‘জামায়াতের হিসাব বিএনপির সঙ্গেই মিলবে’
মুনতাসীর মামুন। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক গবেষক। অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ঢাকা শহরের অতীত ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন। রয়েছে অসংখ্য রচনা।
জামায়াত ও রাজনীতির অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: আগের পর্বে জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, দলটির ভোট ৫ থেকে ৬ শতাংশ। তাহলে জামায়াতকে এত ভয় পাওয়া বা গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে?
মুনতাসীর মামুন: আওয়ামী লীগ-বিএনপি ক্ষমতায় আসতে ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করুন। দেখবেন, ১৫০টিরও বেশি আসনে ভোটের ব্যবধান দুই থেকে তিন হাজার। কোনো কোনো নির্বাচনের হয়তো আলাদা। এ কারণে জামায়াতকে গুরুত্ব দেওয়া।
আসলে এসব নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে দিতে হবে। না হলে এখানে সব নির্বাচন অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। যদিও এবার তাদের এমপিরা সংসদে ছিলেন। আওয়ামী লীগ অবৈধ হলে তারা সংসদে গেলো কেন? অবৈধ সরকারে অধীনে তারা কাজ করছে কেন? চলে যাক সব জায়গা থেকে। তাদের ভণ্ডামিটা পরিষ্কার। ক্ষমতায় না যেতে পারলেই সরকার অবৈধ বলা বিএনপির অভ্যাস।
জাগো নিউজ: একইভাবে বিএনপি সরকারকেও আওয়ামী লীগ অবৈধ বলেছিল? এই অভিযোগ-অনুযোগের রাজনীতি তো পুরোনো?
মুনতাসীর মামুন: আওয়ামী লীগ তো নির্বাচনে গেছে। বিএনপি তো নির্বাচন বয়কট করে চলছে। জিয়াউর রহমানের সময়ও আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।
জাগো নিউজ: ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি।
মুনতাসীর মামুন: আওয়ামী লীগ তখন জনদাবি নিয়ে মাঠে ছিল। নির্বাচনে যায়নি। বিএনপির মতো জোর-জবরদস্তি করেনি। বিএনপিকে ক্ষমতা না দিলে সব কিছু অবৈধ, এটি কোনো বিধান হতে পারে না।
বিদেশিরা যদি বিএনপিকে ক্ষমতায় বসায় ভালো কথা। নইলে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে, উন্নয়ন হবে। দুর্নীতি হলেও মানুষের কিছু উন্নয়ন হবে। এর বাইরে তো আর রাজনীতি নেই।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ব্যক্তিগতভাবে আমি জেলে যাবো না। শাহরিয়ার কবির জেলে যাবেন না। আমরা এই বয়সে জেলে যেতে চাই না।
জাগো নিউজ: আপনি নিজের সুরক্ষার জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় চান?
মুনতাসীর মামুন: আমি আমার কথাই তো ভাববো। বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রথম দিনই পাঁচ হাজার লোক মেরে ফেলবে। আপনাকেও মেরে ফেলবে।
জাগো নিউজ: এই আশঙ্কা কেন করছেন?
মুনতাসীর মামুন: আগে তো দেখেছি। আপনারা ভুলে যান। আপনারা মনে মনে সবাই আশা করেন, আওয়ামী লীগ সব সুবিধা দিক কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে না। বিএনপির লাথিটাও ভালো।
জাগো নিউজ: আওয়ামী লীগ এত উন্নয়ন করছে, সুবিধা দিচ্ছে, তাহলে শঙ্কাটা কোথায়?
মুনতাসীর মামুন: আমি কোনো শঙ্কার কথা বলছি না। জামায়াতকে মোকাবিলা করতে পারলে করবে, নইলে হারবে। আমি চাইবো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে আমার সুরক্ষার জন্য। আমি এত রাজনীতি বুঝি না। আমরা জেলে যেতে চাই না। যুক্তরাষ্ট্র কী চায় না চায় তা আমি বুঝতে চাই না।
জাগো নিউজ: আপনার চিন্তার বিপরীতের মানুষেরাও সুরক্ষা চায়?
মুনতাসীর মামুন: বিএনপির কয়জন মারা গেছে? কয়জন বুদ্ধিজীবীকে জেলে নিয়ে রিমান্ড দিয়েছে? আপনি তালিকা দেখান।
জাগো নিউজ: হত্যা, গুম, জেল-জুলুমের ঘটনা ঘটছে। মামুনুল হকরাও এখন জেলে। তারাও তো আপনার মতো সুরক্ষা প্রত্যাশা করে?
মুনতাসীর মামুন: রাখেন মামুনুল হকের কথা। তারা জেলে গেছে। আর তো কিছু করেনি। খুন-গুম সব আমলেই হয়েছে। এর উত্তর রাজনীতিবিদরা দেবেন। আমাদের কী?
আমি ভাই আপনাদের দেশের কথা চিন্তা করতে পারবো না। এত বড় বড় প্রগতিশীলদের কথা চিন্তা করতে পারবো না। আপনারা প্রগতিশীল হলে রাস্তায় থাকবেন। সব সময় আমরা বলবো কেন? আপনারা লেখেন না কেন?
