‘আমাকে লাশের সঙ্গে ফেলে দেওয়া হয়’

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:০৪ এএম, ২১ আগস্ট ২০২৩
রাশিদা আক্তার রুমা | ছবি- সংগৃহীত

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী সমাবেশ চলছিল। বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ করার মুহূর্তেই বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে মঞ্চটি। মাত্র দেড় মিনিটের ব্যবধানে ১৩টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ হয়, চারদিকে ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়।

তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে এ নারকীয় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন। আহত হন দল ও সংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মী-সমর্থক।

সেই হামলায় গুরুতর আহত হন ২০০৪ সালে কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা রাশেদা আক্তার রুমা। বর্তমানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী মহিলা লীগের সহ-সভাপতি ভয়াবহ সেদিনের কথা বলতে গিয়ে আঁতকে ওঠেন। জাগো নিউজকে সেদিনের কথা তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের এই নারী নেত্রী।

রাশেদা আক্তার রুমা বলেন, আমরা তখন মিছিল নিয়ে কোতোয়ালি থানা থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে উপস্থিত হয়েছি। সেদিন বেলা ২টার দিকে আমরা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আসি। ৩টা ২৫ মিনিটের দিকে আমাদের নেত্রী আসলেন। সেদিন প্রচণ্ড গরম ছিল। সেই গরমের মধ্যে আমার সঙ্গে অনেক কর্মী ছিল।

‘তখন আমাদের মিছিলটা ছিল, আমরা স্টেডিয়ামের গেট থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে হেঁটে যাবো। বললাম এত গরম, তখন আমি আবার দেখলাম হানিফ ভাই ট্রাকের ওপরে পানি খাচ্ছিলেন। একজন বলছে আপা আমি পানি খাবো। আমি হানিফ ভাইয়ের হাত থেকে একটা পানির বোতল হাতে নিয়ে তাকে দিলাম, দিয়ে বললাম আপনারা আস্তে করে সাইড হয়ে বাইর হইয়া যান, বাইর হয়ে যান জিপিওর দিকে। তারা বলছে আপা আপনি? আমি বললাম যে, আমি আইভি আন্টির সঙ্গে আসছি।’

তিনি বলেন, তাৎক্ষণিক তাদের এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে একটা ছেলে ১৬-১৭ বছরের হবে, পাঞ্জাবি পরা। সেই ছেলেটা আমার বাম দিক ঘেঁষে ভেতরে ঢুকছে, ট্রাকের সামনে। তখন আমি এই ছেলেকে বললাম তুমি এখানে ঢুকছো কেন? তখন আইভি আন্টি আমার ডান দিকে। আইভি আন্টি বললেন কথা বলো না। তখন বললাম আন্টি ছেলেটা এখানে ঢুকছে। তো আইভি আন্টি ছেলেটাকে বলছে এই তুমি ওই সাইডে দাঁড়াও ছেলেদের পাশে, এখানে দাঁড়ালে কেন? তখন ছেলেটা বলে আমার এখানে থাকার নির্দেশ আছে। তখন আইভি আন্টি বলছে তোমাকে কে নির্দেশ দিয়েছে।

‘তখন আমাদের পার্টি অফিসের সামনের যেই বিল্ডিংটা ওর ওপরে র‌্যাবের, র‌্যাব কি না আমি জানি না। কিন্তু কালো পোশাক পরা ছিল, মাথায় কালো কাপড় ছিল। ওই ছেলে হাত দিয়ে দেখাইছে র‌্যাবটাকে। উনি বলছে এখানে দাঁড়াইতে। তো আইভি আন্টি বলছে থাক দাঁড়াক। ওদের এগুলো পুলিশের ব্যাপারতো, থাক। এর দুই সেকেন্ডও যায়নি ওই ছেলেটা এখান থেকে চলে গেলো। দাঁড়ায় নাই। যখন আপা জয় বাংলা বললো তখন আমি আর আইভি আন্টি প্রথম যেই ডান পা বাড়ালাম, প্রথম বিস্ফোরণটা আমাদের ওপরই পড়লো।’

তিনি বলেন, তখন ছিঁটকে আইভি আন্টি পড়ে যান, আমিও পড়ে গেলাম। তখন আমার জ্ঞান ছিল না। যখন পড়ে গেলাম তখন স্প্লিন্টারগুলা গায়ে এসে পড়ছে। বাড়ি খেয়ে আমার ১৮টা দাঁত পড়ে গেলো। পরে ২২টা সেলাই হলো, বুকে সেলাই, হাতে সেলাই হলো। আমার ১৭ বার অপারেশন করা হলো।

