‘বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও স্বীকৃতি পাননি অধ্যাপক নুরুল’
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে জাতীয় স্বীকৃতি না দেওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।
রোববার (৪ জুন) অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্মরণে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক স্মরণসভায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন তারা।
খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম গত ৮ মে ৯৪ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান।
সভায় বক্তারা জানান, ৬ দফার পেছনে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের চিন্তা চেতনা রয়েছে। তবে রাজনৈতিক ও আমলাতন্ত্রিক জটিলতায় কিছুটা অভিমান নিয়ে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তিনি।স্বাধীনতার পর বিশ্বব্যাংকের বড় পদে যোগ না দিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপক নূরুল ইমলামকে বর্তমান সরকার জাতীয় স্বীকৃতি দেয়নি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরি এবং বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের রূপরেখা তৈরি ও নীতি প্রণয়নে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দেওয়া অনুদারতার পরিচায়ক।
বক্তারা বলেন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। বঙ্গবন্ধু তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক পর্যন্ত জানানো হয়নি।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ৬০-৭০’এর দশকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাদের নাম খুব উচ্চারিত হতো তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। পরিকল্পনা কমিশন উচু পতাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে তা নেমে আসে। এটা হয়তো ওনাকে ব্যথিত করেছিল। এখন কমিশন আগের সেই মর্যাদায় নেই। তবে সবাই কেন ১৯৭৫ সালের আগে ধীরে ধীরে দেশত্যাগ করে চলে গেলেন- সেই প্রশ্নটা আমি রেখে গেলাম।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, উন্নয়ন অর্থনীতিকে বার্ডস আই ভিউতে দেখায় ওনার মতো কেউ ছিল না। আন্তর্জাতিক সেমিনারে অনেক নোবেল লরিয়েটকেও তিনি ছাড়িয়ে যেতেন। তার সঙ্গে দ্বিমত করে পার পাওয়া যেতো না। তবে ২১ পদক না পাওয়া তার কোনো আক্ষেপ ছিল না।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দীন আহমেদ বলেন, ৬ দফা প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কী মনে হয়- এগুলো খাবে তো? বাম বা ডান নয়, তিনি কল্যাণ অর্থনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু ওনাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বাণিজ্যিক এবং কৃষি অর্থনীতিতে ওনার মতো আর কেউ আসবেন কি না জানি না।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ৯০ বছর বয়সেই ৪টি বই লিখেছেন। ২০১৪ সালে দেশে এসে তরুণ গবেষকদের সেমিনারে বলেছিলেন, জ্ঞান অর্জনের জন্য ঘাম ফেলার মাধ্যমে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি দরকার। বঙ্গবন্ধুর বিশেষজ্ঞ দলে তিনি কাজ করেছেন। যদিও বিশ্বব্যাংকের গবেষণা পরিচালক পদে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও দেশ গঠনে তিনি এসেছিলেন। সঠিক সংখ্যা, গবেষণা এবং পরিকল্পনায় জোর দিতেন তিনি। যদিও এখনো আমরা বিবিএসের তথ্য সংখ্যা নিয়ে সংকটে পড়ি। শেষদিকে দেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে চিন্তত ছিলেন। অনুদার গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতেন। এখন একটি ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। লিখতে-বলতে আমাদের ৩/৪ বার ভাবতে হয়।
