রেকর্ড উৎপাদনেও বাড়তি দাম, উদ্বৃত্ত চাল যাচ্ছে কোথায়?
বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ- এমন দাবি বিগত বেশ কয়েকবছর ধরেই করছে সরকার। এমনকি ধান উৎপাদনে প্রতি বছরই গড়ছে রেকর্ড। যদিও ধান উৎপাদনের হিসাবে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে রয়েছে বড় ফারাক। তবে ধান-চাল উৎপাদনে মিলছে লাগাতার সাফল্য। চলতি বছরের বোরো মৌসুমেও ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ১৫ লাখ ৩৩৭ টন উৎপাদন ছাড়িয়ে গেছে এরই মধ্যে। কিন্তু এর কোনো প্রভাব নেই বাজারে। ভোক্তাকে চালের জন্য গুনতে হচ্ছে চড়া মূল্য।
তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে চালের চাহিদা বছরে তিন কোটি টনের সামান্য বেশি। সেখানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, এই চাহিদার তুলনায় দেশে চালের উৎপাদন আরও প্রায় এক কোটি টন বেশি। দেশে গত বছর (২০২২ সালে) তিন মৌসুমে মোট চাল উৎপাদন হয়েছে চার কোটি চার লাখ টন, যা এক বছরে উৎপাদনের রেকর্ড বলে দাবি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। গত ১৪ বছরে দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে ২৯ শতাংশ। চাহিদার তুলনায় দেশে উৎপাদন বেশি হলেও নানা কারণ দেখিয়ে বছরে আমদানি করা হচ্ছে কয়েক লাখ টন চাল। অথচ এরপরও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে দাম। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছে, উদ্বৃত্ত চাল যাচ্ছে কোথায়?
আরও পড়ুন: চাল সরবরাহ-মজুতে স্বস্তি, অস্বস্তি দামে
বাজার পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারির খুচরা পর্যায়ের গড় দামের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি।
কৃষি গবেষক ও অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চালের উৎপাদন ও চাহিদা নিয়ে যে তথ্য দেয় সেটা অনেক সময় মেলে না। আবার তাদের তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে বড় ধরনের ফারাক দেখা যায়। যে তথ্য দেওয়া হয় তা সামঞ্জস্যহীন।
তিনি বলেন, দেশে যে পরিমাণ চাল উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে সেটা নাও হতে পারে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য বারবার তাগিদ থাকলেও সেটা হচ্ছে না। আর এ তথ্য বিভ্রাটের সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারও সঠিক পরিকল্পনা করতে পারছে না। যে কারণে ব্যাপক উৎপাদনের কথা বলা হলেও বছর শেষে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। বেশি দামে কিনে খাচ্ছে ভোক্তা।
আরও পড়ুন: চাল কিনতেই দরিদ্র মানুষের ব্যয় মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশ
এদিকে, রাজধানীর খুচরা ও পাইকারি বাজারে নতুন বোরো ধানের চাল আসার পরেও দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। পাইকারি বাজারে মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৭ থেকে ৭০ টাকায়, যা খুচরায় এসে ৭৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। মোটা চালের দাম আগের তুলনায় আরও বেড়েছে। প্রতি কেজি স্বর্ণা ও পাইজাম জাতের চাল পাইকারি বাজারে ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগের থেকে ২ টাকা বেশি। খুচরায় এসব চাল ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়।
রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি চালের বাজার বাবুবাজারের জনপ্রিয় রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী রুবেল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বোরো ধান আসার পরে চালের দামে কোনো পরিবর্তন হয়নি। উল্টো নতুন করে মোটা চালের দাম আরও ২ টাকা বেড়েছে।
তিনি বলেন, নতুন চাল আসায় বাজারে চালের সরবরাহ বেড়েছে। কিন্তু দাম সেভাবে কমেনি, খুব বাড়েওনি। বরং শুনছি অনেক পুরান চাল রয়ে গেছে মিলে। সেগুলো এখন বাজারে ছাড়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ধানে বিফল হলেও চালে সফল খাদ্য বিভাগ
এ বছর ধান উৎপাদনে খরচ কিছুটা বেড়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে, এবার বোরো মৌসুমে এক কেজি চাল উৎপাদনের খরচ ৩ টাকা বেড়ে প্রায় ৪১ টাকা হয়েছে। ধান উৎপাদনে খরচ ২৮ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৩১ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ধান ও চালে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১০ শতাংশ।
গত বছরের তুলনায় বেশি দামে ডিজেল, বিদ্যুৎ ও সার কেনায় বোরো উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। ফলে এ বছর চালের দাম কিছুটা বাড়তি হওয়ার কথা। কিন্তু খরচ যেটা বেড়েছে সেটা পড়েছে কৃষকের ঘাড়ে। কারণ উৎপাদন খরচ বাড়লেও বোরো ধান কেনাবেচা হয়েছে গত বছরের দামেই। এখনো প্রতি মণ ধান এক হাজার ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
এসব বিষয়ে চালকল মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী জাগো নিউজকে বলেন, সবকিছুর বাজার এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাহলে চালের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হবে কেন? অন্য দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব রয়েছে চালের দামেও। চাল যারা বিক্রি করেন তারা যদি দাম না পান, তাহলে তাদের জীবন চলবে কীভাবে? সে অনুসারে অন্য নিত্যপণ্যের তুলনায় চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে বলা যায়।
আরও পড়ুন: চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি, তবু চালের সংকট!
তিনি বলেন, এ বছর ধানের দাম নিয়ন্ত্রণে আছে। আসলে কৃষক থেকে মিল পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা বাজারে গিয়ে। মিলগেটের মূল্য থেকে খুচরা বাজারে চালের দামে বিস্তর ফারাক। আমরা বারবার এ কথা বলছি, অথচ কেউ খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে না। সব দায় আসে মিলারদের কাঁধে। আসলে কৃষক-মিলার কেউই লাভবান হচ্ছে না। দাম কম বা বেশি যাই হোক, লাভ খাচ্ছে বিক্রেতাদের।
এসব বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশিদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, চালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে এটা সত্য। কিন্তু ধানের দাম সেভাবে না বাড়ায় উৎপাদন খরচের বাড়তি ব্যয় কৃষককেই বহন করতে হচ্ছে। মিল বা বিক্রি পর্যায়ে এর প্রভাব পড়েনি।
তিনি বলেন, মিল থেকে চাল ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাতে কেজিতে ১২ থেকে ১৫ টাকা ব্যবধান হচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক। ফলে ভোক্তা-কৃষক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ড. রাশিদুল হাসান আরও বলেন, সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। পাশাপাশি কৃষকদের ভর্তুকির মাধ্যমে তাদের বাড়তি খরচ কমিয়ে আনতে হবে।
এনএইচ/কেএসআর/জেআইএম