এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বদলে দেবে চট্টগ্রামের যোগাযোগ-বাণিজ্য
# প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ, চলছে লালখান বাজার এলাকায় শেষ দিকের পাইলিং
# নির্মাণ শেষ হলে মহানগরের যোগাযোগ কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আসবে
# কমবে যানজট, কম সময়ে যাওয়া যাবে বিমানবন্দর
দেশের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে পরিচিত বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। বাণিজ্যিক এ নগরীর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান অন্তরায় যানজট। মূল শহর থেকে বিমানবন্দর যেতেই লেগে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই যানজট দূর করে যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করছে সরকার। ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ প্রায় ৭৫ শতাংশ শেষ। আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পে ভৌত কাজ শেষ করার আশা প্রকাশ করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হলে কোনো ঝক্কি ছাড়াই সরাসরি যাওয়া যাবে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর। বঙ্গবন্ধু টানেল হয়ে ধরা যাবে কক্সবাজারের পথও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ শেষ হলে চট্টগ্রাম মহানগরের যোগাযোগ অবকাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আসবে। এটি একই সঙ্গে সিইপিজেড, কর্ণফুলী ইপিজেড ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ ও দ্রুততর করবে। সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে বঙ্গবন্ধু টানেলের সঙ্গে। বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার মাইলফলক প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত হবে এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে।
আরও পড়ুন>> চলতি বছরেই চালু হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মিত হলে চট্টগ্রামের শিল্প-বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে বলে মনে করছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ জাগো নিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী। কিন্তু বাণিজ্যিক রাজধানীর সুবিধাগুলো চট্টগ্রামে নেই। ঢাকার পর চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি যানজট হয়। ব্যবসায়িক কাজে ঢাকাসহ বিদেশে যেতে বিমানবন্দর যাওয়ার জন্যও পড়তে হয় ভোগান্তিতে। বিদেশিরাও চট্টগ্রামে এলে একই ঝামেলায় পড়েন।
তিনি বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ শেষ হলে শাহ আমানত সেতু কিংবা কালুরঘাট এলাকা থেকেও দ্রুততম সময়ে চট্টগ্রাম বিমাবন্দরে যাওয়া যাবে। এরই মধ্যে বহদ্দারহাট-মুরাদপুর, মুরাদপুর-লালখান বাজার দুটি ফ্লাইওভার এদিকের যানজট অনেকটা কমিয়েছে।
আরও পড়ুন>> এক্সপ্রেসওয়ে-মেট্রোতে সরাসরি যুক্ত হচ্ছে তৃতীয় টার্মিনাল
সরেজমিনে দেখা যায়, পতেঙ্গা বঙ্গবন্ধু টানেলের মুখ থেকে শুরু হয়ে বন্দর এলাকার নিমতলা পর্যন্ত কাজ প্রায় শেষ। বর্তমানে বন্দর তিন নম্বর গেট হয়ে বারিক বিল্ডিং, আগ্রাবাদ, শেখ মুজিব রোড হয়ে লালখান বাজার পর্যন্ত কাজ চলমান। সম্প্রতি রেলওয়ের সঙ্গে জায়গা ইজারা জটিলতা শেষ হওয়ায় টাইগার ওভার ব্রিজের পাশে পাইলিংয়ের কাজও দ্রুতগতিতে চলছে। রেলওয়ের সঙ্গে প্রকল্পের জায়গা ইজারা জটিলতা থাকায় দীর্ঘদিন ওই জায়গাটিতে মাটি পরীক্ষা কিংবা পাইলিংয়ের কাজ করতে পারেনি সংস্থাটি।
রেলওয়ে থেকে প্রাথমিকভাবে ৭০ শতক জমি ১০ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে সিডিএ। এরই মধ্যে রেলওয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও করেছে। জায়গাটির ওপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও ল্যান্ডিং পয়েন্ট তৈরি করা হবে। দশ বছর পর আবার জায়গাটির ইজারা নবায়ন করতে হবে সিডিএকে।
অন্যদিকে পতেঙ্গা অংশে টানেল সংযোগ সড়কের সঙ্গে মিলিত হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ল্যান্ডিং পয়েন্ট। উড়াল সড়কে চলছে কার্পেটিংয়ের কাজ।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জাগো নিউজকে বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য টাইগার পাস রেলওয়ের ওপরের অংশটি নিয়ে জটিলতা ছিল। দীর্ঘ আলোচনার পর সমস্যাটি সমাধান হয়েছে। এখন টাইগারপাস ওভারব্রিজ অংশে প্রকল্পের পাইলিংয়ের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, এটি চট্টগ্রামের জন্য একটি মাইলফলক প্রকল্প। এটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম শহরের যোগাযোগ অবকাঠামোতে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে।
সিডিএ সূত্রে জানা যায়, নগরীর লালখান বাজার থেকে শুরু হয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংযোগ সড়ক পর্যন্ত সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মিত হচ্ছে। র্যাম্প ও লুপ মিলে উড়াল সড়কটির মোট দৈর্ঘ্য হবে ২০ কিলোমিটার। চার লেনের এই এক্সপ্রেসওয়ের ৫৪ ফুট প্রস্থ রয়েছে। ৯টি এলাকায় ২৪টি র্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) থাকবে। নগরীর টাইগারপাস মোড়ে চারটি, আগ্রাবাদ মোড়ে চারটি, বারিক বিল্ডিং মোড়ে দুটি, নিমতলী মোড়ে দুটি, কাস্টমস মোড়ে দুটি, সিইপিজেড মোড়ে চারটি, কর্ণফুলী ইপিজেডের সামনে দুটি, কাঠগড়ে দুটি এবং পতেঙ্গা সৈকত এলাকায় দুটি র্যাম্প থাকবে।
আরও পড়ুন>> ৩৩৫৩ কোটি খরচে এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে ঢাকা-জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রোড
চট্টগ্রাম মূল শহর থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাতায়াত নির্বিঘ্ন করা, শহরের যানজট কমিয়ে আনার পাশাপাশি যাত্রাপথের দূরত্ব কমাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ। ২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। যৌথভাবে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ পায় বাংলাদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ও চীনা প্রতিষ্ঠান র্যাঙ্কিন। প্রকল্পটির চুক্তিমূল্য ছিল তিন হাজার ৭২০ কোটি ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৭২৮ টাকা।
২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। সবশেষ সংশোধনীতে প্রকল্প ব্যয় ও সময় বাড়ানো হয়। সংশোধিত ব্যয় অনুযায়ী আরও ৬৪৯ কোটি দুই লাখ ৪৩ হাজার ৯১ টাকা বৃদ্ধির ক্রয়প্রস্তাব অনুমোদন দেয় সরকার। এতে ব্যয় বেড়ে এখন প্রকল্পের মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে চার হাজার ৩৬৯ কোটি সাত লাখ ১০ হাজার ৮১৯ টাকা। মেয়াদও বেড়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়।
প্রকল্প পরিচালক সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরুর পর থেকে অনেক জটিলতা তৈরি হয়। সবশেষ টাইগার পাস ওভারব্রিজ এলাকায় প্রকল্পের কাজের জায়গা নিয়ে রেলওয়ের সঙ্গেও কিছু জটিলতা ছিল। সেগুলো কেটে গেছে। রেলওয়ে আমাদের প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা ইজারা হিসেবে দিয়েছেন। এখন পুরো প্রকল্পে শেষ দিকের পাইলিং কাজ চলছে। সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ ভৌত কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত হলেও আমরা আশা করছি আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করতে।
এমডিআইএইচ/এএসএ/জেআইএম