আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ
বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১৯৪ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করছে বিবিএস
মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ হলদিয়ার বাসিন্দা আলামিন হোসেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গণনাকারীরা তার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংগ্রহ করেন। যেমন- খানার (যারা এক পাতিলে রান্না খায়) আকার, কেউ বিদেশে থাকে কি না, খানার আয়ের উৎস, বিয়ে ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন ইত্যাদি।
হলদিয়া ইউনিয়নে বিবিএস নিযুক্ত তথ্য সংগ্রহকারী হাবিবুর রহমান বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ ২০২৩ এর তথ্য সংগ্রহ করছি। ১৩টি মডিউলের ১২১টি প্রশ্নের মাধ্যমে ১৯৪টি সূচকের তথ্য নিচ্ছি। নাগরিকরা তথ্য দিয়ে আমাদের কাজে সহযোগিতা করছেন। দেশের নাগরিকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং জনমিতিক তথ্য জানাতেই আর্থসামাজিক এ জরিপ পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: পছন্দের দেশ সৌদি, কাজের খোঁজে বিদেশ যাচ্ছে ৮৮ শতাংশ মানুষ
লৌহজংয়ের হলদিয়া গ্রামের গৃহবধূ শারমিন আক্তার। কথায় জড়তা আছে, স্পষ্ট বলতে পারেন না। মায়ের বাড়িতেই সংসার। স্বামী ঢাকায় দর্জির কাজ করেন। সপ্তাহান্তে বাড়ি আসেন। তথ্য সংগ্রহকারীরা শারমিনের কাছে তার পরিবারের আয় কী, কোথায় বাজার করেন, কীভাবে টাকা খরচ করেন, পরিবারের কেউ প্রবাসে আছেন কি না, স্মার্ট ফোন আছে কি না, নিজেদের আলাদা ঘর আছে কি না এমন অনেক তথ্য জানতে চান। শারমিনকে ১৯৪টিরও বেশি তথ্য দিতে হয়েছে আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপের মাঠকর্মীদের। এগুলোই দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি নির্ধারণ করবে। জানাবে অর্থনৈতিক ও অভিবাসনসহ ১৯৪ ধরনের তথ্য।
সহজে তথ্য সংগ্রহের জন্য স্থানীয়দের গণনাকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে রেমিট্যান্স ও জমি সংক্রান্ত তথ্য কৌশলে সংগ্রহ করছেন বিবিএস কর্মকর্তারা।
বিবিএস উপ-পরিচালক (মুন্সিগঞ্জ জেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা) মো. শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সবার সহযোগিতায় ভালোভাবে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। তবে রেমিট্যান্স ও জমি সংক্রান্ত তথ্য অনেকে দিতে চান না। আমরা কৌশলে সংগ্রহ করছি। অনেকে মনে করেন জমি ও রেমিট্যান্সের তথ্য দিলে কর দিতে হবে।
আরও পড়ুন: মৃতশিশু জন্ম বেশি রাজশাহীতে, কম খুলনায়
বিবিএস ১৫-২১ জুন ২০২২ সময়ে ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা পরিচালনা করে। এটি দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ ডিজিটাল শুমারি। যেখানে আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী মূল শুমারির অব্যবহিত পরে অর্থাৎ ২১ মে থেকে ১৫ জুন ২০২৩ সময়ে দেশের ১২ হাজার ৪০টি নির্বাচিত নমুনা এলাকায় আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ ২০২৩ পরিচালনা করা হচ্ছে। এ নমুনা জরিপটিও মূল শুমারির মতো শতভাগ ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে।
নমুনা এলাকার সংখ্যা বিবেচনায় এটি বিবিএস পরিচালিত সর্ববৃহৎ জরিপ। এ জরিপের মাধ্যমে প্রায় তিন লাখ খানার তথ্য সংগ্রহ করা হবে। সারাদেশে ২ হাজার ৮৫৬ জন গণনাকারী এ জরিপের কাজ করছেন। প্রতি ইউনিটে ২৫টি খানা থাকবে। আর প্রতি গণনাকারীকে ৪ থেকে ৫টি ইউনিটে গণনা করতে হবে। ঢাকায় দুই হাজার ৫৮৩টি নমুনা ইউনিট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এখানে ৬১০ জন গণনাকারী এবং ৩৯ জন সুপারভাইজার কাজ করবেন।
জরিপের প্রশ্নপত্রে ১৩টি বিষয়ভিত্তিক মডিউলের (খানার পরিচিতি, গৃহ, খানা, ব্যক্তি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যাংকিং সুবিধা, জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, অভ্যন্তরীণ অভিবাসন, বিদেশফেরত সদস্য, আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং খানার পরিসম্পদ সংক্রান্ত) আওতায় ১২১টি প্রশ্নের মাধ্যমে মোট ১৯৪টি সূচকের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: এখনো ২১ শতাংশ পরিবারে জ্বালানির উৎস খড়-পাতা-তুষ
