ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোর করতে চায় না মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ

মাসুদ রানা
মাসুদ রানা মাসুদ রানা , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:০১ এএম, ১৯ আগস্ট ২০২৩

২০০৫ সালের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন কঠোর করতে চায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সংশোধিত আইনের খসড়াও করেছে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সেখানে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কঠিন কঠিন ধারা যুক্ত করা হয়েছে, একই সঙ্গে প্রস্তাব করা হয়েছে শাস্তি বাড়ানোর। তবে বেশিরভাগ পর্যবেক্ষণই আইনের কঠিন ধারা ও শাস্তি বাড়ানোর বিপক্ষে মত দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

সংশোধিত আইনের খসড়া মন্ত্রিসভা বৈঠকে উত্থাপনের আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের কমিটিতে পাঠানো হয়। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের খসড়াটি পর্যালোচনা করে ১০টি পর্যবেক্ষণ দেয় মন্ত্রিসভা বিভাগের এ সংক্রান্ত কমিটি। যার বেশিরভাগ পর্যবেক্ষণই আইনের কঠিন ধারা ও শাস্তি বাড়ানোর বিপক্ষে।

সংশোধিত আইনের খসড়া ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের খসড়ার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মতামত দেওয়া সংক্রান্ত কমিটির সভার কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য জানা যায়।

আরও পড়ুন>> যে ৫ কারণে ধূমপান ছাড়তে বলেন বিশেষজ্ঞরা 

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী পরিমার্জনের পর ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন, ২০২৩’ এর খসড়া মন্ত্রিসভা বৈঠকে উত্থাপনের অপেক্ষায়। আগের আইনে পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট কোনো এলাকা বা ‘ধূমপান এলাকা’ রয়েছে। সংশোধিত আইনে তা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে।

 

আইনটি যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আইন আপডেট করার প্রয়োজন হয়, শাস্তির বিষয় থাকতে পারে, নতুন কিছু এরিয়া আসতে পারে। কিছু সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। আমরাও নতুন আইনে সেই জায়গাগুলো অ্যাড্রেস করছি।

 

এ প্রস্তাবের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কমিটি বলেছে, ‘ধূমপান এলাকা’ বিলুপ্তির বিষয়টি অধিকতর পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।

কোনো ব্যক্তি পাবলিক প্লেসে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবেন না জানিয়ে সংশোধিত খসড়ায় এ বিধান অমান্যের সাজা ৩শ টাকার পরিবর্তে দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নিরীক্ষা কমিটি বলেছে, বিদ্যমান বিধান বহাল রাখার বিষয়টি পুনঃপরীক্ষা করা যেতে পারে।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ভ্রাম্যমাণ দোকান বা ফেরি করে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবেন না। এটি করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে জরিমানা হবে দ্বিগুণ। এ বিষয়ে কমিটি পর্যবেক্ষণে বলেছে, এটি বাস্তবতার আলোকে পরীক্ষা করা যেতে পারে।

কোনো ব্যক্তি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া ছাড়া তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবেন না। লাইসেন্স ছাড়া তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে দণ্ড দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। বিষয়টি পুনঃপরীক্ষা করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কমিটি।

আরও পড়ুন>> পাবলিক প্লেসে ধূমপান, এ যেন আইন ভাঙার প্রতিযোগিতা 

সংশোধিত আইনের খসড়ায় ‘ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস ইত্যাদি নিষিদ্ধ’ উপ-শিরোনামে একটি ধারা যুক্ত করা হয়। সেখানে বলা হয়, কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, এর যন্ত্রাংশ বা অংশ বিশেষ (ই-সিগারেট, ভ্যাপ, ভ্যাপিং, ভ্যাপার ও ই-লিকুইড ইত্যাদি), হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস বা ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন করবেন না বা করাবেন না।

এ বিধান লঙ্ঘন করলে তিন মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং ওই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা বারবার একই ধরনের অপরাধ করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে দ্বিগুণ হারে শাস্তি পাবেন।

কোনো কোম্পানি এ অপরাধ করলে ওই কোম্পানির সংশ্লিষ্ট মালামাল জব্দসহ কোম্পানির মালিক, ব্যবস্থাপক বা সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তি সর্বোচ্চ ছয় মাসের জেল বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে দ্বিগুণ হারে শাস্তি ছাড়াও ওই কোম্পানির তামাক উৎপাদন ও বিক্রির লাইসেন্স বাতিল করা যাবে।

