এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে যত ‘পেটানোর অভিযোগ’
রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষ থামাতে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ এক পুলিশ কনস্টেবলকে থাপ্পড় মারছেন। তখন তার এ ধরনের আচরণের নিন্দা জানিয়েছিলেন অনেকে।
ঘটনাটি ঘটে গত বছরের ১৮ এপ্রিল রাতে। নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের লক্ষ্য করে পুলিশ সদস্যদের রাবার বুলেট ছোড়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন এডিসি হারুন। এসময় ‘গুলি শেষ হয়ে গেছে’ বলায় ওই পুলিশ কনস্টেবলকে থাপ্পড় মারেন তিনি। এ নিয়ে গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশিত হয়েছিল। শুধু নিজের সহকর্মীকেই নন- এডিসি হারুন তার নেতৃত্বে শাহবাগে সমাবেশকারীদের পেটানোর ঘটনা, এমনকি তিনি নিজেই লাঠি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের পেটাচ্ছেন- এমন ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। তবে বারবার এসব ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলেও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বা পুলিশ সদরদপ্তর থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো দীর্ঘদিন স্বপদে বহাল ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: ছাত্রলীগের দুই নেতাকে তুলে নিয়ে পেটানোর অভিযোগ
তবে এবার শেষ রক্ষা হলো না এডিসি হারুনের। রাজধানীর শাহবাগ থানায় গত শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) দিনগত রাতে ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে পুলিশ নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করে বলে অভিযোগ ওঠে। আহতরা হলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ।
ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে থানায় ধরে নিয়ে বেধড়ক পিটুনির ঘটনায় এডিসি হারুন অর রশিদকে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এডিসি হারুনকে রমনা বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) সংযুক্ত করা হয়েছে।
ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আল আমিন রহমান তার নিজের ভেরিফাইড ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বন্ধু আনোয়ার হোসেন নাঈমের পাশে আছি আমরা। সবাই তার সুস্থতার জন্য দোয়া করবেন। সাইকোপ্যাথ ছাড়া কেউ এমন ঘটনা ঘটাতে পারে না।
আরেক সহ-সভাপতি শরিফুল আলম লিখেছেন, ছাত্রলীগ আসলেই এতিমদের সংগঠন। কাল থেকে আমাদের হাতে চুরি পরে ঘরে বসে থাকা উচিত।
কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-দপ্তর সম্পাদক মনির হোসেন লিখেছেন, এডিসি হারুন মানসিক বিকারগ্রস্ত, তাকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করতে হবে।
আরও পড়ুন: পুলিশ এ ধরনের অন্যায় করলে সাজা হবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আহত নাঈমের ছবি শেয়ার করে ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ লিখেছেন, আমার ছাত্রলীগের ছোট ভাই, কেন এমন হলো, কী জন্য এমন হলো জানতে চাই। এটা কি মেনে নেওয়ার মত ঘটনা!
ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক ইন্দ্রনীল দেব শর্মা রনি লিখেছেন, আনোয়ার হোসেন নাঈম এবং শরীফ আহমেদ মুনিমের ওপর যে বর্বরতা চালানো হয়েছে তার কঠোর বিচার দ্রুত নিশ্চিত হোক। বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গর্বিত অংশীদার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তমান ছাত্রলীগের সবার।
গত ৭ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামি আবদুল্লাহ। তখন তার মাথায় ১৪টি সেলাই। এই শিক্ষার্থী জানান, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শাহবাগে একটি সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেদিন ‘শান্তিপূর্ণ’ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ব্যাপক লাঠিপেটা করে পুলিশ। এতে তিনিসহ অন্তত ১২ জন আহত হন।
সেদিনের ঘটনায় নেতৃত্বে দেন এডিসি হারুন অর রশীদ। এডিসি হারুন সম্পর্কে এ ধরনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের মন্তব্য হলো ‘তিনি (এডিসি হারুন) শুধু পেটান।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, রাজধানীর রমনা জোনের এডিসি হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে ‘বিনা উসকানিতে’ বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেটা করা হয়েছে। শুধু এটা নয়, এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরাও একই অভিযোগ করেছেন।
আরও পড়ুন: এডিসি হারুন দোষী হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে: ডিবির হারুন
এডিসি হারুনের নেতৃত্বে শাহবাগে সমাবেশকারীদের পেটানোর ঘটনা, এমনকি তিনি নিজেই লাঠি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের পেটাচ্ছেন- এমন ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।
ভিডিওতে দেখা গেছে, বিক্ষোভকারীরা সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন। এমন সময় রমনা জোনের এডিসি হারুন অর রশীদের নির্দেশনায় তিনিসহ অন্য সহকর্মীরা বিক্ষোভকারীদের পেটাতে শুরু করেন।
পেটানোর আগে তার গায়ে জ্যাকেট এবং মাথায় হেলমেট পরিয়ে দেন তার সহকর্মীরা। হেলমেট পরানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারমুখো হয়ে উঠেন। তিনি ও তার সহকর্মীরা বিক্ষোভকারীদের অমানুষিকভাবে লাঠিপেটা করেন।
রাজধানীর ডিএমপি রমনা জোনের আওতাধীন এলাকার মধ্যে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বুয়েট) বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও হাইকোর্ট ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের মত প্রতিষ্ঠানে দেশের আলোচিত বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনা নিয়ে নিয়মিত প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়।
আরও পড়ুন: রমনা বিভাগ থেকে এডিসি হারুনকে বদলির আদেশ
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এর আগে যারা রমনা জোনের দায়িত্বে ছিলেন তাদের কাউকে নিয়ে এ ধরনের কোনো সমালোচনা হয়নি। এডিসি হারুন ‘উগ্র আচরণ’ করেন বলে অভিযোগ তাদের। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, এডিসি হারুনের মত অফিসার থাকলে পুলিশ বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হবে।
গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছিলেন একদল চাকরিপ্রত্যাশী। অবরোধ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলছিল। এরপর পুলিশ এসে তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়। সেখান থেকে সরে শাহবাগ থানামুখী রাস্তার দিকে এগোলে পুলিশ চাকরিপ্রত্যাশীদের কয়েকজনের ওপর লাঠিপেটা করে। এডিসি হারুনও লাঠিপেটা করে যুবকদের ধাওয়া দেন বলে জানান বিক্ষোভকারীরা। সেসময় ছবি তুলতে গেলে কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে এডিসি হারুন দুর্ব্যবহার করেন বলেও অভিযোগ ওঠে।
সাংবাদিকরা তখন অভিযোগ করেছিলেন, বিক্ষোভকারীদের শাহবাগ মোড় থেকে বলপ্রয়োগ করে সরানোর সময় ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশ খারাপ ব্যবহার করে এবং কয়েকজন সাংবাদিককে ধাক্কা দেয়।
রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ছাত্রলীগের দুই নেতাকে থানায় নিয়ে বেধড়ক মারধর করার বিষয়টি প্রমাণ হলে ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: রমনা বিভাগ থেকে এডিসি হারুন প্রত্যাহার
তিনি বলেন, ডিএমপি কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানেন। এটি তদন্ত করা হবে। তদন্তে এডিসি হারুন দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টিটি/এমকেআর/জিকেএস