‘বাঁধ দিয়ে রেলপথ নির্মাণের চিন্তা সেকেলে’

সাইফুল হক মিঠু
সাইফুল হক মিঠু সাইফুল হক মিঠু
প্রকাশিত: ০৫:৩৫ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ছবি: সংগৃহীত

দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে রেল চলাচল শুরু হওয়ার কথা অক্টোবরে। গত আগস্টে সপ্তাহব্যাপী ভারী বর্ষণে নির্মাণাধীন এ রেললাইনের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যদিও কর্তৃপক্ষের দাবি খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। অক্টোবর মাসেই উদ্বোধন করা হবে।

এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মো. হাদিউজ্জামান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল হক মিঠু

জাগো নিউজ: ঢাকা থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যেতে নদীপথ, সড়কপথ ও আকাশপথে যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে। এরপরেও এই গন্তব্যে রেল সংযোগ করার যৌক্তিকতা কতটুকু?

ড. মো. হাদিউজ্জামান: পর্যটন কেন্দ্র করে এশিয়ার অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আমাদেরও পর্যটন খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা ছিল। বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত আছে, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আছে। পাহাড়, নদীসহ পর্যটনের সব আকর্ষণ আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে পর্যটন ব্যাপকতা লাভ করেনি। ঢাকা থেকে সড়কপথে কক্সবাজারে যেতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। সড়ক, নৌপথ ও আকাশপথে খরচও বেশি। এছাড়া সড়কপথে যানজটের ভোগান্তিতো আছেই। এসব বিবেচনায় নতুন এ রেল নেটওয়ার্কের ফলে ঢাকা-কক্সবাজার গন্তব্যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে।

শুধু পর্যটনই না, কক্সবাজারের লবণ শিল্প, শুঁটকি, পান ব্যবসার প্রসার হবে। কক্সবাজার থেকে এই পণ্যগুলো যদি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই, সেক্ষেত্রে রেল সংযোগের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হতে হবে। পৃথিবীর স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞরা এ প্রকল্পটার সম্ভাব্যতা যাচাই করেছেন। চট্টগ্রামের যে ইকোলজিক্যাল বিষয় আছে সেটা একটু অন্যরকম। এখানে বনাঞ্চল, পাহাড় ও জলাভূমি আছে।

এখানকার যে হাইড্রোলজি ডায়নামিকসের কথা আমরা বলি বা পানি প্রবাহের বিষয়, এটা বাংলাদেশের যে কোনো এলাকা থেকে ভিন্নতর। বাংলাদেশের অন্য জায়গায় যখন পানি প্রবাহিত হয়, সেটা উত্তর, দক্ষিণ বরাবর। এ কারণে যখন বাঁধ দিয়ে কোনো স্থাপনা তৈরি করা হয় তাতে সমস্যা হয় না।

আরও পড়ুন>> রেললাইন বেঁকে যায়নি, অক্টোবরেই উদ্বোধন: রেল সচিব

এই রেললিংক প্রকল্পটা এমন এক জলাভূমি দিয়ে করা হয়েছে যেখানে পানি প্রবাহের ডায়নামিক স্টাইল একেবারে ভিন্নতর। কারণ পশ্চিমে যেখানে উঁচু উঁচু পাহাড় আছে, সেখানে বৃষ্টির ফলে যখন পানি গড়িয়ে আসে, অনেক সময় ফ্ল্যাশ ফ্লাড হয়। এত দ্রুত বেগে পানি নামে। সেই পানিটা নেমে যাওয়ার জন্য ক্যানেল রিভার সিস্টেম কাজ করে। কিন্তু যখন সেখানে বাঁধ দিয়ে এই রেললাইনটা তৈরি করে ফেললাম, ফলে আমরা হাইড্রোলিক ডায়নামিকসকে বাধাগ্রস্ত করে ফেললাম। একটা পরিবর্তন এলো। প্রকৃতিকে যখন আপনি বাধা দেবেন, প্রকৃতি কিন্তু সেটা প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে। সেটি কিন্তু এখানে হয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডিতে এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট সঠিকভাবে হয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ রাখে।

জাগো নিউজ: জলবায়ু পরিববর্তন কি এতে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অতিবৃষ্টিতে এই রেলপথ ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আপনি প্রতিশোধের কথা বললেন, সেটা কেমন?

