শাহজালালের ‘গলার কাঁটা’ পরিত্যক্ত ১২ উড়োজাহাজ
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ১২টি উড়োজাহাজ। এসব উড়োজাহাজ সরিয়ে নিতে বা মেরামত করে ফের চালু করতে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও তা আমলে নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স। ফলে উড়োজাহাজগুলো নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তবে এই নিলাম প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে ঠিক কতদিন সময় লাগবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি সংস্থাটি। পাশাপাশি নিলামে যদি কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া না যায়, তাহলে উড়োজাহাজগুলো কেজি দরে বিক্রি করা হবে।
তবে এই উদ্যোগে একমত নয় সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, কোনো কোনো উড়োজাহাজ ব্যাংক ঋণ নিয়ে কেনা। এভাবে বিক্রি করলে সেগুলোর কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া যাবে না। ফলে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এয়ারলাইন্সগুলো।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জানিয়েছে, গত ১০ বছরে এই ১২টি উড়োজাহাজের পার্কিং ও সারচার্জ বাবদ বকেয়া প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা আদায়ে নিলামের কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। শিগগির নিলাম আহ্বান করা হবে। নিলামে কাঙ্ক্ষিত দাম না পেলে কেজিদরে বিক্রি করা হবে উড়োজাহাজগুলো।
বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আটটি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের। রিজেন্ট এয়ারওয়েজের দুটি, জিএমজি এয়ারলাইন্সের একটি ও এভিয়েনা এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
আরও পড়ুন: নিলামে কাঙ্ক্ষিত দাম না মিললে ১২ প্লেন বিক্রি হবে কেজি দরে
হযরত শাহজালাল অন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো অপসারণ করা হলে সেখানে কমপক্ষে সাতটি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যাবে। এখন নিলাম করা গেলে পার্কিং চার্জ ও সারচার্জ বাবদ বকেয়া টাকা যেমন উসুল হবে, তেমনি কার্গো ভিলেজে জায়গাও ফাঁকা হবে। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে যাত্রী পরিবহন শুরুর আগেই এগুলো অপসারণ করা দরকার।
জানতে চাইলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো সরিয়ে নিতে আমরা সংশ্লিষ্টদের অনেকবার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো জবাব দেয়নি। তাদের কাছে পাওনা অর্থও পরিশোধ করেনি। বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখন সিভিল এভিয়েশন আইন অনুযায়ী পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো বাজেয়াপ্ত করে দ্রুত নিলামের আয়োজন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে নিলামের প্রক্রিয়া নির্ধারণে কর্মপদ্ধতি ও সুপারিশমালা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন কোনো এয়ারলাইন্সের ব্যাংকের কাছে ঋণ বা মর্টগেজ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হয়েছে। শিগগির জব্দ তালিকা তৈরিসহ বাকি কাজ করা হবে।’ তবে নিলাম চূড়ান্ত করতে ঠিক কতদিন সময় লাগবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেননি তিনি।
আরও পড়ুন: ই-গেটের সুফল নেই, লাইনেই ঘণ্টা পার যাত্রীদের
বেবিচক সূত্রে গেছে, বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আটটি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের। রিজেন্ট এয়ারওয়েজের দুটি, জিএমজি এয়ারলাইন্সের একটি ও এভিয়েনা এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
এসব উড়োজাহাজের পার্কিং চার্জ ও সারচার্জ বাবদ বকেয়া প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বকেয়া জিএমজি এয়ারলাইন্সের। জিএমজির কাছে ৩৬০ কোটি টাকা পায় বেবিচক। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট স্থগিত করে জিএমজি এয়ারলাইন্স। এরপর আর কখনো আকাশে ডানা মেলেনি জিএমজির উড়োজাহাজ।
রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে বেবিচকের পাওনা ২০০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের মার্চে বন্ধ হয় রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। তবে তার আগেই বেশ কয়েকটি রুটে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি। এর বাইরে পার্কিং চার্জ ও সারচার্জ বাবদ ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে বকেয়া ৩৫৫ কোটি টাকা। দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত একমাত্র বিমান কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বন্ধ ২০১৬ সাল থেকে।
আরও পড়ুন: মেসির বাড়ির ওপর দিয়ে কেন উড়তে পারে না বিমান?