রুমা বলেন, সেদিন আমরা শান্তির মিছিল করতে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গিয়েছিলাম। ২০০৪ সালে সুস্থভাবে আমরা কোতোয়ালি থানা থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে উপস্থিত হই। কিন্তু সেদিন আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার মিছিলে যাওয়ার পর আমাদের নেত্রীকে ওখানে যে মেরে ফেলার চক্রান্ত করলো বিএনপি ও জামায়াত সরকার। শেখ হাসিনাকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আমরা শতশত মানুষ পঙ্গুত্ব জীবন যাপন করছি। ২৪টা প্রাণ চলে গেলো।

সেদিনের ঘটনার কথা স্মরণ করে আহত এই নারী নেত্রী বলেন, ওখানে আমি কতক্ষণ পড়েছিলাম জানি না। যখন সন্ধ্যার কাছাকাছি দেখি যে লাইট জ্বলছে। তখন আমি চোখটা খুলে দেখি আমার সামনে আইভি আন্টি বসা। আর আমার এক পাশে রক্ত। কাপড় চোপড় ছিঁড়ে আমার একপাশে, ডান পা নাই। দেখি যে রক্ত, ব্যাগ, স্যান্ডেল এগুলো পড়ে আছে। আমি যখন চোখ খুলছি তখন কিছু লোক দৌড়ে আসলো, এসে আমাকে ধরে বসালেন। তারপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে জানলাম আমাকে পুলিশের গাড়িতে করে ঢাকা মেডিকেলে (ঢামেক) নিয়ে যাওয়া হলো। ঢাকা মেডিকেলে তারা আমাকে লাশের সাথে ফেলে দেয় সাদা কাপড় দিয়ে। সাদা কাপড় মুড়িয়ে লাশের সাথে যখন ফেলে দেয় তখন ওখানকার লোকজনের দৌড়াদৌড়িতেই হয়তো কারও আঘাতে আমি চিৎকার দিলাম।

আরও পড়ুন: ঘোষণা ছিল বিক্ষোভ মিছিলের, বয়ে গেলো রক্তগঙ্গা

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রুমা বলেন, তখন একটা মেয়ে ও সাবের ভাই ছিল সামনে, মেয়ে বলছে যে ভাই আমি ওর শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হয় জীবিত আছে! তখন সাবের ভাই তার গাড়ি দিয়ে ওই মেয়েটাকে দিয়ে আমাকে বাংলাদেশ মেডিকেলে পাঠালেন। বর্তমানে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি বজলু ভাই ও আমাকে ওখানে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। তখন অপারেশন রুমে আমার দুটি পা কেটে ফেলার জন্য মেয়েটাকে চিকিৎসক বলছে আপনি এটাতে সিগনেচার করেন। আর রক্তের ব্যবস্থা করেন। তখন ওই মেয়ে বলে আমি তো তাকে চিনি না। আমাকে সাবের ভাই গাড়িতে করে তার সঙ্গে দিলেন এখানে আনতে। আমি কীভাবে তার পা কাটার জন্য অনুমতি দিতে পারি। তখন ওই জায়গায় উপস্থিত হলেন তৎকালীন আমাদের নেত্রীর এপিএস জাহাঙ্গীর ভাই।

নিজের পরিবার ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ টেনে রুমা বলেন, আমার স্বামী রাজনীতি করতেন। তিনি মারা যাওয়ার সময় কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আমার স্বামীর মৃত্যুতে আমাদের নেত্রী ও ঢাকার মেয়র হানিফ ভাই আমার বাসায় আসেন। আমার এক মেয়ের তখন চার বছর, আরেক মেয়ের তিন বছর। তখন সুধা সদন থেকে নেত্রী আমাদের জন্য গাড়ি পাঠাতেন, এপিএস জাহাঙ্গীর ভাই আমাদের নিয়ে আসতেন। তখন থেকেই জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে চেনেন। হাসপাতালে তখন জাহাঙ্গীর ভাই চিকিৎসককে বললেন তার পা কাটবেন না। তার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা)। প্রধানমন্ত্রী যা সিদ্ধান্ত নেবেন তার সেটাই করতে হবে। চিকিৎসক বললেন এখনই রক্ত লাগবে। জাহাঙ্গীর ভাই দুই ব্যাগ ম্যানেজ করে দিলেন। এরপর জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে চলে আসলেন।

তিনি বলেন, তখন আমার কোনো জ্ঞান ছিল না যখন পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে আসে। তখন এখানেও আমাকে বলছে যে পা কেটে ফেলবে। তখন সাবের ভাই এবং জলিল ভাই গেছে। তারা বললো যে তার পা কাটা যাবে না। তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেব। তখন আমার পরিবারকে জিজ্ঞেস করেছে পাসপোর্ট আছে কি না। তখন তারা বলেছে যে হ্যাঁ পাসপোর্ট আছে। তারা জিজ্ঞেস করলো পরিবারের আর কারও পাসপোর্ট আছে কি না সঙ্গে যাওয়ার জন্য, বললো যে না আমাদের কারও পাসপোর্ট নাই।