ড. মো. হাদিউজ্জামান: আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। এখানে শুধু বৃষ্টিপাত দেখলে হবে না। প্রকল্প এলাকায় বড় বড় নদী আছে। বাকখালী, সাঙ্গু, বা মাতামুহুরী প্রত্যেকটা নদী আমাদের বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের তলদেশ প্রতিবছর একটু একটু করে বাড়ছে। শুধু বৃষ্টিপাত না, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের তলদেশ যে ওপরে উঠছে এটার যে প্রভাব সেটাও কিন্তু বিবেচনায় নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে বলে আমি মনে করি।

jagonews24

পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা পানিটা ধারণ করার বিষয়টা বিবেচনা আনা হয়েছে কি না সেটা অনেক বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি আমরা যে ডিজাস্টার দেখলাম (রেললাইন বেঁকে যাওয়া ও পানিতে ডুবে যাওয়া) সেটা ওই এলাকার তিন কিলোমিটারের আশপাশে যারা থাকে তাদের জন্য একটা মরণফাঁদ হয়ে গেছে।

জাগো নিউজ: রেল বলছে ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি না। আবার যখন পরে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হবে তখন কী হবে?

ড. মো. হাদিউজ্জামান: এটা শুধু রেলের ক্ষতির বিষয় না। রেল যেটা বলছে সেটা একটা খোঁড়া যুক্তি। তারা বলছে, কয়েক কোটি টাকা দিয়ে তারা সংস্কার করে ফেলবে। আমরা শুধু রেলের ক্ষতি দেখছি। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার আশপাশে যারা থাকে তারা যে একটা দীর্ঘমেয়াদি ওয়াটার লগিং সমস্যার মধ্যে পড়ে গেলো এটার যে প্রভাব, এটা অপূরণীয় ক্ষতি। পশ্চিমে পাহাড়ি অঞ্চল এবং আমার রেল বাঁধের মধ্যে করলাম। মাঝখানে তারা (এলাকাবাসী) এখন ফাঁদে। এখানে যে জনবসতি আছে তারা অ্যাফেক্টেড হবে। এই অ্যাফেক্ট কোটি টাকার বিষয় না। এটা লং টার্ম অ্যাফেক্ট।

আরও পড়ুন>> চলতি বছরই রেল যাবে কক্সবাজার, বদলে যাবে পর্যটন

পাশাপাশি হাতির যে বিষয়টি, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য দিয়ে রেল যাবে বলছি। এ ধরনের বন্যায় বন্যপ্রাণীর ওপরেও ইফেক্ট পড়বে। পরিবেশ অধিদপ্তরও বলেছে এটা রেড ক্যাটাগরির একটা প্রকল্প। আইউসিএন বা উন্নত দেশের বিভিন্ন সংস্থা যারা আছে, যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করে তারাও বলছে এটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। সেখানে এ ধরনের প্রকল্প করতে গেলে আরও গভীর জনসম্পৃক্ততা দরকার ছিল। স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার দরকার ছিল। যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করে, হাইড্রোলিকস নিয়ে কাজ করে তাদের সম্পৃক্ত করার দরকার ছিল।

জাগো নিউজ: ছবিতে দেখেছি রেললাইনের নিচে ফাঁকা হয়ে গেছে। আগামীতে এই রেল দিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা দেখছেন কি না?