ডিজিটাল ডিভাইস ট্যাবলেট ব্যবহার করে কম্পিউটার অ্যাসিসটেড পার্সনাল ইন্টার ভিউইং পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তথ্য সংগ্রহকারীরা নির্ধারিত এলাকায় দ্বৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্বাচিত খানাগুলোতে উপস্থিত হয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন। জরিপটি সফলভাবে সম্পাদন ও সঠিক তথ্য সংগ্রহ নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট খানার খানাপ্রধানসহ সব সদস্যের আন্তরিক সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে উপজেলা সুপারভাইজিং কর্মকর্তা-জেলা সুপারভাইজিং কর্মকর্তা/বিভাগীয় সুপারভাইজিং কর্মকর্তারা যোগাযোগ করছেন।
বিবিএস জানায়, জনশুমারি ও গৃহগণনা বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে পরিচালিত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপকভিত্তিক পরিসংখ্যানিক কার্যক্রম। যা নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশ বা নির্ধারিত ভূখণ্ডে বসবাসকারী সব ব্যক্তি বা জনগণের আর্থসামাজিক ও জনমিতিক তথ্য সংগ্রহ, সংকলন এবং প্রকাশের সার্বিক প্রক্রিয়া। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও একটি বৃহৎ কর্মযজ্ঞ হিসেবে শুমারির সময় বিস্তারিত আর্থসামাজিক ও জনমিতিক তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এ কারণেই প্রায় প্রতিটি দেশ শুমারি শেষ করার পরপরই দীর্ঘ প্রশ্নপত্র ব্যবহার করে বৃহৎ পরিসরে একটি জরিপ পরিচালনা করে। এ জরিপটিই নমুনা শুমারি বা আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ নামে পরিচিত। সাধারণত খানার আর্থসামাজিক তথ্যের পাশাপাশি খানা সদস্যের জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অভিবাসন ইত্যাদি বিষয়ে এ জরিপে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।
আরও পড়ুন: রেমিট্যান্স আসছে ১২.৮ শতাংশ পরিবারে, শীর্ষে চট্টগ্রাম বিভাগ
বিবিএস জানায়, এ জরিপের ফলে আপনার বসতঘরের সব ধরনের তথ্য যেমন পাকা, নাকি কাঁচা এসব তথ্যও জানা যাবে। মেঝে কাঁচা নাকি পাকা নাকি টাইলস করা এ ধরনের ১০টি প্রশ্ন থাকবে। পরিবারের মানুষ টিউবয়েলের পানি পান করেন কীভাবে বা বিশুদ্ধ পানির উৎস কী- এ সম্পর্কিত প্রশ্ন আছে জরিপে। প্রবাসী আয় আছে কি না বা পরিবারের কোনো সদস্য কোনো সময় প্রবাসী আয়ে সম্পৃক্ত ছিলেন কি না- এমন তথ্যও নেওয়া হচ্ছে জরিপে। এছাড়া গত সাতদিনে কোনো উপার্জন হয়েছে কি না বা উপার্জন হলেও তা খরচ হয়েছে কীভাবে, কোন বাজারে বাজার করেন, পরিবারটি কি পুরুষ প্রধান নাকি নারী প্রধান- জরিপে মিলবে এসব তথ্যও। এছাড়া ব্যাংক লেনদেন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য নেওয়া হবে তথ্য প্রদানকারীর কাছ থেকে।
মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় বিবিএস কর্মকর্তা অনামিকা জাগো নিউজকে জানান, জরিপের তথ্য সংগ্রহ করতে খুব বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না। তবে দু-এক স্থানে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এখন প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহযোগিতায় তারা জরিপের কাজ করছেন।
বিবিএস কার্যালয়ে ঘুরে দেখা গেছে, মাঠ থেকে সংগ্রহ করা তথ্য আরও গ্রহণযোগ্য ও নির্ভুল করতে আরও ১৪০ জন কর্মকর্তা নিরলস কাজ করছেন। মূলত তথ্যগত ভুল এড়াতেই সংশোধনের কাজ করছেন তারা।
আরও পড়ুন: দেশে ১০০ নারীর বিপরীতে পুরুষ ৯৮.১৩ জন
আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপের উদ্দেশ্য তুলে ধরে শুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের পরিচালক দিলদার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে প্রমাণনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ, উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও গবেষণা কাজে বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও জনমিতিক সূচকের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করা হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নাগরিক পরিষেবা নিশ্চিত করতে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন করা হবে।
তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রগতি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত মিলবে এ জরিপ থেকে। জরিপের অগ্রগতি ৩০ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এবারের জরিপটি ডিজিটাল হওয়ায় প্রায় শতভাগ নির্ভুল তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
এমওএস/এমকেআর/জিকেএস