প্রস্তুত ‘বিশেষায়িত ব্যাটালিয়ন’
দূতাবাসে নিরাপত্তা দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে আনসারের
সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তা সুবিধার বিষয়টি। বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের বাড়তি নিরাপত্তা প্রত্যাহারে এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেখানে রাষ্ট্রদূতরা যে স্বাভাবিক নিরাপত্তা পেতেন তা আগের মতোই থাকবে। তবে বাড়তি নিরাপত্তা (এসকর্ট) দেওয়া হবে না। তবে সেই ‘বাড়তি নিরাপত্তা’ দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিশেষায়িত ‘আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন’ বা এজিবি।
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এজিবির সদস্যদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাসে টানা ছয় বছর দায়িত্ব পালন করারও অভিজ্ঞতা রয়েছে। এজিবির সদস্যরা দেশে-বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা ভারী অস্ত্র পরিচালনা করতেও সক্ষম।
আনসার বাহিনীতে বর্তমানে ৪২টি ব্যাটালিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে দুটি নারী ব্যাটালিয়ন ও একটি গার্ড ব্যাটালিয়ন। ওই ব্যাটালিয়নটির নাম এজিবি। এজিবি মূলত ডিবির সোয়াত টিমের মতো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। চট্টগ্রামে ১৬টি ব্যাটালিয়নের ৬ হাজার ২৪৪ জন সদস্য এককভাবে ৬০টি ক্যাম্প ও অন্য বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৬টি ক্যাম্পে দুর্গম এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ‘অপারেশন উত্তরণ’ -এ কাজ করছে। সেখানে আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের দমন ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় পরিবার-পরিজন রেখে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে। গহীন জঙ্গলে নিয়মিত শর্ট রেঞ্জ পেট্রোলিং (এসআরপি) ও লং রেঞ্জ পেট্রোলিং (এলআরপি) টহল প্রদান ছাড়াও আভিযানিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে।
এছাড়া বর্তমানে আইসিডিডিআর,বিতে এই ব্যাটালিয়নের সদস্যরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে এজিবি। এই ব্যাটালিয়নে ৪১৬ জন সৈনিক এবং কর্মকর্তাসহ ৪২৫ জন জনবল রয়েছে। এছাড়া তাদের মতো প্রশিক্ষিত প্রায় ৩ হাজার জনবল রয়েছে। যাদের অন্য ব্যাটালিয়নে নিয়োজিত রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন: চাইলে কূটনীতিকদের টাকার বিনিময়ে সড়কে নিরাপত্তা: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
এই ব্যাটালিয়নের (এজিবি) সদস্যরা দেশে-বিদেশে কুইক রেসপন্স ট্রেনিং (কিউআরটি), স্পেশাল ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং (এসটিটি) ও স্পেশাল প্রটেকশন ট্রেনিং, বিশেষ অস্ত্র এবং ট্যাকটিক্যাল ট্রেনিং নিয়েছেন।
আনসারের কর্মকর্তারা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) ও র্যাবে প্রেষণে নিয়োজিত রয়েছেন। এছাড়া ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যরা সচিবালয়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অধিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও র্যাবসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরে প্রেষণে কর্মরত থেকে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।
পার্বত্য অঞ্চলের পাশাপাশি জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে মোবাইল কোর্ট ও ভেজালবিরোধী অভিযানে কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদবির ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যরা নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন। সারাদেশের সমতল এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ, মৌলবাদ ও মাদকনিয়ন্ত্রণে ব্যাটালিয়ন আনসার সদস্যরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছেন। তাদের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় আইনশৃঙ্খলা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামো উন্নয়নসহ অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য ও উন্নতি অর্জন করে যাচ্ছে।
যেখানে দায়িত্ব পালন করছে আনসার