ড. মো. হাদিউজ্জামান: রেল যুক্তি দেখাচ্ছে লাইনে ওয়েল্ডিং করা ছিল না। কিন্তু আমি মনে করি, এটা ওয়েল্ডিংয়ের বিষয় না। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের কারণে নিচ থেকে মাটি, পাথর ও ব্যালাস্ট সব সরে গেছে। যেহেতু সে সাপোর্ট পায়নি নিচে, সে কিন্তু বেঁকে গেছে। তার ওয়েটেই সে বেঁকে গেছে। রেল বেঁকে গেলে যখন সংস্কার করবেন অর্থাৎ, আগের অবস্থায় নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন তখন এর টেম্পারমেন্ট নষ্ট হবে। যেহেতু রেল মেটালের তৈরি, এটার টেম্পারমেন্ট নষ্ট হতে থাকবে। দেখা যাবে বৃষ্টি না, অল্প তাপমাত্রায় আবার বেঁকে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হবে।

আমাদের রেলদুর্ঘটনার বড় কারণ লাইনচ্যুত হওয়া। যখন আমার রেলের টেম্পারমেন্টটা নষ্ট হয়ে যাবে তখন ডিরেলমেন্ট বা লাইনচ্যুতির একটা শঙ্কা তৈরি হবে। বলা হচ্ছে ১২০ কিলোমিটার গতিতে দোহাজারি থেকে কক্সবাজারের ট্রেন চালাবেন, তাহলে ট্রেনের ট্র্যাকগুলো ঝুঁকিমুক্ত হতে হবে। এখানে বাঁধ দিয়ে রেল করার যে পরিকল্পনা সেটা কতটুকু যৌক্তিক ছিল, এখন সেটাই একটা বড় প্রশ্ন।

জাগো নিউজ: বক্স, কালভার্ট করে কী ওই বিপর্যয় ঠেকানো যেত? বাঁধ দিয়ে রেল না করে অন্য কী উপায়ে করা যেত?

ড. মো. হাদিউজ্জামান: প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন আরও ৭-৮টা কালভার্ট দেওয়া হলে তাতেও নাকি এ ধরনের বিপর্যয় এড়ানো যেত না। এলাকাবাসী বলছে, ওই এলাকায় অল্প কিছু কালভার্ট আছে। পানিপ্রবাহ বা নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাহলে এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে বাঁধের ওপর রেল কেন করা হলো। আপনিই বলছেন ৭-৮টা কালভার্ট দিয়েও সমস্যা নিরসন করতে পারবেন না। এলাকাবাসীর অভিযোগ আমলে নিতে হবে। ১৯৯৭-৯৮ সালে চট্টগ্রামের দক্ষিণে যে সাইক্লোন হয়েছিল তখন জলোচ্ছ্বাসে পানির উচ্চতা অনেক বেশি ছিল। এখন এলাকাবাসী বলছে এই রেল করার পর, জলোচ্ছ্বাসের পানির লেভেল দুই-তিন গুণ হয়ে গেছে। বাঁধ দিয়ে রেল করা সনাতন প্রযুক্তি।

jagonews24

আরও পড়ুন>> খুলছে রেলের দখিনা দুয়ার, সমুদ্রের গর্জন শুনবে ট্রেনযাত্রীরাও

আখাউড়া-আগরতলা যে রেললিংকটি হচ্ছে প্রায় ১৫ কিলোমিটার, তার মধ্যে পাঁচ কিলোমিটার ভারতের মধ্যে পড়েছে। আমরা এখানেও বাঁধ দিয়ে রেল করলাম। ভারতের অংশ ভায়াডাক্ট করে বা খুঁটির ওপরে করা হয়েছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির প্রবাহকে নিরবচ্ছিন্ন রাখা, পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর চলাচল যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, এটাও তারা বিবেচনায় নিয়েছে। এটাই টেকসই উন্নয়নের দর্শন।

জাগো নিউজ: সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কী ধরনের ত্রুটি ছিল বলে আপনি মনে করেন? বনাঞ্চল পাশ কাটিয়ে রেল সংযোগ করা যেত?