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, উড়োজাহাজগুলোর রেজিস্ট্রেশন আগেই বাতিল করেছে বেবিচক। এরপর বিমানবন্দর থেকে সেগুলো সরিয়ে নিতে দফায় দফায় নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বছরখানেক আগে বকেয়া আদায়ে উড়োজাহাজগুলো নিলামে বিক্রির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। তখন কয়েকজন মালিক বকেয়া পরিশোধে ছয় মাস সময় চেয়েছিলেন। সেই সময় পার হলেও তাদের দেখা নেই। এজন্য ফের নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। নিলামে কাঙ্ক্ষিত দাম না পেলে প্রয়োজনে উড়োজাহাজগুলো কেজি দরে বিক্রি করা হবে।
গত ১০ বছরে ১২টি উড়োজাহাজের পার্কিং ও সারচার্জ বাবদ বকেয়া প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা আদায়ে শিগগির নিলাম আহ্বান করা হবে। নিলামে কাঙ্ক্ষিত দাম না পেলে কেজি দরে বিক্রি করা হবে উড়োজাহাজগুলো।
বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব এয়ারলাইন্সের একটিরও অফিস ও ঠিকানা নেই এখন। ফলে অনেক খোঁজ করেও সংশ্লিষ্ট কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেবিচকের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, পরিত্যক্ত ১২ উড়োজাহাজ আমাদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। এগুলোর কারণে বিমানবন্দর পরিণত হয়েছে বিশাল এক ডাম্পিং স্টেশনে। ঘিঞ্জি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে কার্গো ভিলেজ এলাকায়। পরিত্যক্ত এসব উড়োজাহাজ সরিয়ে নেওয়া হলে সেখানে কমপক্ষে সাতটি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যেত। একই সঙ্গে কার্গো প্লেনে মালামাল ওঠানামাও সহজ হতো।
চিরতরে বন্ধের পথে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ
নানা প্রতিকূলতা, বাধা বিপত্তি ও বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (বেবিচক) পাওনা টাকা পরিশোধ করতে না পারায় চিরতরে বন্ধের পথে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালানা পর্ষদের সদস্যরা জানান, ইউনাইটেডের কার্যক্রম ফের শুরু করতে হলে এয়ার অপারেটিং সার্টিফিকেট (এওসি) নবায়ন করতে হবে। কিন্তু বকেয়া পরিশোধ না করায় এওসি দিচ্ছে না বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
আরও পড়ুন: বিপুল খরচে তৈরি যেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের বিমান
বেবিচক সূত্র জানায়, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে বেবিচকের পাওনা ৩৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল দেনা ৫৫ কোটির মতো, বাকি টাকা সারচার্জ। এ টাকা পরিশোধ না করলে এওসি ইস্যু করা যাবে না। যদিও ইউনাইটেডের পক্ষ থেকে সারচার্জ মওকুফের অনুরোধ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় তা নাকচ করে দিয়েছে। ফলে ইউনাইটেডের জন্য আর কোনো দরজা খোলা রইলো না।
২০০৭ সালে দেশে ফ্লাইট অপারেশন শুরু করে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। তবে কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই ২০১৬ সালে ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকে তাদের বহরে থাকা আটটি উড়োজাহাজ বিমানবন্দরে পড়ে রয়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত ইউনাইটেড থেকে সারচার্জসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ওই পরিমাণ টাকা পাওনা রয়েছে বেবিচকের। গত কয়েক বছর ধরে পাওনা আদায়ে বার বার চিঠি দিয়েও এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ আদায় করতে পারেনি বেবিচক।
এরই মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে নতুন সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক বসিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এই সাতজনের মধ্যে এভিয়েশন ও ভ্রমণ বিষয়ক সাময়িকী ‘বাংলাদেশ মনিটর’ সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলমকে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়। গত ৩ জানুয়ারি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে একসঙ্গে ৭ বছরের (২০১৬-২০২২) বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। এজিএমে যত দ্রুত সম্ভব এয়ারলাইন্সটিকে অপারেশনে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন স্বতন্ত্র পরিচালকদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ডের সদস্যরা। তখন তারা বলেছিলেন, প্রথম ধাপে কার্গো অপারেশন, পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে (২০২৬) কমার্শিয়াল ফ্লাইট শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। কিন্তু গত ৮ মাসে এই বিষয়ে তাদের কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে পরিচালনা পর্ষদ।
আরও পড়ুন: কম ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে লাভে বিমান, নাখোশ বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ফের চালু করতে যা যা করণীয় তা একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের কাছে বকেয়া টাকার কারণে কিছুই করতে পারলাম না। বকেয়ার কথা শুনে বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’
উড়োজাহাজগুলো নিলামে বিক্রি করলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটা করা ঠিক হবে না। এছাড়া কয়েকটি উড়োজাহাজ ব্যাংক লোন নিয়ে কেনা হয়েছিল। এখন এগুলো নিলামে বিক্রি করলে পর্যাপ্ত মূল্য পাওয়া যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ৩০০ কোটি টাকা সারচার্জ মওকুফের জন্য আবেদন করেছিলাম। আর মূল বকেয়া ৫৫ কোটি টাকা এয়ারলাইন্স চালু হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে দেবো বলেছিলাম। এ প্রস্তাবে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দেয়নি। ফলে এয়ারলাইন্স পরিচালনায় এওসি নবায়ন করতে পারিনি।’
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের আটটিসহ শাহজালাল বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত ১২টি উড়োজাহাজ নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে বিমানববন্দর কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে হাজারো মানুষের বিনিয়োগ আছে। উড়োজাহাজগুলো নিলামে বিক্রি করলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটা করা ঠিক হবে না। এছাড়া কয়েকটি উড়োজাহাজ ব্যাংক লোন নিয়ে কেনা হয়েছিল। এখন এগুলো নিলামে বিক্রি করলে পর্যাপ্ত মূল্য পাওয়া যাবে না।’
এমএমএ/কেএসআর/জিকেএস