যেভাবে সাংবাদিক নাদিমকে হত্যা করা হয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৩২ পিএম, ১৭ জুন ২০২৩

১৪ জুন রাত আনুমানিক ১০টা। পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফিরছিলেন সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম। অন্যদিকে, বকশীগঞ্জ বাজারের পাটহাটি এলাকায় ওঁৎ পেতে ছিল সাধুরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু তার সন্ত্রাসীরা। নাদিম ও তার সহকর্মী মোটরসাইকেল যোগে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে সন্ত্রাসীরা তাকে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এরপর পেছন থেকে দৌড়ে কয়েকজন সন্ত্রাসী নাদিমকে মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে পাশের একটি অন্ধকার গলিতে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকে তারা।

এ সময় প্রধান অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান বাবু ঘটনাস্থলের কাছ থেকে পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দেন। নিহত নাদিমের সহকর্মী তাকে বাঁচাতে গেলে সন্ত্রাসীরা তাকেও মারধর করে। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী নাদিমের চিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে বাবু ও তার সন্ত্রাসী গ্রুপ দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরবর্তী দিন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সাংবাদিক নাদিম।

শনিবার (১৭ জুন) সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জামালপুরের সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম ওরফে বাবুসহ জড়িত তার সহযোগী মনিরুজ্জামান মনির ওরফে মনিরুল, জাকিরুল ইসলাম ও রেজাউল করিমকে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও বগুড়ার দুপচাঁচিয়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর অপকর্ম নিয়ে অনলাইন পোর্টালে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম। প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাবু ক্ষিপ্ত হয়ে নাদিমকে বিভিন্নভাবে হুমকিসহ তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। পরে ময়মনসিংহের সাইবার ট্রাইব্যুনাল মামলাটি খারিজ করে দেন। মামলা খারিজের বিষয়টি নিয়ে নাদিম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এরপর আরও ক্ষিপ্ত হয়ে নাদিমকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন বাবু।

গত ১৪ জুন সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফেরার পথে বকশীগঞ্জ উপজেলার পাটহাটি এলাকায় কতিপয় সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলার শিকার হন এবং একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তাকে রাস্তার পাশে ফেলে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্থানীয় সাংবাদিক ও পথচারীরা তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে প্রাথমিকভাবে বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে রাতেই জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। এরপর নাদিমের অবস্থার অবনতি হলে ১৫ জুন সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ওইদিন বিকেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় ভিকটিমের স্ত্রী বাদী হয়ে মাহমুদুল আলম বাবুকে প্রধান আসামি করে বকশীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয় এবং সাংবাদিক নাদিমের ওপর হামলার একটি সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এছাড়া সাংবাদিক সংগঠনসহ বিভিন্ন মহল এ ঘটনায় ক্ষোভপ্রকাশ ও তীব্র নিন্দা জানায়। র‌্যাব এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন ও হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।

এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১৪ এর একটি আভিযানিক দল স্থানীয় র‌্যাবের সহযোগিতায় পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও বগুড়ার দুপচাঁচিয়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু, তার সহযোগী মনিরুজ্জামান মনির ওরফে মনিরুল, জাকিরুল ইসলাম ও রেজাউল করিম গ্রেফতার করে। গ্রেফতাররা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে।

গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, সাধুরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর পরিকল্পনাতেই এ হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে। সাংবাদিক নাদিম সাম্প্রতিক সময়ে বাবুর অপকর্ম নিয়ে অনলাইন পোর্টালে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাবু ক্ষিপ্ত হয়ে নাদিমকে বিভিন্নভাবে হুমকিসহ তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে ময়মনসিংহের সাইবার ট্রাইব্যুনাল মামলাটি খারিজ করে দেন। মামলা খারিজের বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন নাদিম। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে নাদিমকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন বাবু। সেই পরিকল্পনাতে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে।

কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতার মাহমুদুল আলম বাবু সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা ও নাদিমের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। ঘটনার পর থেকে তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে গ্রেফতার এড়াতে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপনে চলে যান। সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। বাবুর বিরুদ্ধে জামালপুরের বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।

তিনি আরও বলেন, গ্রেফতার রেজাউল, মনির ও জাকির মাহমুদুল হাসান বাবুর সন্ত্রাসী গ্রুপের অন্যতম সহযোগী। গ্রেফতার রেজাউল দৌড়ে গিয়ে নাদিমকে ধাক্কা দিয়ে মোটরসাইকেল থেকে ফেলে দেয়। পরে ঘটনাস্থলেই বাবুর নির্দেশে তারা নাদিমকে বেদম প্রহার করতে থাকে। একপর্যায়ে পাশের একটি অন্ধকার গলিতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় এবং এলোপাতাড়ি আঘাত করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। তাদের বিরুদ্ধেও জামালপুরের বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে।

টিটি/এমএএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।