পোস্টারে শ্রীহীন নগরের দেওয়াল
# নিয়ন্ত্রণে আইন আছে, প্রয়োগ নেই
# বেশি লাগানো হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের পোস্টার
# যত্রতত্র পোস্টার বন্ধে উত্তর সিটির ২৩ বোর্ড স্থাপন, নেই সুফল
নগরের দেওয়ালগুলো পোস্টারে ছেয়ে গেছে। তবে পোস্টার লাগানো ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। দেওয়ালগুলো পরিচ্ছন্ন করার কোনো উদ্যোগও নেই। এমন অবস্থায় অবৈধ ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলোবোর্ডে ফের ঢাকা পড়ছে ঢাকা।
নগরবাসীর অভিযোগ, যে কোনো দিবসের আগে নগরের দেওয়ালে পোস্টার, সড়কে ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ডে ছেয়ে যায়। ‘দেওয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ’ এমন সতর্কবার্তা লিখেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এখন হিড়িক পড়েছে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সম্ভাব্য সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের পোস্টার লাগানোর। ফলে শহরের পরিবেশ, সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই।
তবে দুই সিটির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরে অধিকাংশ ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের। এ কাজে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররাও পিছিয়ে নেই। এগুলো অপসারণ করতে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়েছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু তারপরও যত্রতত্র পোস্টার লাগানোর প্রবণতা কমছে না।
আরও পড়ুন: মরা গাছের টেন্ডার পেয়ে কাটা হচ্ছে তাজা গাছ
এদিকে নগরে যত্রতত্র পোস্টার লাগানো বন্ধে ভালো একটি উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি। তারা নগরের পৃথক ২৩টি স্থানে বোর্ড স্থাপন করেছে। তবে এসব বোর্ডে তেমন সুফল মিলছে না। আগের মতোই অলিগলির দেওয়াল, পদচারী সেতু, বৈদ্যুতিক বাতির খুঁটিতে পোস্টার লাগানো হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না গণপরিবহন ও মেট্রোরেলের পিলার। সব জায়গায় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের টু-লেট, ব্যক্তির প্রচার, বিজ্ঞপ্তিসহ নানান প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ আইন গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। আইন অনুযায়ী, নির্ধারিত স্থান বাদে অন্য কোনো দেওয়াল বা স্থানে পোস্টার লাগানো নিষিদ্ধ। নির্দিষ্ট সময়ের পর নিজ উদ্যোগে এই দেওয়াল লিখন ও পোস্টার তুলে ফেলতে হবে। অন্যথায় এ অপরাধে জেল-জরিমানার বিধান আছে।
এছাড়া দেওয়ালে পোস্টার লাগানো বন্ধে বিভিন্ন সময় সংবাদপত্রে গণবিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। গণবিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি বলেছে, দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণে আইন রয়েছে। দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১২ অনুসরণের জন্য তারা সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছে। কেউ বিধি লঙ্ঘন করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির জাগো নিউজকে বলেন, সাধারণত নির্বাচন উপলক্ষে পোস্টার লাগানো হয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যায়, সারা বছরই কারণে, অকারণে পোস্টার লাগানো হচ্ছে। অনেকে পোস্টারের ওপর পলিথিন ব্যবহার করছেন। সেই পোস্টার আবার ছিঁড়ে ড্রেন-নালায় ঢুকে জলাবদ্ধতা হচ্ছে, যা আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি।
আরও পড়ুন: সাত মসজিদ রোডে গাছ কাটার প্রতিবাদে মানববন্ধন