রাশেদ খান মেননের সরাসির শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। এ বিষয়ে মেনন বলেন, খুবই ভালো হতো যদি আমরা তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দিতে পারতাম। উপযাজক হয়ে কিছু করতে চাননি বলে পরে তিনি আর দেশে আসেননি। স্বাধীনতার আগে ছাত্ররাজনীতির উত্তাল সময়ে তিরি আমার পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, স্বাধীনতার পূর্বে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে রাজনৈতিক অঙ্গনে যুক্ত করার দারুণ ভূমিকা ছিল অধ্যাপক নুরুল ইসলামের। তবে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ায় হয়তো তিনি জাতীয় স্বীকৃতি পাননি। শুরুতে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মপরিধি অনেক ব্যাপক ছিল। বজেট প্রণয়নের সময় অর্থবিভাগের সঙ্গে তাদের বিতর্ক হতো। ব্যয় বাড়াতে মন্ত্রীদের সঙ্গেও ঝগড়া-বিবাদ হতো। তখন বঙ্গবন্ধু এসব ঝামেলা মিটাতে গিয়ে ব্যয় বাড়িয়ে দিতে বলতেন।
প্রশাসনের সঙ্গেও ঝামেলা হয়েছিল কমিশনের। তাৎক্ষণিক অ্যাডহক ভিত্তিতে কশিমনে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বেশ প্রফেশনাল লোকজনকে নিয়োগ করেছিলেন। তবে প্রশাসতিক বিভাগ থেকে আমলাতন্ত্রের নিয়োগের ভিত্তিতে লোকবল নেওয়ার কথা হয়। কিন্তু অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করে বিশেষভাবে সেটাও অনুমোদন নিয়ে নিলেন। ইআরডিতেও জামেলা হচ্ছিল। পরে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান।
ইকোনমিক ক্যাডার এখন অ্যাডমিন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সরকারের উদ্যোগ ছিল না। প্রমোশন পেতে এটা ইকনোমিক ক্যাডারদের দাবি ছিল। সরকার এটা দীর্ঘদিন ঠেকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু শেষ পর্যোন্ত এটা করতে হয়েছিল। তবে ক্যাডার সার্ভিস নিয়ে এখন রিভিউ হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সঞ্চালনায় থাকা বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. বিনায়েক সেন বলেন, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। রাজনৈতিক আগ্রহ থেকে তিনি বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি স্বাধীনতার জন্যও কাজ করেছেন। কিন্তু কেন তিনি একুশে পদক পাননি তা আমার বোঝে আসে না।
স্বাধীনতার পর বিশ্বব্যাংকের বড় পদে যোগ না দিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। তার সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান ও আনিসুর রহমান।
নুরুল ইসলামের সরাসরি ছাত্র মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, নুরুল ইসলাম ছিলেন কল্যাণ অর্থনীতিবিদ। তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার মিল ছিল। এজন্যই বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। আপনি করে বলতেন। অনেক খাতির করতেন।
নুরুল ইসলাম কেন দেশে স্থায়ী হননি, তার কারণ তুলে ধরেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, নুরুল ইসলাম দেশে এলে খুব ভালো থাকতেন। তবে নিজের চিকিৎসা ও পরিবারের দেখাশোনার জন্য তিনি মনে করতেন তার ফিরে যাওয়া উচিত।
বক্তব্যের শেষদিকে নুরুল ইসলাম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, নুরুল ইসলামকে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদকের মতো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। দিলে ভালো হতো। আমরা তাকে সম্মানের বেদিতে বসাই। এটাই তার বড় পুরস্কার।
অধ্যাপক নুরুল ইসলামের মেয়ে রুমিন রহমান কথা বলেন তার বাবার আগ্রহের দিকগুলো নিয়ে। তিনি বলেন, নুরুল ইসলাম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের দিকে বেশি জোর দিতেন। কারণ, তিনি মনে করতেন সঠিক তথ্য-উপাত্ত ছাড়া নীতি নির্ধারণ করা যায় না।
তিনি আরও বলেন, নুরুল ইসলাম ইতিহাস পাঠের ওপরও জোর দিতেন। কারণ, একটি দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে ইতিহাস ও সংস্কৃতি জানা খুব জরুরি।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ২৫টির মতো বই লিখেছেন। এর মধ্যে তার আত্মজীবনী অ্যান ওডেসি: দ্য জার্নি অব মাই লাইফ (২০১৭) প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমা থেকে নুরুল ইসলামের চারটি বই বেরিয়েছে। বাকি তিনটি হলো করাপশন, ইটস কন্ট্রোল অ্যান্ড ড্রাইভারস অব চেঞ্জ: দ্য কেস অব বাংলাদেশ (২০১৬); ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ: আ প্রাইমার অন পলিটিক্যাল হিস্ট্রি (২০১৯) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা (২০২০)।
এমওএস/ইএ/জিকেএস