মশা মারতে দামামা বাজাচ্ছে দুই সিটি, বাজেট ১৬৮ কোটি
# গত অর্থবছরে ৯৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে দুই সিটি
# নাগরিকদের অভিযোগ, বছরে শত কোটি টাকা জলে ফেলছে দুই সিটি
মশা মারতে প্রতিবছর পাল্লা দিয়ে বাজেট বাড়াচ্ছে রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু কোনো ক্রমেই সংস্থা দুটি মশাকে বাগে আনতে পারছে না। এখন বর্ষা মৌসুমে এসে এডিস মশা মারতে হিমশিম অবস্থা। অথচ গত একবছরে এ খাতে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সংস্থা দুটি।
চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) মশা নিয়ন্ত্রণে আরও ১৬৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর মধ্যে বাজেটে মশা নিধনে ১২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএনসিসি। তবে ঢাকা দক্ষিণে মশা নিধনে বাজেট বরাদ্দ কম। ডিএসসিসিতে চলতি অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ কোটি ১ লাখ টাকা।
মশা নিধনে শত কোটি টাকা ব্যয় করেও কোনো সুফল না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নাগরিকরা। তাদের অভিযোগ, মশা নিধনের নামে প্রতিবছর শত কোটি টাকা জলে ফেলছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি। টাকা নয়ছয় করার অভিযোগও রয়েছে তাদের। তারা বলছেন, কেননা করপোরেশনের কাউকে কখনো জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। অথচ নগরে মশা নিধনের জন্য প্রতিমাসে গৃহ করের সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিচ্ছেন তারা।
আরও পড়ুন> জুনের চেয়ে জুলাইয়ে ডেঙ্গুরোগী বেড়েছে ৭ গুণ
তবে এত চেষ্টা করেও মশা মরছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন খোদ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের দাবি, তারা মশক নিধন কার্যক্রমে সফল।
ঢাকার দুই মেয়রের এমন বক্তব্য ভিন্ন বার্তা দেয় বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও কীটতত্ত্ববিদরা। তারা বলছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। অধিকাংশ হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে শয্যা খালি নেই। অনেক হাসপাতালে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। আপাতদৃষ্টিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির বাড়বাড়ন্ত বলছে, দুই সিটির ফলাফল প্রায় ‘শূন্য’।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধন পদ্ধতিতে ত্রুটি রয়েছে। মশার ধরন না বুঝে, জায়গা মতো ওষুধ প্রয়োগ না করলে সুফল মিলবে না। এ জন্য মশা নিয়ে গবেষণা করা দরকার। যদিও এখন এ বিষয়ে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা অনেক তৎপর। তিনি বলেন, আগে ঢাকা শহরের ৪০ ভাগ এডিস মশা হতো নির্মাণাধীন ভবন থেকে। সিটি করপোরেশনের অভিযানে সেটি এখন ১৯ ভাগে নেমে এসেছে। কিন্তু এবার গবেষণায় আমরা ৪৩ ভাগ মশা পেয়েছি বহুতল মাল্টিপারপাস ভবনে। আমরা দেখেছি, মাল্টিপারপাস ভবনের যেসব জায়গায় পানি জমে এডিস মশা জন্মায় সেখানে সিটি করপোরেশনের লোকজন ও সংশ্লিষ্টরা যায় না। ফলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে এডিসের লার্ভা জন্মাচ্ছে।
চলতি বছর থেমে থেমে বৃষ্টি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে জানিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, যখন থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, তখন এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ে। ভারী বর্ষণ হলে এডিস মশার ডেনসিটি কমবে। এখন থেমে থেমে বৃষ্টিটাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, আগে বর্ষা মৌসুমে এডিস মশা বংশবিস্তার করতো। এখন সারাবছর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কার কথাও বলেন তিনি।
আরও পড়ুন> গোলটেবিল বৈঠক/ডেঙ্গু নিয়ে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
গুলশানের নগর ভবনে গত ২৪ জুলাই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৫ হাজার ২৬৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করে ডিএনসিসি। এ বাজেটে চলতি অর্থবছরে মশক নিধন কাজের জন্য ১২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।
ডিএনসিসির হিসাব বলছে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরের সংশোধিত বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। চলতি বছর তথা ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা গত অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে বরাদ্দের হার ৬১ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া গত অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা আগের চেয়ে ১০০ শতাংশ বেশি। এর বাইরে চলতি অর্থবছরে ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম ও প্রচারে আরও ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে মশা নিধন নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা এত কিছু করছি, এর পরও মশা কেন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না? এ প্রশ্নের উত্তর আমরাও জানি না। আমরাও এর উত্তর খুঁজছি। আসলে সমস্যাটা কোথায়?
মেয়রের এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নগরীর অনেকেই সমালোচনা করছেন। মিরপুর-১৪ নম্বরের বাসিন্দা রিয়াদুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশন যে মশা মারতে ব্যর্থ, মেয়রের কথায়ই তা স্পষ্ট। অথচ এই খাতে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।
মশা নিধনে ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘মশা নিধনে সিটি করপোরেশন থেকে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। মশার প্রজাতি ও মশার আচরণ নির্ণয় করে সঠিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে গবেষণা করার জন্য চুক্তি করা হয়েছে। এ বছরের বাজেটেও মশা নিধনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে জমে থাকা পানিতে এডিসের লার্ভা জন্মায়। তাই নিজেদের বাসা বাড়ির উঠান পরিষ্কার রাখতে হবে।
অন্যদিকে, গত ৩১ জুলাই ডিএসসিসির নগর ভবনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭৫১ কোটি ৫৬ লাখ টাকার বাজেট ঘোষণা করেন সংস্থাটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এ বাজেটে মশক নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক কিনতে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ফগার/ হুইল/ স্প্রে-মেশিন পরিবহনে ৩ কোটি ৭৫ কোটি টাকা ও মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি কিনতে ৪ কোটি ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে ব্যয় হয়েছে ৩১ কোটি টাকা।
এর আগে গত ৩০ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে মেয়র হানিফ মিলনায়তনে বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদারকরণবিষয়ক এক মতবিনিময় সভা করেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামও।
এতে ঢাকা দক্ষিণে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করে শেখ তাপস বলেন, অনেকে ঢালাওভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। অথচ ২২ জুলাই সারাদেশে ২ হাজার ২৪২ জন রোগী পাওয়া গেছে। সেখানে ডিএসসিসি এলাকায় ১৫৫ জন রোগী আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। ১৫৫ জনের ঠিকানা, স্থাপনায় গিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের মশক নিধন কার্যক্রম যে সফল হয়েছে, ঢাকাবাসী যে সুফল পাচ্ছে, এটি তারই নিদর্শন। আমরা এ পর্যায়ে আমাদের রোগীর সংখ্যা একশ থেকে দেড়শ’র ঘরে রাখতে পেরেছি। এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে এবং কর্মীদের নিরলস পরিশ্রমে।
এমএমএ/এসএনআর/এমএস