গুলিস্তানে ভবনে বিস্ফোরণ: তদন্তেই আটকে আছে বিচারকাজ
গত ৭ মার্চ রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ২৪ জনের প্রাণহানি হয়, আহত হন শতাধিক মানুষ। ভবনে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ দেশব্যাপী বেশ আলোচিত হয়। রাজধানীবাসীর মধ্যে ভবন বিস্ফোরণের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। বিস্ফোরণের কারণ উদ্ঘাটনে তৎপর হয় ফায়ার সার্ভিস, রাজউকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করা হয় ভবনের মালিক দুই ভাই ও এক ব্যবসায়ীকে। মামলাও করে পুলিশ। মামলার তদন্তভার নেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
কিন্তু তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলেও শুরু সেই গতিতে ছেদ পড়ে। ঘটনার সাড়ে পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন তদন্ত প্রতিবেদনই জমা দিতে পারেনি পুলিশ। এরই মধ্যে কয়েকবার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। ফলে বিচারকাজও শুরু হয়নি আলোচিত এ ঘটনার। তদন্তেই আটকে আছে মামলার বিচারকাজ।
আরও পড়ুন>> কিছুক্ষণ পরপর বেরিয়ে আসছে মরদেহ
গত ৭ মার্চ বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে সিদ্দিকবাজারের নর্থসাউথ রোডে সাততলা ওই ভবনে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনার পরদিন বংশাল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা রুজু করে পুলিশ। ৯ মার্চ ভবনের মালিক দুই ভাই ওয়াহিদুর রহমান, মতিউর রহমান এবং ভবনের বেজমেন্টের স্যানিটারি ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব মিন্টুকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তাদের ৫৪ ধারায় দুই দিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়। সেদিন রাতেই বংশাল থানার এসআই পলাশ সাহা বাদী হয়ে ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে আরেকটি মামলা করেন। তবে এ মামলায় গ্রেফতারদের নাম ছাড়াই অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়। মামলার পর তাদের তিনজনকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। যদিও গ্রেফতার তিনজনই জামিনে মুক্ত।
মামলায় বলা হয়, বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি যথাযথ নিয়ম মেনে (বিল্ডিং কোড) নির্মাণ করা হয়নি। ভবনটিতে আন্ডারগ্রাউন্ড বা বেজমেন্ট তৈরির অনুমোদন ছিল না। অবৈধভাবে নির্মিত এই বেজমেন্ট বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের কোনো অনুমতি ছিল না। অথচ সেখানে নির্মাণসামগ্রী মজুত ও বিক্রির কাজে ব্যবহার করা হতো। বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে কুইন্স ক্যাফে নামে রান্নাঘর করা হয়েছিল। অথচ গ্যাস লিকেজের সমস্যা ও পয়োবর্জ্যে সৃষ্ট গ্যাস নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল না। ভবনের মালিক ও ব্যবহারকারীরা অর্থের লোভে অবৈধভাবে বেজমেন্ট ও আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবহার করে আসছিলেন।
আরও পড়ুন >> গুলিস্তানে বিস্ফোরণ: ভবন মালিকসহ গ্রেফতার ৩
জানা গেছে, ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের জন্য গত ১১ এপ্রিল প্রথম দিন ধার্য করেছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এরপর তদন্তকাজ শেষ না হওয়ায় একের পর এক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন পেছাতে থাকে। ২১ মে দ্বিতীয়বার, ২০ জুন তৃতীয়বার, ২৫ জুলাই চতুর্থবারের মতো দিন ধার্য থাকলেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি পুলিশ। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও বদল হয়েছেন একাধিকবার। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সিটিটিস। ২৪ আগস্ট পঞ্চমবারের মতো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ধার্য রয়েছে। তবে এবারও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবারও পিছিয়ে যাচ্ছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ।
বিস্ফোরণে নিহতদের স্বজনদের তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসন থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয় সমাহিত করার খরচ বাবদ। শ্রম মন্ত্রণালয় থেকেও নিহতদের স্বজনদের দুই লাখ টাকা করে এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ও আহতদের অধিকাংশ পরিবারই আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছে। তবে এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচারকাজ এখনো এগোয়নি। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ বারবার পিছিয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন হতাহতদের পরিবার।