জাগো নিউজ: আপনারা অগ্রগামী। এখন কী বলতে চান না?
মুনতাসীর মামুন: একটা সময় পর্যন্ত লিখেছি। আপনারা লেখেন না কেন? আপনারা ভীরু, তাই ফেস করতে চান না।
জাগো নিউজ: অভিযোগ তো আছে আপনারা বিএনপির সময়কার অসঙ্গতি নিয়ে যত সরব থাকেন আওয়ামী লীগের সময় ততই নীরব থাকেন। এক চোখে দেখেন বলে মানুষও হতাশ…
মুনতাসীর মামুন: কেউ হতাশ হলে আমার কিছু করার নেই। আমার কথা পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ থাকলে আমরা থাকবো। আওয়ামী লীগ না থাকলে আমরা মারা পড়বো।
জাগো নিউজ: তার মানে আওয়ামী লীগকে যে কোনো উপায়েই ক্ষমতায় থাকতে হবে?
মুনতাসীর মামুন: যে কোনো উপায়ে আসবে কেন? নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসবে। আওয়ামী লীগ কি ক্যু করে আসবে?
আমার জন্য আওয়ামী লীগ থাকা জরুরি। আপনার জন্য বিএনপি জরুরি হতে পারে।
জাগো নিউজ: যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসে?
মুনতাসীর মামুন: আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসলে আমি মারা যাবো। এত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কী আছে?
জাগো নিউজ: এ নিয়ে কোনো হতাশা?
মুনতাসীর মামুন: না। হতাশা কাজ করবে কেন? এটিই বাস্তবতা। রাজনীতি নিয়ে আমি এখন মাথাই ঘামাই না।
জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় এলে আমার কি সমস্যা? আপনারা কেন রাস্তায় নামেন না?
জাগো নিউজ: এই পরিস্থিতির শেষ কোথায়? কোথায় যাচ্ছে জাতি?
মুনতাসীর মামুন: বড় বড় কথা বলে কোনো লাভ নেই। এগুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি।
জাগো নিউজ: খারাপ নাকি ভালো কিছু অপেক্ষা করছে?
মুনতাসীর মামুন: ভালো কিছু আসবে তা মনে করি না। আবার খুব খারাপ কিছু আসবে তাও মনে করি না।
একটি দল স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তারা যতদিন থাকবে ততদিন এই রাজনীতি থাকবে। বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতায় তারা বিশ্বাস করলে সব সংকটের সমাধান হবে। পৃথিবীর কোনো দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এভাবে রাজনীতি করতে পারে না। এ কারণেই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে কোনোদিন সমাঝোতায় আসা সম্ভব হবে না।
জাগো নিউজ: আপনি আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমঝোতার কথা উল্লেখ করলেন। বাজারে প্রচার আছে আওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গেও আঁতাত করতে পারে?
মুনতাসীর মামুন: কী হচ্ছে তা আমার দেখার বিষয় নয়। আমি আবারও বলছি, আওয়ামী লীগ থাকলে আমি সুরক্ষা পাবো। নইলে পাবো না। এমনকি জামায়াতের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ থাকলে আমি সুরক্ষা পাবো। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকলে আমি সুরক্ষা পাবো না। আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে।
আমার কথা হচ্ছে, শেখ হাসিনা যে ক’দিন আছেন সে ক’দিন আমরাও আছি। আমাদের যাওয়ার বেলায় আর টানাটানি করবেন না।
জাগো নিউজ: বিএনপির জায়গায় জামায়াতের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সুযোগ আছে কি না?
মুনতাসীর মামুন: না। কোনো সুযোগ নেই। জামায়াতের হিসাব বিএনপির সঙ্গেই মিলবে। আপনারা সুবিধার জন্য আওয়ামী লীগ চান। কিন্তু মনে মনে আওয়ামী লীগের উৎখাত চান।
জাগো নিউজ: সুবিধা পেলে আওয়ামী লীগের উৎখাত চাইবো কেন?
মুনতাসীর মামুন: বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ তাই চায়। তাই দেখে আসছি। সুরক্ষা চায় সাময়িকভাবে। এরপরেই আওয়ামী লীগের বিরোধিতা শুরু হয়ে যায়। অতীত ইতিহাস দেখেন।
জাগো নিউজ: আওয়ামী লীগ উৎখাত হতে পারে?
মুনতাসীর মামুন: হতেও পারে।
জাগো নিউজ: সামনের নির্বাচন নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ?
মুনতাসীর মামুন: নির্বাচন হতেই হবে। আমরা প্রত্যাশা করছি আওয়ামী লীগই আসবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকবো। শেখ হাসিনা না এলে আওয়ামী লীগের অধিকাংশই দেশের বাইরে চলে যাবে। আমরা তো আর দেশের বাইরে যাবো না। দেশের প্রতি কমিটমেন্ট তো করা আছে। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি।
এএসএস/এএসএ/এমএস