি প্যাকেজের কার্যক্রম প্রকল্পের আওতায় সম্পাদন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, পাবনা জেলাকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর-পাটুরিয়া-ভাঙ্গা-জাজিরা-মাওয়া-ঢাকা পর্যন্ত রেলওয়ে সংযোগ স্থাপনের জন্য সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথমে ৯৮২ কোটি ৮৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয়ে অক্টোবর ২০১০ থেকে জুন ২০১৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা ছিল।
রেললাইন/সংগৃহীত
পরে প্রকল্পের নানান খাত যুক্ত হওয়ায় মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। একই সঙ্গে মেয়াদ বাড়ানো হয় জুন ২০১৬ পর্যন্ত। এরপর ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০১৮ পর্যন্ত দুই বছর বাড়ানো হয়। পরবর্তীসময়ে প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৩৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এছাড়া অক্টোবর ২০১০ থেকে জুন ২০১৯ মেয়াদে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য একনেক সভায় অনুমোদিত হয়।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত ৭৮ দশমিক ৮০ কিমি নতুন ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকার সঙ্গে বিদ্যমান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সংযোগ স্থাপন। এতে একটি নতুন এলাকা রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে এবং অতিরিক্ত যাত্রী চলাচল ও মালামাল পরিবহনের সুবিধা বাড়বে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে ও আঞ্চলিক সংযোগের ক্ষেত্রে একটি বিকল্প রেলপথ স্থাপন। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পাবনা জেলা শহর রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে এবং সহজভাবে ঢাকাসহ দেশের অন্য স্থানের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
এমওএস/এএসএ/জেআইএম