এছাড়া কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম, এর যন্ত্রাংশ বা অংশ বিশেষ (ই-সিগারেট, ভ্যাপ, ভ্যাপিং, ভ্যাপার ইত্যাদি) হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, ব্যবহার করবেন না। ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে বলে সংশোধিত আইনের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন>> প্রতিদিন ধূমপানে মস্তিষ্ক ছোট হয়ে যায়, বলছে গবেষণা 

নতুন এ ধারার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ পর্যবেক্ষণে বলেছে, এ প্রস্তাবনায় মন্ত্রণালয় বিভাগের সুস্পষ্ট ও লিখিত মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে।

jagonews24

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বিশ্বস্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইনটি যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আইন আপডেট করার প্রয়োজন হয়, শাস্তির বিষয় থাকতে পারে, নতুন কিছু এরিয়া আসতে পারে। কিছু সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। আমরাও নতুন আইনে সেই জায়গাগুলো অ্যাড্রেস করছি।’

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ধূমপান করি না, আপনি করেন। আপনার আমার মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে। তবে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে যা করার দরকার খসড়াটি আমরা সেভাবেই করেছি। আশাকরি আইনটি ভালো হবে। এখন দেখা যাক কী হয়!’

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী হোসেন আলী খোন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আইনের খসড়াটি পাঠিয়েছিলাম। তারা মিটিং করে কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়, সেগুলো আমরা ফেস করেছি। সেগুলো আমরা ঠিক করে দিয়েছি। তবে তারা যে পরিবর্তনগুলো করতে বলেছে সেগুলো গুরুতর কোনো সমস্যা নয়। আমাদের মেজর সংশোধনগুলো বহাল আছে।’

এ বিষয়ে জানতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাহেদা পারভীনকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, আমি অসুস্থ কথা বলতে পারবো না।

সংশোধিত আইনে আরও যা প্রস্তাব করা হয়েছে

পাবলিক প্লেসে ধূমপানের সঙ্গে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবেন না- এমন বিধান যুক্ত করা হচ্ছে সংশোধিত আইনে।

বর্তমান আইনে পাবলিক প্লেস হিসেবে যতগুলো স্থানের উল্লেখ রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে নতুন করে বেশকিছু স্থাপনা ও জায়গাকে পাবলিক প্লেস হিসেবে বিবেচনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ভবন, হোটেল, যে কোনো ধরনের রেস্টুরেন্ট, খাবার দোকান, কফি হাউজ, চায়ের দোকানও রয়েছে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, খেলাধুলার স্থান ও শিশু পার্কের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করা যাবে না। এটি করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে জরিমানা দ্বিগুণ হবে।

কোনো ব্যক্তি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়া ছাড়া তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করতে পারবেন না। লাইসেন্স ছাড়া তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে দণ্ড দ্বিগুণ হবে।

তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের সঙ্গে মিষ্টিদ্রব্য, মসলা, রং, সুগন্ধি, আসক্তিমূলক দ্রব্য বা কোনো মিশ্রণ যুক্ত করা যাবে না। এটি করলে ছয় মাসের কারদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে দণ্ডও দ্বিগুণ হবে।

 

আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আইনের খসড়াটি পাঠিয়েছিলাম। তারা মিটিং করে কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়, সেগুলো আমরা ফেস করেছি। সেগুলো আমরা ঠিক করে দিয়েছি। তবে তারা যে পরিবর্তনগুলো করতে বলেছে সেগুলো গুরুতর কোনো সমস্যা নয়। আমাদের মেজর সংশোধনগুলো বহাল আছে।

 

প্রস্তাবিত আইনে আরও বলা হয়, কোনো পেক্ষাগৃহ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ইন্টারনেট মাধ্যম, ওয়েবসাইট, ওয়েব পেজ, ইলেকট্রনিক মেইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সম্পর্কিত কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। এছাড়া ক্রেতার কাছে বিক্রির সময় ছাড়া বিক্রয়স্থলে সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য বা এর মোড়ক বা প্যাকেট দৃষ্টির আড়ালে রাখতে হবে।

সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির নামে কোনো তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না। একই সঙ্গে তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কোনো ব্যক্তি গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান বা কর্মসূচিতে আর্থিক বা অন্য কোনো সহায়তা দিতে পারবে না বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সংশোধিত আইনে আরও প্রস্তাব করা হয়েছে, সিগারেটের প্যাকেটের ৫০ শতাংশ স্থানের পরিবর্তে ৯০ শতাংশ স্থান জুড়ে ধূমপানে সৃষ্ট ক্ষতি সম্পর্কে, রঙিন ছবি ও লেখা সম্বলিত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সতর্কবাণী বাংলায় মুদ্রণ করতে হবে।

আরএমএম/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।