ড. মো. হাদিউজ্জামান: বাংলাদেশ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া- এই তিন দেশের বড় প্রতিষ্ঠান এ পথের সম্ভাব্যতা ও যৌক্তিকতা যাচাই করেছে। যে এলাকা দিয়ে রেলটা করা হলো, সেখানকার হাইড্রোলিকস ও হাইড্রো ডায়নামিকস বোঝার মতো তাদের সক্ষমতা কতটুকু ছিল সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এখানে ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে শতবর্ষ ধরে পানির প্রবাহ আছে। পাহাড়ি ঢল নামলে এই ক্যানেল রিভার সিস্টেমটাকে সংরক্ষণ করে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে এটার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। শুষ্ক মৌসুমে সেখানে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে গেলে দেখবেন এখানে কোনো ক্যানেল নেই। তাহলে কিন্তু ধরে নেওয়া হবে এখানে বাঁধ দিয়ে রেল করা যথোপযুক্ত। এনভায়নমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট যেটার কথা বারবার বলেছি, এটা দীর্ঘমেয়াদি হওয়া উচিত ছিল।

এখানে স্থানীয়দের অল্প পরিসরে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। যে যে উপজেলার ওপর দিয়ে এটা যাচ্ছে, প্রত্যেক উপজেলার মানুষের সঙ্গে কিন্তু আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এ প্রকল্প সম্পর্কে এলাকাবাসীকে কতটুকু বলছেন, বা প্রকল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড কতটা বলেছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

এই স্টাডি কতদিন করছেন, কাদের সম্পৃক্ত করলেন, এলাকাবাসীর সামনে কোন প্রেক্ষাপটে কথা বলেছেন- এসব বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে। যার কারণে আমরা দেখলাম উদ্বোধনের আগেই ফ্ল্যাশ ফ্লাডে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক পাশে পাহাড়, এক পাশে বাঁধ দিয়ে রেল, আর এলাকাবাসী মাঝখানে বসে আছে।

এখানে বিকল্প পথের সুযোগ ছিল। সেটি হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মহাসড়ক এনওয়ানের (N1) সমান্তরালে কিছু করার সু্যোগ ছিল। কিন্তু এখানে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। আশপাশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিছু জংশন পয়েন্ট আছে। সেটা বাণিজ্যিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এসব বাইপাস করার সুযোগ ছিল।

jagonews24

বনের ভেতর দিয়ে যখন নিয়ে গেছেন তখন বন অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। সেটা স্বল্পমূল্যে করা গেছে। এনওয়ানে গেলে অধিগ্রহণের খরচটা বেশি হতো। ইকোলজিক্যাল সেনসেটিভ জায়গা দিয়ে নিয়ে জমি অধিগ্রহণের খরচ কমাতে পারলাম। কিন্তু আমি বলবো, এটা ইকোলজিক্যালি একটা রেকলেস প্রজেক্ট। কারণ এ এলাকায় এরই মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প আসতে শুরু করেছে। ব্যবসা, বাণিজ্য ও শিল্পায়ন শুরু হয়েছে। বে অব বেঙ্গলের এটিই হলো সবশেষ অভয়ারণ্য, পাহাড়ি এলাকা ও বন।

জাগো নিউজ: রেললাইনের ২১টি স্থানে হাতির বসতি ও চলাচলের পথ রয়েছে। হাতির জন্য এই রেলপথ বাধা হয়ে দাঁড়াবে কি?

ড. মো. হাদিউজ্জামান: রেললাইনটার ২৯ কিলোমিটার বনের ভেতর দিয়ে গেছে। মেধাকচ্ছপিয়া, চুনতি, ফাশিয়াখালি জায়গাগুলো আসলে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার কোরিডর গেছে চুনতিতে। এটা এশিয়ান এলিফ্যান্টের অ্যাকটিভ প্যাসেজ। এখান দিয়ে হাতি প্রায়ই চলাফেরা করে। এখানে ১৩টি ওভারপাস দেওয়ার কথা ছিল। যদিও চুনতিতে একটা ওভার পাস দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সবুজ বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে হাতিকে গাইড করার জন্য। হাতি তো গাইড হবে না। রেলের দুই পাশে ব্যারিয়ার দেওয়া হয়েছে, কিছু লবণ লেক করা হয়েছে। কারণ হাতি লবণ খেতে পছন্দ করে। কিন্তু হাতির এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে চলাচলের জন্য আরও বেশি ওভারপাসের দরকার ছিল। যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা গ্রিন ওয়াশিং মেজর। পরিবেশবাদীদের মনোযোগ ডাইভার্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার জানা মতে পৃথিবীর কোথাও অভয়ারণ্য দিয়ে ট্রেন নেওয়া হয়নি। ভারতে খুবই সামান্য কোরিডর বনের ভেতর দিয়ে গেছে। সেখানে প্রায়ই হাতির দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

