ঈদযাত্রা সহজ করেছে পদ্মা সেতু, বৃষ্টিতে অস্বস্তি
নাড়ির টানে রাজধানী ছেড়ে গ্রামের বাড়ি ঈদ করতে গিয়ে মাগুরা, যশোর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলার মানুষগুলোকে পড়তে হতো চরম ভোগান্তিতে। রাজধানীর যানজটের ধকল কাটিয়ে পাটুরিয়া ফেরি ঘাটে গেলে ভোগান্তি বেড়ে যেত কয়েক গুন। ফেরিতে উঠতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যেত। একই ভোগান্তিতে পড়তে হতো পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন শেষে ঢাকায় ফেরার পথে। ফলে কারও কারও জন্য ঈদ আনন্দ অনেকটাই মাটি হয়ে যেত।
মাগুরা, যশোর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলার মানুষগুলোর ঈদযাত্রার এ ভোগান্তি এখন পুরোটাই অতীত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখন আর ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। স্বপ্নের পদ্মাসেতু খুলে দেওয়ার পর এসব জেলার মানুষগুলোর ঈদযাত্রার অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরতে বা গ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরতে আগে যে সময় লাগতো এখন তার অর্ধেক সময় লাগছে।
গত ঈদের (পবিত্র ঈদুল ফিতর) মতো এবারও ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, পিরোজপুরের পাশাপাশি মাগুরা, যশোর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলার বেশিরভাগ মানুষ পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গ্রামে ঈদ করতে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলের পাশাপাশি যাত্রীবাহী পরিবহনে খুব সহজেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরতে পারছেন।
তবে স্বস্তির এ ঈদযাত্রায় কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে ফেলেছে বৃষ্টি। বিশেষ করে যারা মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছে তাদের পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। দুদিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি হওয়ায় মোটরসাইকেলে ভিজতে ভিজতেই অনেকে ঢাকা ছেড়ে নাড়ির টানে গ্রামে ফিরছেন। অবশ্য সবকিছু ছাপিয়ে ঈদযাত্রার স্বস্তির গল্পই শোনা যাচ্ছে মানুষের মুখে মুখে।
ব্যক্তিগত প্রাইভেটকারে ঢাকা থেকে ঝিনাইদহের মহেশপুরের গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদযাপন করতে যাওয়া মো. ইব্রাহিম হোসেন বলেন, আগে ঈদের সময় পাটুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে গ্রামের বাড়িতে যেতে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হতো। ফেরিঘাটেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যেতো। কখনো কখনো ফেরি পেতে ৭-৮ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যেতে। ঈদযাত্রার এ ভোগান্তি এখন আর নেই। এখন ঢাকা থেকে ৫ ঘণ্টায় বাড়িতে চলে যেতে পারি।
তিনি বলেন, আমাদের ঈদযাত্রা সহজ করেছে পদ্মাসেতু। পদ্মাসেতুর কল্যাণে এখন আমরা খুব সহজে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যেতে পারছি। পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর আর পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের ওদিকে যায়নি। ফেরির জন্য আমাদের আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না।
যাত্রীবাহী পরিবহনে ঢাকা থেকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদযাপন করতে যাওয়া মো. ফয়সাল বলেন, প্রথম দিকে আমাদের অঞ্চলের মানুষের ধারণা ছিল পদ্মা সেতু আমাদের খুব একটা উপকারে আসবে না। এখন সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। পদ্মাসেতু দিয়ে খুব সহজেই ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি এবং গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকা যাতায়াত করতে পারছি।
তিনি বলেন, গত রোজার ঈদে আমি প্রথম পদ্মা সেতু দিয়ে গ্রামের বাড়ি যাই। পাঁচ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার আগে ঈদের সময় ঢাকা থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি আসতে ৮-১০ ঘণ্টা সময় লেগে যেত। ক্ষেত্র বিশেষে ১২-১৫ ঘণ্টাও লাগতো। ফেরির অপেক্ষায় ফেরিঘাটে ৫-৬ ঘণ্টা সময় কেটে যাওয়া স্বাভাবিক বিষয় ছিল।