‘আমাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। তখন পরিবারের কেউ আর যেতে পারেনি। পরে অবশ্য আমার মাকে নিয়ে যাওয়া হয়। কলকাতায় নিয়ে হাসপাতালে রাত ৮টা বাজে আরও কয়েকজনকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায় কিন্তু আমাকে ধরেনি তারা। আমাকে নিয়ে যেতে যেতে পুরো শরীর প্যারালাইজডের মতো হয়ে গেছে। তারা আমাকে অপারেশন থিয়েটারে একপাশে রেখে দিলেন। রাত ২টার দিকে আমার অপারেশন করলো আর তার আগে বললো প্রচুর রক্ত লাগবে। রক্তের কথা বললো কিন্তু সবার সঙ্গে আত্মীয়স্বজন গেলো তাদের মধ্যে কারও থেকে রক্ত পায়নি। একজন এক ব্যাগ রক্ত দিলো কিন্তু আমার তখন তাৎক্ষণিকভাবে ২০ ব্যাগ রক্ত লেগেছিল। আর এই রক্ত দিয়েছেন সেখানকার চিকিৎসক, নার্স, আয়ারা।’

তিনি বলেন, অপারেশন করার পর তিনদিন পর্যন্ত ওখানে আমার জ্ঞান আসেনি। তখন তারা আমাকে যেসব জায়গায় আঘাত পেয়েছি সেখানে আঘাত করছে। আমি অনুভব করছি ব্যথা পাচ্ছি কিন্তু মুখে বলতে পারছি না। চোখ খুলতে পারছি। কানে সব শুনতে পাচ্ছি। তখন ভাবছি যে, আল্লাহ মানুষ মারা যাওয়ার আগে সবই শোনে কিন্তু বলতে পারবে না, দেখতে পারে না। আমি কি মারা গেছি? তারা রুমে ঢুকছে, কে কী বলছে আমি সবই শুনছি।’

মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসা রুমা বলেন, তিনদিন পর আমার জ্ঞান ফিরলো। তখন আমার চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছিলাম। দেখছি না। তখন আমি চিৎকার করছি। বলছি আমি অন্ধ! দেখতে পারছি না কেন। তখন চিকিৎসকরা এসে বললেন আগের মতো তো দৃষ্টি পাবেন না। তবে কিছুটা পাবেন। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। এখনো আমি চোখে কম দেখি। ডান কানের পর্দা ফেটে গিয়েছিল। সবাইকে আমাদের নেত্রী একবার দেশের বাইরে পাঠিয়েছিলেন। আমাকে পাঁচবার দেশের বাইরে পাঠালেন। আমি দুই বছর নিয়মিত সেখানে ছিলাম। আর যখন বাচ্চাদের দেখতে ইচ্ছে হতো তখন বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতাম।

সেদিনের কথা মনে করে আওয়ামী লীগের এই নেত্রী বলেন, আমরা সেখানে গিয়েছিলাম সুস্থ সবল অবস্থায় একটি প্রতিবাদ সভায়। সেখানে নিজে পঙ্গু হতে তো যাইনি। ওখানে বলা হলো আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনা নাকি তার ভ্যানিটি ব্যাগে গ্রেনেড নিয়ে আসলো। আমাদের নেত্রী যদি এটি নিয়ে আসতো তাহলে তিনি কি চাইবে উনার লোকজনকে উনি মেরে ফেলতে।

‘এখনো আমরা আতঙ্কে দিনযাপন করছি। একটা দিন এমন নেই যে আমরা ঘুমাতে পারি সুস্থভাবে। এখন অব্দি কোনো জনসভায় যাই, কোনো মিছিলে যাই, তখন একটা আতঙ্ক থাকে, ভয় থাকে। ঘর থেকে বলে বের হতে হয় আমাদের যে, আমি যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু জীবিত আসবো কি না জানি না। সেই ভয়টা এখনো কাজ করে। এখনো আমরা সেই ভয় নিয়েই চলি। তারপরও জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা একা ছাড়তে পারি না। আপার জন্য আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত আছি এখনো।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নানা সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে রুমা বলেন, সরকার আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। চিকিৎসা, ভাতাসহ বিভিন্ন সহযোগিতা আমাদের দিচ্ছে। আমাদের ৩৫ জনকে মিরপুর ১৩ নম্বরে ফ্ল্যাট দেওয়া হবে।

আরএসএম/এমআরএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।