এক সময়ে হাতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব দেখেছি। এক দশকে দ্বন্দ্বে আমার ধারণা প্রায় শতাধিক লোক মারা গেছে। রেলের লেভেল ক্রসিংয়ে প্রায়ই মানুষ কাটা পড়ে মারা যাচ্ছে। এটার সমাধান রেলওয়ে করতে পারেনি। এখন আরেকটা সমস্যা টেনে নিয়ে এলেন, লেভেল ক্রসিংয়ে হাতির সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষ হয় কি না। এই জায়গায় রেল আরও চাপের মধ্যে পড়ে গেলো। ভারতে হাতি কাটা পড়ার ঘটনা ঘটেছে সামান্য বনেই। এখানে হাতির জন্য ক্যামেরা ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। রেল ট্র্যাকে হাতি বা অন্য বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব পেলে সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনের লোকমাস্টারকে জানাতে হবে। ট্রেন হঠাৎ থামতে পারে না। নির্দিষ্ট সময় রেখেই তাকে থামাতে হবে। এই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।

জাগো নিউজ: পুরোপুরি কাজ শেষ না হলেও রেলপথ উদ্বোধন করার কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

ড. মো. হাদিউজ্জামান: স্বাধীনতা পরবর্তী ৫২ বছরে আমরা যে প্রকল্পগুলো নিচ্ছি, নিঃসন্দহে সেগুলো অত্যাধুনিক, যুগোপযোগী ও লাভজনক। সঙ্গত কারণেই এ প্রকল্পগুলো নির্বাচনী প্রচারের একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। ফলে প্রকল্পগুলো আংশিক বাস্তবায়ন করে খুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পগুলোর প্রত্যেকটার উপযোগিতা আছে। মেগা প্রকল্পের উপযোগিতা বিশাল হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন আংশিকভাবে খোলা হচ্ছে তখন হিতে বিপরীত হিসেবেও কাজ করছে। ফলে যারা বাস্তবায়ন করছে তাদের ভাবমূর্তিও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বা রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট নিশ্চিত করতে গেলে পুরোপুরি প্রস্তুতের পর খুলে দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।

এসএম/এএসএ/এমএস

রেল যেটা বলছে সেটা একটা খোঁড়া যুক্তি। তারা বলছে, কয়েক কোটি টাকা দিয়ে তারা সংস্কার করে ফেলবে। আমরা শুধু রেলের ক্ষতি দেখছি। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার আশপাশে যারা থাকে তারা যে একটা দীর্ঘমেয়াদি ওয়াটার লগিং সমস্যার মধ্যে পড়ে গেলো এটার যে প্রভাব, এটা অপূরণীয় ক্ষতি।

রেলের টেম্পারমেন্টটা নষ্ট হয়ে যাবে তখন ডিরেলমেন্ট বা লাইনচ্যুতির একটা শঙ্কা তৈরি হবে। বলা হচ্ছে ১২০ কিলোমিটার গতিতে দোহাজারি থেকে কক্সবাজারের ট্রেন চালাবেন, তাহলে ট্রেনের ট্র্যাকগুলো ঝুঁকিমুক্ত হতে হবে। এখানে বাঁধ দিয়ে রেল করার যে পরিকল্পনা সেটা কতটুকু যৌক্তিক ছিল, এখন সেটাই একটা বড় প্রশ্ন।

পরিবেশবাদীদের মনোযোগ ডাইভার্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার জানা মতে পৃথিবীর কোথাও অভয়ারণ্য দিয়ে ট্রেন নেওয়া হয়নি। ভারতে খুবই সামান্য কোরিডর বনের ভেতর দিয়ে গেছে। সেখানে প্রায়ই হাতির দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।