তিনি আরও বলেন, গত ঈদে পদ্মা সেতু দিয়ে খুব সহজে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে আসতে পারাই এবারও একই পথ অবলম্বন করেছি। এবার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে গ্রামের বাড়িতে চলে এসেছি। পদ্মা সেতু আমাদের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করে তুলেছে। শুধু ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা নয় ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলার মানুষও পদ্মাসেতুর সুফল ভোগ করছেন।
মোটরসাইকেলে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মাগুরার উদ্দেশ্য রওনা হওয়া মো. মোরুফ হোসেনের সঙ্গে কথা হয় ফরিদপুরে। তিনি বলেন, আমি পরিবার নিয়ে যাত্রাবাড়ী থাকি। কয়েক বছর ধরে ঈদের সময় মোটরসাইকেলেই মাগুরার গ্রামের বাড়িতে যায়। গত রোজার ঈদে মোটরসাইকেল নিয়ে পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ঢাকায় আসার সময় পদ্মা সেতু হয়ে আসি। পদ্মা সেতু হয়ে আসাই সময় অনেক কম লাগে। তাই এবার পদ্মা সেতু দিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি।
তিনি বলেন, যানজট, ফেরিঘাটের ভোগান্তির কারণে ঈদের সময় মোটরসাইকেলে যাতায়াত করি। পরিবহনের তুলনায় মোটরসাইকেলে সময় ও ভোগান্তি কম হলেও আগে ফেরিঘাট দিয়ে যাতায়াতে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হতো। ঢাকার ভেতরে যেমন যানজট থাকতো, তেমনি সাভারেও যানজটে পড়তে হতো। সঙ্গে ফেরিঘাটের ভোগান্তিতো ছিলই। এখন আর এ ভোগান্তি নেই। পদ্মাসেতু দিয়ে খুব সহজেই যাওয়া-আসা করা যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে আমাদের ঈদযাত্রা অনেক সহজ হয়েছে। কিন্তু এবার বৃষ্টির মধ্যে পড়ে গেলাম। পুরো রাস্তা বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ভিজতে এসেছি। এতে একটু অস্বস্তি লাগছে। তারপরও রাস্তার যানজট আর ফেরিঘাটের ভোগান্তি এড়িয়ে বাড়ি যেতে পারছি এতেই খুশি। এখন বাড়িতে গিয়ে মার মুখ দেখলেই সব ক্লান্তি, অস্বস্তি দূর হয়ে যাবে।
মোটরসাইকেলে ঢাকার উত্তরা থেকে ঝিনাইদহের গ্রামের বাড়িতে রওনা হওয়া তারেক রহমানের সঙ্গেও কথা হয় ফরিদপুরে। তিনি বলেন, সারা রাস্তায় বৃষ্টির পানিতে ভিজেছি। বৃষ্টির কারণে মোটরসাইকেল চালাতে একটুক কষ্ট হয়েছে। তবে পদ্মা সেতু ও সুন্দর রাস্তার (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক) কারণে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, এখন আমাদের ঈদযাত্রায় আর আগের মতো ভোগান্তিতে পড়তে হয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির জন্য অপেক্ষা করা লাগে না। গাবতলী, সভার, ধামরাইয়ে অসহনীয় যানজটে পড়তে হয় না। যানজট ভোগান্তি এড়িয়ে খুব সহজেই ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যেতে পারি।
পদ্মা সেতুর টোল
পদ্মা সেতুতে চলাচল করতে মোটরসাইকেলে ১০০ টাকা, কার বা জিপে ৭৫০ টাকা, পিকআপ ভ্যানে ১ হাজার ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসে ১ হাজার ৩০০ টাকা, ছোট বাসে (৩১ আসন বা এর কম) ১ হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাসে (৩২ আসন বা এর বেশি) ২ হাজার টাকা, বড় বাসে (৩ এক্সেল) ২ হাজার ৪০০ টাকা, ছোট ট্রাকে (৫ টন পর্যন্ত) ১ হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাকে (৫ টনের বেশি থেকে ৮ টন) ২ হাজার ১০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৮ টনের বেশি থেকে ১১ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ৮০০ টাকা, ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) ৫ হাজার ৫০০ টাকা, ট্রেইলার (৪ এক্সেল পর্যন্ত) ৬ হাজার টাকা এবং ট্রেইলার (৪ এক্সেলের বেশি) ৬ হাজারের সঙ্গে প্রতি এক্সেলে ১ হাজার ৫০০ টাকা যোগ করে টোল দিতে হবে।
এমএএস/এমআইএইচএস