আরও পড়ুন>> ২৪ জন নিহতের মামলার প্রতিবেদন দাখিল পেছালো
বিস্ফোরণে নিহত হন ভবনটির পাশেই জুতা বিক্রি করা মো. জামাল উদ্দিনের বোনের স্বামী। জামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি আসরের নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। নামাজে থেকেই বিকট শব্দ শুনি। বের হয়েই দেখি রক্তে মাখা মানুষ নিয়ে যাচ্ছে। ভবনের সামনেই এসে আমার বোনের স্বামীকে আর পাই না। ফোন দেই তাও ধরে না। পরে রাতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে গিয়ে তাকে পাই। ১৯ দিন পর তার মৃত্যু হয়। বোনের স্বামী আহত অবস্থায় এবং মারা যাওয়ার পরও আমরা আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু শুনেছি মামলা হয়েছে, তবে বিচারের কোনো কিছুই জানি না।’
বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন মির্জা আজম। পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে এখন অনিশ্চিত ভষ্যিতের পথে দিন কাটছে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রিয়া আক্তারের। স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা তিনি। স্বামীর মৃত্যুর বিচারের বিষয়ে জানতে চাইলে রিয়া আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষই হারিয়ে ফেলেছি। বিচার চেয়ে আর কী করবো।’
মামলার বাদী বংশাল থানার এসআই পলাশ সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মামলার বাদী। মামলার বর্তমান অবস্থা তদন্তকারী কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন। আমি যা পেয়েছিলাম তা মামলায় উল্লেখ করেছি।’
ঘটনার পরই তদন্তে নামে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), সিটিটিসি, সিআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থা। তিনজনকে গ্রেফতারসহ শুরুতে ত্বরিত পদক্ষেপ নিলেও ঘটনার সাড়ে পাঁচ মাস পরও মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে পারেনি।
আরও পড়ুন>> গুলিস্তানে বিস্ফোরণ: অপমৃত্যুর মামলা করলো পুলিশ
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) এস এম রাইসুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ট্রেনিংয়ের জন্য ফিলিপাইনে আছি। আগামী ২৩ আগস্ট দেশে আসবো। তদন্ত চলমান। মামলার তিন আসামিকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখন তারা জামিনে। আমরা প্রকৃত কারণ উদঘাটনের চেষ্টা করছি। আশা করি, খুব শিগগির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে পারবো। তবে ২৪ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের আরও কিছু কাজ বাকি। সেগুলো সম্পন্ন হলে পরবর্তী তারিখে হয়তো প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে।’
মামলার তদন্তের বিষয়ে সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের উপ-পুলিশ কমিশনার মিশুক চাকমা বলেন, ‘আমাদের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। ডিএমপির একজন যুগ্ম-পুলিশ কমিশনারের (ক্রাইম) নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছিল। কমিটি বসে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করলেই জমা দেওয়া হবে।’
আরও পড়ুন>> গুলিস্তানে বিস্ফোরণ: ২৩ দিন পর ঘুম ভাঙলো ডিএসসিসির
তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু সংস্থার সমন্বয়হীনতা ছিল। আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক গ্যাস লাইনের বড় লাইন ছিল। এটা জানানোর পরও গ্যাসলাইন রয়ে যায়। বেজমেন্টের গ্যাস বের হওয়ার কোনো ধরনের ব্যবস্থা ছিল না।’
এদিকে ভবন বিস্ফোরণের আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে জনগুরুত্বপূর্ণ এসব মামলার তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করার তাগিদ আইনজীবীদের।
এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘জনগুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর তদন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখে প্রতিবেদন দ্রুত দেওয়া উচিত। এখানে যেহেতু মানুষের জীবনের বিষয় জড়িত। বারবার এ ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে এখানে কিছু করণীয় রয়েছে। তদন্ত করে সেটা বের করে নিয়ে আসা উচিত।’
আরএসএম/ইএ/এমএস