বিদ্যুৎ না থাকায় কুতুবদিয়ায় হতো না সিজারও

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক কক্সবাজার থেকে
প্রকাশিত: ১০:০৮ পিএম, ২১ জুলাই ২০২৩

কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপের খৈয়ারবিল এলাকার বাসিন্দা শওকত কামাল হারুন। ২০১৯ সালে হারুনের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হন। এরপর থেকেই পরিবারে নতুন অতিথি আগমনের আনন্দের পাশাপাশি এক ধরনের চিন্তাও ভর করে বসে। সাধারণভাবেই সন্তান প্রসব হবে নাকি সিজার করতে হবে এমন চিন্তায় ছিল সবসময়। সন্তান জন্মদানের ঠিক আগমুহূর্তে স্ত্রীর গর্ভে থাকা শিশুর নানা জটিলতা দেখা দেয়। ফলে বাধ্য হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে যান কক্সবাজারে। চিকিৎসকের পরামর্শে সিজারের মাধ্যমে আগমন হয় নতুন শিশুর। এতে খরচ হয় প্রায় এক লাখ টাকা।

শুধু শওকত কামাল হারুনই নন, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপের ছয় ইউনিয়নে বছরের পর বছর ঘটেছে এমন নানা ঘটনা। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অনেক মায়ের মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। আবার কক্সবাজার ও কুতুবদিয়ার মধ্যবর্তী উত্তাল সমুদ্রে ট্রলারেই জন্ম হয়েছে অনেক শিশুর।

আরও পড়ুন: হাতিয়া-নিঝুম-কুতুবদিয়া দ্বীপ আসছে বিদ্যুতের আওতায় 

দ্বীপটির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে এতদিন এই দ্বীপে সিজার অপারেশন চালু হয়নি। ফলে বাধ্য হয়েই সন্তানসম্ভবা মায়েদের নিয়ে ছুটতে হতো কক্সবাজার সদর কিংবা চকরিয়ায়। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ থেকে দেশের মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ট্রলার। সাগরের উত্তাল ঢেউ উপেক্ষা করেই সন্তানসম্ভবা মায়েদের নিয়ে যাওয়া হতো।

কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিল মাসে দ্বীপটিতে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। এর পর থেকে এখন সিজার অপারেশনের জন্য তাদেরকে আর কক্সবাজার কিংবা চকরিয়ায় যেতে হয় না। এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই কম খরচে সিজার করাতে পারছেন দ্বীপটির বাসিন্দারা। চলতি বছরের শুরু থেকে সিজার অপারেশনের পরিকল্পনা হাতে নেয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এরমধ্যে গত তিন মাসে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯টি সিজার অপারেশন করা হয়েছে।

জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করায় শুধু এসব অপারেশনই নয়, সম্ভব হয়েছে আরও অনেক কাজ। দ্বীপটির সবচেয়ে বড় বাজার বড়ঘোপ বাজারের ওষুধের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইনস্যুলিন, জলাতঙ্কের জন্য ভ্যাকসিনসহ যেসব জরুরি ওষুধ রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করা যেত না ফ্রিজ না থাকায়। এসব ওষুধ জরুরি দরকার হলেও হাতেগোনা কয়েকটি এনে আইসবক্সে রাখতেন ফার্মেসির দোকনিরা। আর রোগীর স্বজনরা এসব ওষুধ ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রেখে দ্রুত ব্যবহার করতেন।

স্থানীয় বাসিন্দা হুসাইন আল মারুফ বলেন, ইমার্জেন্সি ওষুধ খুব কম পাওয়া যেত। বিদ্যুৎ না থাকায় যেহেতু ফ্রিজের ব্যবস্থা ছিল না, তাই এসব ওষুধ কিনে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রেখে ব্যবহার করতাম আমরা।

আরও পড়ুন: ২০০ বছর ধরে আলো জ্বলছে ‘কুতুবদিয়া বাতিঘরে’ 

বড়ঘোপ বাজারের এম কে ড্রাগস হাউজের মালিক মোর্শেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ফার্মেসির দোকান চালাই। নানা ধরনের ওষুধ বিক্রি করি। তবে ইনস্যুলিন, জলাতঙ্কের জন্য ভ্যাকসিনসহ যেসব জরুরি ওষুধ রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করা যেতো না। বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রিজ ছিল না। ফলে জরুরি এসব ওষুধ হাতেগোনা কয়েকটা আনতাম। এনে আইসবক্সে রাখে বিক্রি করতাম। এখন যেহেতু বিদ্যুৎ পেয়েছি, শিগগির ফ্রিজ কিনে জরুরি ওষুধ সংরক্ষণ করবো।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. গোলাম মোস্তফা নাদিম জাগো নিউজকে বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এতদিন সিজার অপারেশন চালু ছিল না। চলতি বছরেই আমরা এটি চালু করেছি। গত তিন মাসে ২৯টি সিজার অপারেশন হয়েছে, যা এতদিন কুতুবদিয়ার মানুষদের সাগরের চ্যানেল পার হয়ে কক্সবাজার গিয়ে করতে হতো। গত এপ্রিলে বিদ্যুৎ আসার পর এখানে এক্স-রে চালু হয়েছে। গত এক মাসে ১৫০টি এক্স-রে করা হয়েছে।

দুর্গম দ্বীপে যেভাবে যুক্ত হলো জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ
দেশব্যাপী শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে ২০২০ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ রয়েছে। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপে স্বাভাবিক লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো সুযোগ না থাকায় সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছিল।

কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি থেকে মগনামা ঘাট পর্যন্ত ৩৩ কেভি রিভার ক্রসিংসহ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সাগরের তলদেশে ফাইবার অপটিকসহ ৫ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সাবমেরিন লাইন নির্মাণের মাধ্যমে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ দিতে কুতুবদিয়ায় নির্মিত হয়েছে দুই কিলোমিটার বিতরণ লাইন।

জানা গেছে, দ্বীপটির প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বর্তমানে প্রায় ২ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এখানে ১৯৮০ সালে জেনারেটরের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভাঙায় সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় স্বল্প আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি। স্বাধীনতার ৫ দশক পর চলতি বছরের এপ্রিলে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হলো কুতুবদিয়া।

আরও পড়ুন: কুতুবদিয়া থেকে ১০০ কিলোওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি 

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চকরিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল হক বলেন, প্রকল্পটি বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে অতিক্রম করা চ্যানেলটির পাঁচ কিলোমিটার পরপর দুটি সার্কিট রাখা হয়েছে। এখন অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে সবাইকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবো।

তিনি বলেন, আমরা জেনারেটরের মাধ্যমে ৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারতাম। গত এপ্রিলে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার ফলে আমরা এখন ২৪ ঘণ্টায়ই বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছি। এরই মধ্যে ৩ হাজার লোক বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। আরও ৭০০ জন আবেদন করেছেন। পর্যায়ক্রমে কুতুবদিয়ার ৬ ইউনিয়নের সবাইকে এই সুবিধার আওতায় আনা হবে।

আরএসএম/কেএসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।