তিনি বলেন, আমাদের দেওয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ আইন আছে। কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ নেই। আমরা চাই শহরের সৌন্দর্য রক্ষায় আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
পোস্টারে ঢাকা ঢাকা
ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে অবৈধ ব্যানার-বিলবোর্ড উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে ‘পরিচ্ছন্নতা বছর-২০১৬’ শুরু করেছিলেন ডিএসসিসির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। টানা অভিযানে ছয় মাসের মাথায় ডিএসসিসির অধীন অধিকাংশ সড়ক থেকে সব অবৈধ বিলবোর্ড ও ব্যানার অপসারণ করা হয়। এরপর নতুন করে যেখানেই অবৈধ বিলবোর্ড ও ব্যানার লাগানো হয়, তা ভেঙে ফেলে সংস্থাটি। প্রায় একই ভাবে ‘গ্রিন ঢাকা, ক্লিন ঢাকা’ স্লোগান ২০১৬ সাল থেকে ব্যানার-বিলবোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে ডিএনসিসি। এই ধারা ২০২১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
তবে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে নগরে পোস্টার লাগানোর প্রবণতা ফের বেড়েছে। এরমধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে মেট্রোরেল উদ্বোধন হয়। তখন ‘মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টার লাগানো দণ্ডনীয় অপরাধ’- এমন সতর্কবার্তা টানিয়ে দেয় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কিছুদিন পরই মেট্রোরেলের পিলার ছেয়ে যায় পোস্টারে। ফলে মেট্রোরেলের পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়। পরে এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের পর সবার টনক নড়ে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার করা হয়। কেউ যাতে পরবর্তীসময়ে মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টার লাগাতে না পারে, সেজন্য থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
আরও পড়ুন: উন্নয়ন কাজের জন্য কোনো না কোনোভাবে গাছ কাটা হচ্ছে
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সংসদ সদস্য প্রার্থীদের ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ডে প্রচারণা বাড়ছে। এমন অবস্থার লাগাম টেনে ধরতে নগরের বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার লাগাতে নির্দিষ্ট বোর্ড স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় ডিএনসিসি।
তারই অংশ হিসেবে মিরপুর-১০ (১৬ ফুট), সেনপাড়া যুব সংঘ (১৬ ফুট), কাজীপাড়ার কৃষিবিদ গলি (২৪ ফিট), আগারগাঁওয়ের তালতলা মোড় (২৪ ফুট), আগারগাঁওয়ের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন (২৪ ফুট), আগারগাঁও মোড় (২৪ ফুট), খামারবাড়ি মোড় (২৪ ফুট), মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন (২৪ ফুট), ফার্মগেট (২৪ ফুট), তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (২৪ ফুট), এটিএন নিউজ অফিস সংলগ্ন (২৪ ফুট), বাংলামোটর (২৪ ফুট), নিউ ইস্কাটন রোডের সিঙ্গার সার্ভিসিং সেন্টার সংলগ্ন (২৪ ফুট), জনকণ্ঠ ভবন সংলগ্ন (১৬ ফুট), জাতীয় চার্চ পরিষদ (২৪ ফুট), মিরপুর-২ নম্বরে ওয়াসা পাম্প এলাকায় (১৬ ফুট), মিরপুর-১০ বিআরটিএ’র সামনে (২৪ ফুট), মিরপুর-১০ এর ভিশন মোড় (২৪ ফুট), রায়েরবাজারে বৈশাখী সংঘ এলাকায় (২৪ ফুট), রায়েরবাজার বধ্যভূমি এলাকায় (১৬ ফুট), শ্যামলী রিং রোডের টিক্কাপাড়া মোড়ে (২৪ ফুট), মিরপুর কাজীপাড়া ও মিরপুর সেনপাড়ায় বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর সংলগ্ন ১৬ ফুট বাই ৬ ফুট সাইজের একটি বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। এই বোর্ডের ওপরের অংশে কালো কালি দিয়ে লেখা ‘পোস্টার লাগানোর নির্ধারিত স্থান’। অথচ সেখানে শুধু টু-লেট টানানো। রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পোস্টার লাগানো রয়েছে আশপাশের দেওয়ালে। এরমধ্যে ১৫ আগস্ট শোক জানাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পোস্টারই বেশি দেখা গেছে।
