অলৌকিকভাবে বেঁচে আছে মিরপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট শিশু হোসাইন

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৪০ পিএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

মিজানের গ্রামের বাড়ি বরিশালের ঝালকাঠি। তিনি কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। সেখানে থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে ঢাকা কমার্স কলেজ সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তি এলাকায় মিজানের শ্বশুরবাড়ি। বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে গ্রামের বাড়ি থেকে স্ত্রী মুক্তা বেগম (২৫), সাত বছরের মেয়ে লিমা ও সাত মাসের ছেলে হোসাইনকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসেন মিজান। সেখানে দুপুরের খাবার খান তারা। কথা ছিল রাতের খাবার খেয়ে নিজের বাসায় ফিরবেন তারা।

কথা অনুযায়ী শ্বশুরবাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে পরিবার নিয়ে বের হন মিজান। সেখান থেকে বের হলেও পরিবার নিয়ে আর নিজের বাসায় ফেরা হলো না মিজানের। রাতের টানা বৃষ্টিতে ঝিলপাড় বস্তির সামনের রাস্তায় জমে থাকা পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ গেছে মিজান, তার স্ত্রী মুক্তা ও মেয়ে লিমার। এসময় তাদের বাঁচাতে এগিয়ে এসে প্রাণ হারান অনিক নামে এক অটোরিকশাচালক। তবে, অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছে মিজানের সাত মাস বয়সী ছেলে হোসাইন।

এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন জাগো নিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় প্রবল বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে ওই রাস্তায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ধারণা করা হচ্ছে, বজ্রপাতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পানিতে পড়ে। এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পাঁচজন গুরুতর আহত হন। তাদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক চারজনকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতদের মধ্যে একই পরিবারের তিনজন রয়েছেন। তাদের বাঁচাতে এসে অনিক (২০) নামে যুবকের মৃত্যু হয়েছে।

স্থানীয়রা জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে একই পরিবারের ৪ সদস্যকে পানিতে পড়ে থাকতে দেখে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন রিকশাচালক অনিক। তিনি প্রথমে শিশু হোসাইনকে পানি থেকে তুলে আনেন। এরপর শিশু লিমাকে তুলতে গিয়ে নিজে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন।

নিহত মুক্তার বাবা সানোয়ার শেখ জাগো নিউজকে বলেন, শিশু হোসাইনকে উদ্ধার করে প্রথমে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাতে সেখানেই তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকালে চিকিৎসক এসে বলেন, হোসাইন মোটামুটি সুস্থ, তাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। পরে আমরা তাকে বাসায় নিয়ে এসেছি।

তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বরিশালের ঝালকাঠি। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় আসছে। দুপুরে আমার বাসায় খেয়েছে। এরপর রাতে খাবার খেয়ে নিজের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হয় ওরা। এর কিছুক্ষণ পরেই মানুষের হুড়োহুড়ি, চিৎকার শুনে গিয়ে দেখি এ অবস্থা। তখন পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কেউ বলে শিশু হোসাইনকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে যেতে, কেউ বলে ঢাকা মেডিকেল। পরে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

jagonews24

তিনি বলেন, ওরা কীভাবে মারা গেলো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওই পানিতে আরও অনেকেই ছিল। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেবো, সবাই তো মারাই গেলো।

ঝিলপাড় বস্তির বাসিন্দা আমিনুর ইসলাম বলেন, এখানে সবসময়ই পানি জমে। কিন্তু এবার দুর্ঘটনা ঘটলো। তার কীভাবে পড়লো, কোথায় পড়লো জানি না। আমরাও তো পানিতে ছিলাম। যারা মরদেহগুলা উদ্ধার করে নিয়ে এলো তারাও পানিতে ছিল। মরদেহ নেওয়ার আধাঘণ্টা পর বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়েছে।

শুক্রবার দুপুরে ঝিলপাড় বস্তির সামনে বসে কাঁদছিলেন নিহত মুক্তার মা কুলসুম। তিনি বলেন, এ বৃষ্টি-কাঁদার মধ্যে নাতিদের নিয়ে বাসায় যেতে না করেছিলাম মুক্তাকে। আজকের (শুক্রবার) দিনটা বাসায় থাকতে বলেছিলাম। বৃষ্টি কমায় বাসা থেকে বের হয়। রিকশায় যেতে বলেছিলাম। রিকশায় না পাওয়া হেঁটে যাওয়া এ ঘটনা ঘটেছে।

নিহত অনিকের বন্ধু আব্দুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, রাত ১০টার দিকে আমরা একসঙ্গে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ছিলাম। এ সময় দেখি বস্তির বিপরীত পাশের রাস্তায় একটা আপু, ভাইয়া ও দুটো বাচ্চা নিয়ে আসতেছি। আপুটা হঠাৎ রাস্তায় পড়ে যায়। আমরা মনে করেছিলাম পা পিছলে পড়ে গেছেন। এসময় বন্ধু অনিক তাদের বাঁচাতে দৌড়ে যায়। এসময় অনিকও বিদ্যুতায়িত হয়। পরে আরেক বন্ধু জুয়েল ছুটে যায়। জুয়েল গিয়ে দেখে পানিতে আর্থিং (গ্রাউন্ডিং) হয়েছে। পরে আমরা সবাই দূরে চলে আসি। এসময় ওই আপু তার বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য ছুড়ে মারেন। পরে বাচ্চাটিকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা হাসপাতালে নিয়ে যায়। অন্যদিকে, আমরা অনিককে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাই।

খাল দখল করে বস্তি, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে ‘মৃত্যু’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রূপনগর খাল দখল গড়ে উঠেছে এ বস্তি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া গড়ে ওঠা বস্তিতে চলে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। এ অবৈধ বিদ্যুতকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে রিকশার গ্যারেজ। যদিও শুক্রবার ওই গ্যারেজে কোনো রিকশা দেখা যায়নি।

স্থানীয়রা বলছেন, বস্তিকে কেন্দ্র করে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের রমরমা ব্যবসা চলে আসছে বহুদিন ধরে। এসব অবৈধ সংযোগ লাইনের মধ্যে থেকে একটি ছিঁড়ে পানিতে পড়ে যায়। রাস্তায় জলাবদ্ধতার কারণে এ লাইনটি দেখা যায়নি।

অনিকের বন্ধু আব্দুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ঝিলপাড় বস্তির অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন টানা হয়েছে। বৃষ্টিতে এ বিদ্যুতের লাইন লিক করেছে। এ কারণেই রাস্তার পানি কারেন্ট হয়ে এ ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিষয়টি আমরা অবগত। এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে। এ ছাড়া নিহতের স্বজনরা আমাদের কাছে একটি অভিযোগ করেছেন। অভিযোগটি মামলা আকারে দায়েরের প্রক্রিয়া চলমান। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে শুরু করে এ মৃত্যুর পেছনে কারও কোনো দায় আছে কি না তা তদন্ত করে দেখা হবে। তদন্ত কারো দায় পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্থানীয়রা বলছেন, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও কাউন্সিলর, মেয়র কেউ আসেননি। আগের কাউন্সিলর মোবাশ্বের এসেছেন। এটা খুবই দুঃখজনক।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে ঢাকায় বজ্রপাতসহ প্রবল বৃষ্টি হয়। এতে রাজধানীর প্রধান সড়কসহ অলিগলি পানিতে তলিয়ে যায়। বেশিরভাগ জায়গায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে যান চলাচল ব্যাহত হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

এসএম/এমএএইচ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।