‘মঙ্গাপীড়িত রংপুর’ এখন খাদ্য রপ্তানিকারক জেলা
মঙ্গাপীড়িত জেলাখ্যাত রংপুর এখন দেশের সমৃদ্ধ জনপদ। চাহিদার দ্বিগুণ খাদ্য উৎপাদন হয় এ জেলায়। বর্তমান সরকারের ১৫ বছরের উন্নয়নে হয়েছে বিভাগ। পেয়েছে সিটি করপোরেশন। যোগাযোগেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে এতটা এগিয়েছে যে, রংপুরকে এখন বলা হচ্ছে দেশের উত্তরের রাজধানী।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রংপুরকে এক সময় মঙ্গা বা দরিদ্রপীড়িত জেলা হিসেবেই সবাই জানতো। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একাধারে সব খাতেই উন্নয়নের ফলে রংপুর এখন দেশের উন্নত জেলার একটি। এক সময় যেখানে মানুষের খাদ্য সংকট ছিল, সেখানে এখন চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণ খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে এবং তা সরবরাহ করা হচ্ছে খাদ্য ঘাটতি জেলাগুলোতে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ২০১০ সালেই রংপুরকে বিভাগ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বধীন সরকার। তখন রাজশাহী বিভাগ থেকে আট জেলা নিয়ে রংপুরকে বিভাগ ঘোষণা করা হয়। দুই বছরের মাথায় ২০১২ সালে রংপুরকে করা হয় সিটি করপোরেশন। এতেই পাল্টে যায় রংপুরের ভাগ্য। শুরু হয় নানান প্রশাসনিক উন্নয়ন। বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থার বিভাগীয় কার্যালয় হওয়ায় বেড়েছে তদারকি এবং কাজ।
আরও পড়ুন>> রংপুর এখন উদ্বৃত্ত খাদ্যের অঞ্চল: প্রধানমন্ত্রী
অবকাঠামো খাতে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠা, রংপুর পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, পীরগঞ্জে মেরিন একাডেমি স্থাপন, আদালতের বহুতল ভবন, সিভিল সার্জনের নতুন ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, আধুনিক পুলিশ লাইন্স হয়েছে। একই সঙ্গে হয়েছে ১৭ তলাবিশিষ্ট ক্যানসার হাসপাতাল নির্মাণ, বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, বিভাগীয় সদর দপ্তর, র্যাব-১৩ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর, রংপুর শিশু হাসপাতাল ও পুলিশ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি অবকাঠামো।
শেখ হাসিনার সরকারের বিগত প্রায় ১৫ বছরের আমলে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য রংপুর উত্তরাঞ্চলের রাজধানীর খেতাপ পেয়েছে।
রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, খাদ্য উৎপাদন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার হার, সামাজিক নিরাপত্তা, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাসহ সব বিষয়ে উন্নয়নে রংপুরের চিত্র পাল্টে গেছে। দেশের অন্য এলাকার মানুষ রংপুরকে মঙ্গা এলাকা হিসেবে জানলেও এখন আর তা নেই। কারণ রংপুর এখন চাহিদার দ্বিগুণ খাদ্য উৎপাদন করে অন্য জেলায় খাদ্য সরবরাহ করছে।
আরও পড়ুন>> উন্নয়নের ঝলকে সরকারের ১৪ বছর
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী নদীভাঙন রোধে তীর সংরক্ষণের ব্যবস্থার কাজ চলমান। একই সঙ্গে ছোট-নদী খাল খনন করার কারণে শুষ্ক মৌসুমেও ছোট নদীতে পানি থাকছে। এতে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে।
মোবাশ্বের হাসান আরও বলেন, রংপুর জেলার আলু এখন চার দেশে রপ্তানি হচ্ছে। আগামী দিনে আরও বেশি রপ্তানি হবে বলে আমরা আশা করছি।
রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার আসার পর বেশ কিছু উদ্যোগের কারণে রংপুরের খাদ্য উৎপাদন বাড়তে থাকে। বর্তমানে জেলায় বছরে খাদ্য চাহিদা প্রায় পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার টন। সেখানে উৎপাদন হয় ১০ লাখ ৩৯ হাজার টন। এই জেলার উদ্বৃত্ত খাবার অন্য জেলার মানুষের খাবার চাহিদা মেটায়। সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যাপক ব্যবহার বেড়েছে। ফলে উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি উৎপাদন খরচও কমেছে।
ওবায়দুর রহমান আরও জানান, রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা থেকে মিষ্টি কুমড়া মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া ২০২১ সালে রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম প্রধানমন্ত্রী ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। আমরা আশা করছি আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই আমও বিদেশে রপ্তানি হবে। এজন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন>> ২০২৪ সালে ট্রেন চলবে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুতে
স্কুলশিক্ষক মো. আব্দুল বাসেত বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রংপুরের চিত্র একেবারেই বদলে গেছে। রংপুর কী ছিল আর এখন কী হইছে! এটা শেখ হাসিনার অবদান। আমরা এখন সিটি করপোরেশনে থাকি। নগরের সুযোগ-সুবিধাও দিন দিন বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, গ্রামে আমরা কৃষিকাজ করি। ডিজিটাল বাংলাদেশের ধান কাটার হার্ভেস্টিং মেশিন আসায় উৎপাদন খরচ কমেছে। ধান কাটার সময় শ্রমিকের অভাব থাকে। এতে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটলে বিঘাপ্রতি চার-পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু হার্ভেস্টিং মেশিন দিয়ে ধান কাটলে লাগে মাত্র এক হাজার টাকা। সময় ও খরচ সাশ্রয় হয়। আমাদেরও টেনশন থাকে না।
২০১৯ সালের জুনেই শুরু হওয়ার কথা ছিল বহুল প্রত্যাশিত রংপুর-ঢাকা ছয় লেন মহাসড়কের নির্মাণকাজ। কিন্তু ছয় মাস পর শুরু হলেও এখন রংপুর জেলার অংশে নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এই ছয় লেন সড়কের কাজ শেষ হলেই ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপ্লব ঘটবে। কারণ তখন মানুষ মাত্র ৫-৬ ঘণ্টায় রংপুর থেকে রাজধানী ঢাকায় যেতে পারবে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর পাশাপাশি আরেকটি বেইলি ডাবল ট্র্যাক রেলব্রিজ হচ্ছে। এটির নির্মাণকাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেতুটির কাজ শেষ হলে ট্রেন যোগাযোগেও বিপ্লব ঘটবে।
২ আগস্ট ২০২৩ তারিখে রংপুরে ২৭ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি নতুন করে আরও পাঁচটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। এক হাজার ২৪০ কোটি টাকার ২৭ প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- শেখ রাসেল মিডিয়া সেন্টার, শেখ রাসেল ইনডোর স্টেডিয়াম, শেখ রাসেল সুইমিং পুল, পীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন জলাশয়ের জলাবদ্ধতা নিরসন শীর্ষক প্রকল্প, বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, পালিচড়া স্টেডিয়াম, নলেয়া নদী পুনঃখনন, আলাইকুমারী নদী পুনঃখনন ইত্যাদি।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার নির্মাণ, রংপুর জেলায় বিটাক কেন্দ্র স্থাপন, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ের রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়, রংপুর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অফিস ভবন এবং লেডিস হোস্টেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এসইউজে/এএসএ/এএসএম