এছাড়া খামারবাড়ি মোড়, ফার্মগেট, তেঁজগাও, নিউ ইস্কাটন এলাকার বোর্ডগুলো এবং আশপাশের দেওয়ালে একই চিত্র দেখা গেছে।
মিরপুর-১০ নম্বর এলাকার বাসিন্দা আশিকুর ইসলাম। আলাপকালে তিনি বলেন, শুধু এ ধরনের বোর্ড দিয়ে নগরে পোস্টার লাগানো বন্ধ করা যাবে না। এজন্য আইনের প্রয়োগ জরুরি। মেট্রোরেল তার উদাহরণ। তিনি বলেন, মিরপুর গোল চত্বর এলাকার প্রতিটি বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে পোস্টার লাগানো হচ্ছে। রাতের অন্ধকারে কে কখন পোস্টার লাগিয়ে যায়, বাড়ির মালিকরাও টের পান না। যে ব্যক্তির পোস্টার লাগানো হচ্ছে, তাকে আইনের আওতায় আনলেই শহর পরিষ্কার থাকবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, নগরের দেওয়ালে পোস্টারে ‘দৃষ্টি দূষণ’ হচ্ছে।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, যত্রতত্র পোস্টার লাগানো বন্ধে আইন রয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে জনগণকে সাবধান করেছি। এছাড়া পোস্টার লাগানোর জন্য ডিএনসিসির প্রতিটি ওয়ার্ডের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বোর্ড স্থাপনের কাজ চলছে। আমরা আশা করি এটি ভালো সাড়া ফেলবে। সব ওয়ার্ডে বোর্ড স্থাপনের পর দেওয়ালে পোস্টার লাগানোর বিরুদ্ধে ফের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করবো। পোস্টার লাগিয়ে শহর আর নোংরা করতে দেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরে যত্রতত্র অবৈধভাবে পোস্টার, রেক্সিন, দেওয়ালে লেখা, সাইনবোর্ড, ব্যানার এসব লাগানোর ফলে নগরীর সৌন্দর্য ব্যাহত হচ্ছে। একই সঙ্গে নগরীও অপরিচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। শহরের সৌন্দর্য রক্ষায় এবং স্মার্ট সিটি গড়ে তুলতে হলে এসব বন্ধ করতে হবে।
এদিকে পোস্টার লাগানোর প্রবণতা বন্ধে বা অপসারণে কোনো উদ্যোগ নেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। অথচ উত্তরের চেয়ে দক্ষিণের আবাসিক বাসাবাড়ি, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার বেশি। এরমধ্যে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ও আশপাশের এলাকায় আওয়ামী লীগ এবং নয়াপল্টন ও আশপাশের এলাকার দেওয়ালে বিএনপির নেতাকর্মীদের পোস্টার বেশি দেখা গেছে।
আরও পড়ুন: ‘গ্রিন ঢাকা’র স্বপ্নবাজেরা ঢাকা ঢেকেছেন পলিথিনের পোস্টারে
পুরানা পল্টনের একটি বহুতল ভবনের মালিক মনোয়ার হোসেন। তার বাড়ির দুইপাশে দুটি গলি সড়ক। ফলে এই বাড়ির দুপাশের দেওয়ালে সারা বছরই পোস্টার লাগানো হয় বলে জানান মনোয়ার।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালে একবার দেওয়ালের সব পোস্টার তুলে রং করেছিলাম। এছাড়া ‘দেওয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ’ এমন সতর্কবার্তাও লেখা ছিল। কিন্তু কিছুদিনর পর এ লেখার ওপরই পোস্টার লাগিয়েছে। পোস্টার লাগানো বন্ধে নগর কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, অবৈধ পোস্টার, ব্যানার আমরা প্রায় রাতেই পরিষ্কার করি। কিন্তু একদিন পরিষ্কার করলে, আরেকদিন রাতে আবার পোস্টার লাগিয়ে দেয়। পোস্টারে যে ব্যক্তির ছবি বা তথ্য (সৌজন্য বা প্রচারে) তাদের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার পাওয়া গেলেও তারা পোস্টারের অভিযোগ অস্বীকার করেন। ফলে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তারপরও এ প্রবণতা কমাতে করণীয় নির্ধারণ করতে করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবো।
এমএমএ/এমএইচআর/জিকেএস/এএসএম