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী দেশের সর্ববৃহৎ এবং জনসম্পৃক্ত বাহিনী। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে আনসার-ভিডিপির সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রায় ৫ লাখ সদস্য ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা রক্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে এ বাহিনীর পাঁচ সদস্য নিহত হন।
আরও পড়ুন: কূটনীতিকদের আনসার কীভাবে নিরাপত্তা দেবে, তা চূড়ান্ত
রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ, বঙ্গবাজার এবং নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্ধার কার্যক্রম ও আহতদের দ্রুত চিকিৎসাসেবা প্রদান, শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে দর্শনার্থীদের ভিড় এড়াতে আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের (এজিবি) সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। বাহিনীর পক্ষ থেকে একবেলা খাবার এবং ইফতারসামগ্রী বিতরণ করা হয়।
বর্তমান সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার অন্যতম মাইলফলক পদ্মা সেতু। এ বাহিনীর বিভিন্ন পদবির ব্যাটালিয়ন আনসার ও সাধারণ সদস্যরা নিয়মিত সেতুতে এবং পদ্মায় টহলের মাধ্যমে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে জাতীয় সংসদ ভবন, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল, হাসপাতাল, হোটেল, মোটেল ও ইপিজেডসহ ৫ হাজারেরও অধিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় ব্যাটালিয়ন আনসার এবং অঙ্গীভূত আনসার সদস্যরা নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।
বিদেশি কূটনীতিকদের আনসার বাহিনী কীভাবে অতিরিক্ত নিরাপত্তা (এসকর্ট) দেবে, সেটি চূড়ান্ত হয়েছে। বৃহস্পতি বা রোববারের মধ্যে নোট ভার্বালের (কূটনৈতিক পত্র) মাধ্যমে দূতাবাসগুলোকে বিষয়টি জানানো হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। বুধবার (১৭ মে) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন পররাষ্ট্র সচিব।
আরও পড়ুন: পরিস্থিতি স্বাভাবিক, কূটনীতিকদের বাড়তি নিরাপত্তা প্রয়োজন নেই
একই বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক। তিনি বলেন, কূটনীতিকদের অতিরিক্ত নিরাপত্তা দিতে আনসার বাহিনী প্রস্তুত, আর্থিক বিষয় আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
এদিকে বুধবার (১৭ মে) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বিদেশি কূটনীতিকরা চাইলে টাকার বিনিময়ে চৌকস আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের মাধ্যমে সড়কে চলাচলে নিরাপত্তা নিতে পারেন।
তিনি বলেন, যখন দেশে জঙ্গিদের উত্থান হয়েছিল, আমাদের এখানে অগ্নি-সন্ত্রাসের একটা রাজত্ব হয়েছিল। তখন চারটি দূতাবাসকে রোড প্রটেকশন দিতাম। এটা লিখিতভাবে দেওয়া হয়নি। তারাও আমাদের অনুরোধ করেনি। আমরাই তাদের দিয়েছিলাম, যাতে তারা কোনো রকম অসুবিধায় না পড়ে। আমরা চারটি দূতাবাসের বাইরে কাউকে দেইনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা মনে করি সেই পরিস্থিতি এখন নেই। যেহেতু সেই পরিস্থিতি নেই সেজন্য এ রোড প্রটেকশনটা উঠিয়ে নিয়েছি। এরপরও যদি কোনো রাষ্ট্রদূত মনে করেন তাদের প্রয়োজন হবে, তাহলে আমরা নতুন করে আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন তৈরি করেছি, তারাই সেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে। এটা অন-পেমেন্ট (অর্থ দিয়ে) নিতে হবে। খরচ দূতাবাসকে দিতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী আমরা সেই ব্যবস্থা করবো। এ রকমই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন: শুধু রাষ্ট্রদূত নয়, মন্ত্রীদের থেকেও পুলিশ সদস্যদের সরানো হবে
জানতে চাইলে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপ-মহাপরিচালক (অপারেশন্স) এ কে এম জিয়াউল আলম জাগো নিউজকে বলেন, আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন (এজিবি) দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও স্মার্ট ব্যাটালিয়ন। ছয় বছরের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাসে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের। ভিআইপিদের নিরাপত্তাসহ দেশের সম্পদ রক্ষার্থে এজিবিকে সে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারিভাবে আমরা এখনো কোনো নির্দেশনা পাইনি, তবে আমাদের ব্যাটালিয়ন প্রস্তুত রয়েছে।
টিটি/এমএইচআর/এসএইচএস/জিকেএস